তবুও খুঁজতে চাইলে একটা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লে, কয়েকটা পলেস্তরা খসিয়ে দিতে পারলে এখনও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে কয়েকটা অক্ষর। যেমন এখনও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে সেই সময়ের দেওয়াল লেখার কারিগরদের। বয়স হয়ে গেছে স্মৃতির, তবুও তখনকার রাজনীতিক চোখের মণিতে তোলা ছবি স্মৃতির অ্যালবামে রেখে দেওয়া। অন্য দেশের সত্তরের আন্দোলনের ইতিহাসে তার শিল্পের নিদর্শন থাকলেও আমাদের এখানে নেই।
৩.
সত্তর, সত্তর দশকের দেওয়াল লেখা সব দিক দিয়ে আলাদা, অন্যরকম।
যখন রাজনীতিক ভাবনা, কাজ শুধুই ‘ভাবনা’ আর ‘কাজ’ নয়, আরও বেশি কিছু, আরও গভীর কিছু, তখন অন্য অন্য সময়ের রাজনীতিক ভাবনা, উদ্দেশ্য ও কাজ থেকে সেই সময়টা, সেই সময়ের দেওয়াল লেখা সব দিক থেকে আলাদা হয়ে যায়। সত্তর দশক এই বাংলায় তেমনই একটা অন্য সময়।
যে রাজনীতি নিয়ে ভাবা ও রাজনীতিক কাজ করা ক্ষমতাসীন, প্রতিষ্ঠিত, স্বীকৃত রাজনীতিক ক্ষমতার মতো নয়, বরং বিপরীত, বরং সেসবকে অস্বীকার করা, বিরোধিতা করা, সেই রাজনীতিকতায় দেওয়াল লেখা বদলে যায়, যাওয়ার কথা, গিয়েছিল সত্তর দশকের রাজনীতিক সময়ে, যে সময়ের ডাকনাম ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’।
নকশালবাড়ি আন্দোলন যেহেতু তার সময়ের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকে, রাজনীতিক দলগুলোর, রাজনীতিক, প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করেছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় এইসব ক্ষমতাসীন নকশালবাড়ি আন্দোলনকে আক্রমণ করেছিল, সব দিক দিয়ে, সব কিছু নিয়ে, সব রকম ভাবে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের দেওয়াল লেখাকেও।
এই আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে দেওয়াল লেখার তখন অন্য চেহারা, অন্য চরিত্র। পৃথিবী জুড়ে সত্তর দশকের আন্দোলনের দেওয়াল লেখার একই ইতিহাস। তা নিয়ে অনেক লেখা, বই, ছবি প্রকাশিত হয়েছে। সে তুলনায় বাংলায়, ভারতে সত্তর দশকের রাজনীতির শিল্প নিয়ে লেখা খুঁজে পাওয়া কঠিন। শিল্পের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অথচ একটা কঠিন সময়ের শিল্পও তো শিল্প– অন্য শিল্প।
আমি যতটা দেখেছি, জেনেছি, বুঝেছি তা দিয়ে চেষ্টা করছি বাংলা দেওয়াল লেখার এই অংশটা।
প্রথমে কয়েকটা সাধারণ ও দরকারি কথা বলে নিয়ে একটা পটভূমি তৈরি করি। তারপর দেওয়াল লেখার খুঁটিনাটি নিয়ে লিখব।
সাধারণ ও দরকারি কথাগুলো খুব গুছিয়ে লিখছি না, যেমন যেমন মনে আসবে জানাব। এই আগোছালোপনাতেও সেই সময়টার খানিকটা আন্দাজ পাবে, যারা লেখাটা পড়ছে, তারা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন ইন্দ্রাশিস আচার্যর লেখা : ৫০ বছরের গরম হাওয়ায় পুড়তে থাকা আমরা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নকশালবাড়ি আন্দোলনকে নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন, পুলিশ, ক্ষমতায় থাকা, ক্ষমতায় যেতে চাওয়া রাজনীতিক দলেরা, সেই সেই দলের আঞ্চলিক সদস্যরা, ক্ষমতাবান সদস্যরা, রাজনীতিক দলগুলোর শারীরিক ক্ষমতার প্রতিনিধিরা। এই বিরুদ্ধ পরিবেশে সত্তর দশকের কর্মীদের দেওয়াল লেখা, লুকিয়ে, অন্ধকারে, পুলিশি আক্রমণের কাণ্ড খেয়াল রেখে।
