রোজের হিসেব নিলে প্রতিদিন কারখানার দুর্ঘটনায় তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে এবং ১১ জন আহত হচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, এটা দেশের মাত্র আড়াই কোটি নথিভুক্ত কারখানার শ্রমিকদের ওপর করা হিসেব। এর মধ্যেও অনেক তথ্য গোপনের ঘটনা রয়েছে। মালিকরা ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরদের ঘুষ দিয়ে বহু দুর্ঘটনার খবর চেপে দেয়। তথ্য গোপন করতে জখম শ্রমিকদের বেসরকারি জায়গায় চিকিৎসা করানো হয়। কাজ হারানো বা কারখানা বন্ধ হওয়ার ভয়ে ইউনিয়ন চুপ থাকে।
দেশের সরকারি নথিভুক্ত কারখানায় রোজ দুর্ঘটনায় তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে এবং ১১ জন জখম হন। কিছুদিন আগে সরকারি এই তথ্যটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ শোরগোল পড়েছিল। কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের অধীন ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল ফ্যাক্টরি অ্যাডভাইস সার্ভিস অ্যান্ড লেবার ইনস্টিটিউট’ এই তথ্যটি প্রকাশ করেছিল তথ্য জানার অধিকার আইনে করা একটি প্রশ্নের প্রেক্ষিতে। শ্রম মন্ত্রকের অধীন সংস্থাটির দেওয়া এই সরকারি খতিয়ান হিমশৈলের চূড়ামাত্র। কারণ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি শ্রমিক তো এই সরকারি হিসেবের বাইরে। তাঁরা তো কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। যেমন কয়েক দিন আগে বারাসতের কাছে দত্তপুকুরে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে যে শ্রমিকদের মৃত্যু হল, তাঁরা তো কখনওই কোনও হিসেবে ধরা পড়বেন না! শুধু তাঁরা কেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোজ আমরা আমাদের রাজ্যের যে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর পাই, তাঁরাও তো কোনও সরকারি হিসেবের মধ্যে আসেন না।
১৯৮৪ সালে ভূপালে ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানির কারখানার গ্যাস লিক দুর্ঘটনায় আহত, নিহত মিলিয়ে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ। এটাই দেশের বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। ভূপাল গ্যাস কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এই পাঁচ লক্ষ মানুষের সকলেই শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবারের সদস্য। এঁদের অনেকে ইউনিয়ন কার্বাইডেই কাজ করতেন। বাকিরা অন্য কারখানা বা অসংঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন। কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় দেশে প্রতি বছর কত মৃত্যু হয় ও কতজন জখম হন, সেই হিসেব করতে গেলে দেখা যাবে গত প্রায় চার দশকে অনেকগুলি ভূপাল গ্যাস কাণ্ড দেশে ঘটে গিয়েছে।
শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন একটি ব্রিটিশ সংস্থা কয়েক বছর আগে একটি হিসেবে দেখিয়েছিল, ভারতে প্রতি বছর কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় ৪৮ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তারা ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’ তথা ‘আইএলও’-র বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে তথ্যটি পেয়েছিল। প্রতি বছর কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় মৃত এই ৪৮ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ২৪.২০ শতাংশ নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। এটা অভাবনীয় কোনও তথ্য নয়। প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে দুর্ঘটনায় নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর মেলে। এই প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছে, তখনও সংবাদমাধ্যমে জ্বলজ্বল করছে পূর্ব বর্ধমানের একটি গ্রামে নির্মীয়মাণ একটি বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্কের শাটারিং খুলতে গিয়ে গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যুর খবর। এই মৃত শ্রমিকদের খবর কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল ফ্যাক্টরি অ্যাডভাইস সার্ভিস অ্যান্ড লেবার ইনস্টিটিউট’ তথা ‘ডিজিএফএএসএলআই’-এর তথ্যে কখনওই জায়গা পাবে না। এমনকী, সম্প্রতি মিজোরামে রেলের সেতু তৈরি করতে গিয়ে সেটি ভেঙে মৃত মালদহের ২৩ নির্মাণ শ্রমিক বা মহারাষ্ট্রের থানেতে জাতীয় সড়ক নির্মাণের সময় ক্রেন ভেঙে মৃত ২০ শ্রমিকের তথ্য, যাঁদের মধ্যে আমাদের জলপাইগুড়ির একাধিক পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন, কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের হিসেবে স্থান পাবে না। এঁরা প্রত্যেকেই ঠিকাদারের অধীন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক।