আর এক দিক দিয়ে ভাবা যাক। দেওয়াল লেখা তখন সেই কয়েকটা মাত্র মাধ্যম, যার মধ্য দিয়ে কর্মীরা অন্যদেরকে বলতে পারবে তাদের রাজনীতি।
প্রকাশ্যে মিছিল, সভা, দেওয়ালে পোস্টার লাগানো, ইস্তেহার বিলি করা যাবে না। পড়ে থাকা অল্প কয়েকটা বলার, জানানোর মাধ্যমের মধ্যে দেওয়ালে লেখা। নিজেদের অস্তিত্ব, দর্শন, কাজ জানান দেওয়ার সুযোগ।
আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। সত্তর দশকের রাজনীতি অনেকের কাছেই নতুন। আগের সব কাজ, সব কথা থেকে আলাদা। ফলে বলার দায় বেশি।
এত কিছু দায়িত্ব দেওয়াল লেখার ওপর। অনেকটা সময় নিয়ে ফেললাম পটভূমিটা বুঝিয়ে বলতে। উপায় নেই।
এবার কথা লেখার ক্যানভাস দেওয়াল নিয়ে। দেওয়াল বাছার, পরিষ্কার করার সময় নেই। দেওয়াল পেলেই হবে। একটা কথা মনে রাখা। যে দেওয়ালে লেখা হবে, তার চারপাশে এই রাজনীতির সমর্থকদের থাকা। আঁকা হবে অনেক রাতে, এটা-ওটা-সেটার সাহায্য লাগবে। বন্ধুদের পাহারা, পুলিশ ভ্যান আসার আওয়াজ পেলেই সিগন্যাল দেওয়া, পাড়ার বাড়ি থেকে চা বিস্কুট, ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের মজদুরদের লম্বা বাঁশের মই রেখে যাওয়া। ক্যানভাসের রাজনৈতিক, ভৌগোলিক নির্বাচন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন সরোজ দরবারের লেখা: অনুবাদে ভুল, কিন্তু রেলপথ কি সত্যিই হত্যাকারী নয়?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দেওয়াল ঘষে সাদা রং মাখিয়ে পটভূমি তৈরি করার সুযোগ নেই। সুতরাং রং একটাই– কালো। এটা আবিষ্কার– পিছনে দেওয়ালের রং যাই হোক না কেন, কালো রঙের অক্ষর বেরিয়ে আসবেই।
কালো রং তো দোকান থেকে কেনা যাবে না। অত পয়সা নেই। তাছাড়া চিনতে পারলে পুলিশে খবর দেবে।
কালো রং তাই পোড়া মোবিল, পোড়া ডিজেল, ভুষো কালি তার সঙ্গে শিরিষের আঠার মিশেল, আলকাতরা, ব্ল্যাক জাপান।
যদি রং বদলের ইচ্ছেয় লাল, তাহলে রেড অক্সাইড, নীল চাইলে বাজারে পাওয়া ঠোকো সিনথেটিক নীলের টুকরো সাদা ন্যাকড়ার ভিতর পুরে নিয়ে জলে ডুবিয়ে নাড়াচাড়া করে নেওয়া। কখনও কালকাসুন্দরী পাতার রস দিয়ে আঁকা।
এবার ব্রাশ। দরজা জানলা রং করার ফ্ল্যাট ব্রাশ, তুলি। চেনাজানা রঙের মিস্ত্রিদের কাছ থেকে আনা। খেজুর গাছের ডাল কেটে থেঁতলে তুলি বানানো। পুরনো স্পঞ্জ।
দেওয়াল একটু মসৃণ হলে স্পঞ্জ ও পোড়া মোবিল দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ওয়ালিং করা যায় প্রায় হাতের লেখার মতো চটপট। তুলি না পেলে তাড়া থাকলে হাত দিয়েই অক্ষর বানানো।
লেখাটা লিখতে লিখতে দেওয়াল লেখার তখনকার নাম ‘ওয়ালিং’ চলে এল। রাজনৈতিক সময়ের রাজনৈতিক শব্দ ‘ওয়ালিং’।
কেউ কেউ ওয়ালিং পারত মাটির ভাঁড় দিয়ে।
কখনও দেওয়াল লেখার সঙ্গে ভারতের মানচিত্র এঁকে দেখিয়ে দেওয়া কোথায় কোথায় সত্তরের আন্দোলন চলছে।
জেলখানায় দেওয়াল লেখার সঙ্গে দেওয়াল আঁকা লেনিনের ছবি দিয়ে।
পাড়ার দেওয়ালে লেখার সঙ্গে মাও সে তুঙের ছবি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সত্তর দশকের রাজনীতি যত প্রসারিত হয়েছে, যত সদস্য বেড়েছে, দেওয়াল লেখার জায়গা বেড়েছে। লেখায় থাকা মানুষজনের জায়গা বেড়েছে। দেওয়াল লেখা এখন নিশ্চিন্ত, পাড়ার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে পড়েছে পাড়ায় থাকা ইশকুলের, কলেজের দেওয়ালে, ক্লাস ঘরে। সমর্থক শ্রমিক এলাকার দেওয়ালে, কারখানার প্রাচীরে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বিখ্যাত বামপন্থী শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে মাও সে তুঙের মুখের ছবি আঁকিয়ে সেটা টিনে কেটে স্টেনসিলের মতো বানানো। টিনটা দেওয়ালে বসিয়ে আলকাতরার পোচ মেরে সরিয়ে নিলেই চট করে মাও সে তুঙের মুখ।
লেনিন, স্টালিন আগেই এসেছে দেওয়ালে। মাও সে তুঙকে নিয়ে আসা হল এখন। আরও নতুন বিষয়, নতুন কথা যা আগের দেওয়াল লেখায় আনা হয়নি।
পরে সত্তর দশকের রাজনীতি যত প্রসারিত হয়েছে, যত সদস্য বেড়েছে, দেওয়াল লেখার জায়গা বেড়েছে। লেখায় থাকা মানুষজনের জায়গা বেড়েছে। দেওয়াল লেখা এখন নিশ্চিন্ত, পাড়ার দেওয়াল থেকে বেরিয়ে পড়েছে পাড়ায় থাকা ইশকুলের, কলেজের দেওয়ালে, ক্লাসঘরে। সমর্থক শ্রমিক এলাকার দেওয়ালে, কারখানার প্রাচীরে।
নানা ভাবের অংশগ্রহণে ছাত্ররা, শ্রমিকরা। প্রশিক্ষণ ছাড়া, অভিজ্ঞতা ছাড়া দেওয়াল লেখায় নতুন রাজনীতির নতুন কর্মী।
সত্তরের দেওয়াল লেখা জানিয়ে দিত বদলে দেওয়া, বদলে যাওয়া রাজনীতি। বদল কথায়, বিষয়ে, স্লোগানে।
চিন, ভিয়েতনাম, আলবেনিয়া, নাগা, মিজো, কুকি জনগণের লড়াই, সশস্ত্র বিপ্লব, গ্রামে চলো, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো, সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করো।
পরদিন সাড়া পড়ে যেত। পুলিশের, বিরোধী দলের খোঁজখবর নেওয়া। অন্যদিকে এই লেখা দিয়ে পাড়ার লোকেদের সঙ্গে সংলাপ, জিজ্ঞাসা তৈরি করা, সুযোগ পেলে উত্তর দেওয়া।
এখন সত্তর দশক নেই।
সত্তর দশকের আন্দোলন নেই। আন্দোলনের চিহ্ন দেওয়াল লেখারা মুছে গেছে, মুছে দেওয়া হয়েছে। তবুও খুঁজতে চাইলে একটা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লে, কয়েকটা পলেস্তরা খসিয়ে দিতে পারলে এখনও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে কয়েকটা অক্ষর। যেমন এখনও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে সেই সময়ের দেওয়াল লেখার কারিগরদের। বয়স হয়ে গেছে স্মৃতির, তবুও তখনকার রাজনীতিক চোখের মণিতে তোলা ছবি স্মৃতির অ্যালবামে রেখে দেওয়া।
অন্য দেশের সত্তরের আন্দোলনের ইতিহাসে তার শিল্পের নিদর্শন থাকলেও আমাদের এখানে নেই।
সত্তরকে সবাই ভোলাতে চেয়েছে। সত্তরের দেওয়াল লেখার ছবি খুঁজে না পাওয়া হয়তো তাই।
এই লেখাটা আর খুঁজে পেতে পাওয়া দু’টি ছবি থাক। থাকল।
কৃতজ্ঞতা: কমলিকা মুখোপাধ্যায়, স্বপন দাস অধিকারী, সুমন্ত বিশ্বাস
পড়ুন দেওয়াল লেখার কথা
পর্ব ১। লেখার দেওয়াল সবসময় তৈরি থাকে না, তৈরি করে নিতে হয়
পর্ব ২। পাড়ার দেওয়াল লেখা দেখে পাড়াকে বোঝা যায়