২০২০ সালে দেশে সরকারি নথিভুক্ত কারখানার সংখ্যা ছিল তিন লক্ষ ৬৩ হাজার ৪৪২টি। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ বন্ধ। বাকি কারখানায় কাজ করেন ২ কোটি ৩০ লক্ষ শ্রমিক। কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের হিসেবে এঁরাই দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। ডিজিএফএএসএলআই এঁদের কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা জখম হওয়ার খতিয়ান দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০২০-এর মধ্যে গড়ে প্রতি বছর ১৩০৯ জন শ্রমিক কারখানায় হওয়া দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন এবং চার হাজার শ্রমিক আহত হয়েছেন। রোজের হিসেব নিলে প্রতিদিন কারখানার দুর্ঘটনায় তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে এবং ১১ জন আহত হচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, এটা দেশের মাত্র আড়াই কোটি নথিভুক্ত কারখানার শ্রমিকদের ওপর করা হিসেব। এর মধ্যেও অনেক তথ্য গোপনের ঘটনা রয়েছে। মালিকরা ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরদের ঘুষ দিয়ে বহু দুর্ঘটনার খবর চেপে দেয়। তথ্য গোপন করতে জখম শ্রমিকদের বেসরকারি জায়গায় চিকিৎসা করানো হয়। কাজ হারানো বা কারখানা বন্ধ হওয়ার ভয়ে ইউনিয়ন চুপ থাকে।
ডিজিএফএএসএলআই-এর অন্য একটি তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২০-এর মধ্যে দেশে কারখানায় হওয়া দুর্ঘটনায় ৩৩৩১ জনের মৃত্যু হলেও এইসব ঘটনায় মাত্র ১৪ জনের সাজা হয়েছে। অর্থাৎ, সংগঠিত ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার যেটুকু খবর সরকারের কাছে আসছে, সেখানেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও পদক্ষেপ করা হচ্ছে না। দোষী কর্তৃপক্ষের যদি সাজা না হয়, তাহলে কখনওই শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না।
১৪২ কোটি মানুষের দেশে নথিভুক্ত কারখানার শ্রমিক মাত্র আড়াই কোটি। বাকি কোটি কোটি শ্রমিকের কোনও হিসেব, তথ্য, রিপোর্ট কিছুই সরকারের কাছে নেই। সেখানে কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় রোজ কতজন শ্রমিক মারা যাচ্ছেন ও কতজন জখম হচ্ছেন, তার কোনও হিসেব পাওয়া সম্ভব নয়। যে ঘটনাগুলি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হইচই হয়, সেগুলি সরকারের নজরে আসে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবার সামান্য সরকারি সাহায্য পায়। বাকিটা পুরো অন্ধকার। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার সংস্কারের নামে নিয়মিত দেশের শ্রম সংক্রান্ত আইনগুলি শিথিল করে চলেছে। ১৯৪৮ এর ফ্যাক্টরি আইন সংশোধন করে কারখানায় শ্রমিক সুরক্ষা কমিটি গঠনের বিষয়টি কার্যত কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মস্থলের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধির অস্তিত্ব নামমাত্র। ‘ডিজিএফএএসএলআই’-এর রিপোর্টটি সামনে আসার পর কেন্দ্রীয় মানবাধিকার রক্ষা কমিশন সব রাজ্যকে শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট হওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল। কোনও রাজ্য কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ করেছে বলে খবর আসেনি।
ভিনরাজ্যে পরপর কয়েকটি দুর্ঘটনায় বাংলার শ্রমিকদের মৃত্যু হওয়ায় রাজ্যের শ্রম দপ্তর পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা বানিয়ে কিছু কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই ধরনের পদক্ষেপ জরুরি। কিন্তু দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দোষী কর্তৃপক্ষকে চিহ্নিত করে সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা সবার আগে প্রয়োজন। সংস্কারের নামে এটাকে শিথিল করার রাস্তায় যেন আমরা না হাঁটি।
অশোক ঘোষ মনে করতেন, ট্রাম আন্দোলন কলকাতার হকারদের একটি রাজনৈতিক চেতনা জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কেরানি, হকার, আর উদ্বাস্তুদের লড়াই। আর ট্রাম-ডিপো মানেই হকার। এইসব দোকানেই আন্দোলনকারীদের আড্ডা বসত। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের কথা আলোচনা হত। সকালে হয়তো কোনও এক চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়ে খবরের কাগজ পড়া হত।