আমার এখন সাল-তারিখ গুলিয়ে যাওয়ার বয়স হয়ে গিয়েছে। কাজেই সে-ব্যাপারে বুকে হাত দিয়ে কিছু বলতে পারব না। কাছাকাছি একটা কিছু হবে বলে মনে হয়। দিনকে একেবারে রাত করে বসব না আশা করি।
মনে হয়, ১৯৭৬-এর জানুয়ারি। বইমেলার কথা আমি প্রথম শুনি, আমাদের ইংরেজি বিভাগের বন্ধু অরূপ রুদ্রের কাছে। তিনি তখন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে বিমল ধরের টেবিলের শরিক। আমি তখন ওই কফি হাউস থেকে অনেক দূরে। কখনও-সখনও, অনিয়মিত। আমাদের আড্ডা তখন যাদবপুরের কফি হাউসে। যে আড্ডার আঁতেল মর্যাদা প্রায় কিছুই না তখন। এখন আর সেকথা বলা যাবে না বোধহয়। বোধহয় বলছি, কেননা এখন আমি সেখানকার আড্ডা থেকেও দূরে। আমার আড্ডা এখন খুবই ক্ষীণধারায় বয়ে চলে শুধু টেলিফোনে। ‘প্রাক্পুরাণিক বাল্যবন্ধু যত, বিগত সবাই’, মহামৌনের অভিশাপে।
তা অরূপবাবু বললেন একদিন, বইমেলা হচ্ছে, ময়দানে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশের মাঠে, চলুন একদিন, ব্যাপারটা কী একটু দেখে আসা যাক। অবশ্যই। প্রথম দিন মনে হচ্ছে আমি আর অরূপবাবুই গিয়েছিলাম।
ভিক্টোরিয়া আর ক্যাথিড্রাল রোডের মাঝখানের মাঠের অর্ধেক। অর্ধেক, কারণ মেলার জায়গা ওই মাঠের ভিতর দিয়ে যে-একটা রাস্তা আছে, সেই পর্যন্তই। ঢোকার গেটের বাইরে টিকিট কাউন্টার। পরপর অনেকগুলো। প্রথম বছর কাউন্টারে ভিড় নেই আদৌ। যতটা মনে পড়ছে, ৫০ পয়সার টিকিট। ভিতরে মনোরম ফাঁকা। স্টলের সংখ্যা অল্প, ছড়িয়ে ছিটিয়ে সামান্য কিছু মানুষ। স্টলের সামনেই চেয়ার টেনে নিয়ে চেনাজানা লোকেদের আড্ডা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মঞ্চের ওপরে দেখা যাচ্ছে সুনীতিবাবুও এসে গিয়েছেন। তাহলে দেরি হচ্ছে কেন? গুঞ্জন শোনা গেল কেলেঙ্কারি হয়েছে। সুকুমার সেনও আসছিলেন একসঙ্গে, তাঁর গাড়ি একটু পিছনে ছিল বোধহয়। সে গাড়ি যখন গেটের কাছে এসেছে তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে, উদ্যোক্তাদের কেউ নাকি ছিলেন না গেটে। সুকুমার সেনের গাড়ি ফিরে গিয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সবচেয়ে আরামপ্রদ চমক হল, কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসটাই এখানে উঠে এসেছে, মায় রামু সমেত। কফি হাউসের আড্ডাধারীদের কাছে রামু একটা ব্যাপার। সে সবার খেয়াল রাখে। কে কোন টেবিলের বাসিন্দা, সে খেয়ালও থাকে তার। কেউ এসে একটু বেরিয়েছে, বসে পড়ো, এসে যাবে এখুনি, এ দায়িত্বও পালন করে রামু। পরে ওঠার সময়ে বিল চাইলেই রামুর মুখ ভার। সকালবেলায় বাজার-টাজার করে দিয়ে এসেছ, এখন বোসো। সেই রামু-সমেত কলেজ স্ট্রিট বইমেলায়। আর কী চাই!
প্রথম বছরটা স্বাভাবিকভাবে অনেক ফাঁকা, অনেক ছড়ানো-ছিটানো, অনেক ঢিলেঢালা, অনেকটাই আড্ডা-আড্ডা ভাব। ভারী ভালো লেগেছিল সে-বছর। প্রথম বছর তো কফি হাউসের তাঁবুর মধ্যে বসেই কফি খাওয়া। এক-আধ বছরের মধ্যেই সেখানে ভিড় বেড়ে যাওয়ায় বাইরে দাঁড়িয়ে কফি খেতে হত। তাও রামুকে দূর থেকে দেখতে পেলে বলে দিলেই হত। সে বিল-টিল কেটে যা যা করার, সব করে জিনিসটা নিয়ে এসে হাজির করত।
দু’-এক বছরের মধ্যেই বইমেলা আর একটু বড় হল। ওই ভিক্টোরিয়ার পাশেই রাস্তার এপাশ ও পাশ দু’-পাশ জুড়েই মেলার মাঠ। পরিসর আরও বেশি। ক্রেতা-বিক্রেতা– দু’-তরফেই চাহিদা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভিড়ও। একবার এক কাণ্ড হল, এখনও মনে আছে কথাটা। সেবার মেলা উদ্বোধন করার কথা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা অপেক্ষায় বসে আছি। মঞ্চের ওপরে দেখা যাচ্ছে সুনীতিবাবুও এসে গিয়েছেন। তাহলে দেরি হচ্ছে কেন? গুঞ্জন শোনা গেল কেলেঙ্কারি হয়েছে! সুকুমার সেনও আসছিলেন একসঙ্গে, তাঁর গাড়ি একটু পিছনে ছিল বোধহয়। সে গাড়ি যখন গেটের কাছে এসেছে তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে, উদ্যোক্তাদের কেউ নাকি ছিলেন না গেটে। সুকুমার সেনের গাড়ি ফিরে গিয়েছে। এদিকে হইচই, গাড়ি নিয়ে দৌড়োদৌড়ি। শেষরক্ষা অবশ্য হয়েছিল। সুকুমারবাবুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনা গিয়েছিল। কর্মকর্তাদের বেগ পেতে হয়েছিল নিশ্চয়ই। তবে সুনীতিবাবুকে নিয়ে কোনও সমস্যা সম্ভবত হয়নি। উনি ছাত্রকে জানতেন তো।
একদিন মেলার চেহারা এমন দাঁড়াল, ভিক্টোরিয়ার জোড়া মাঠেও আর কুলোচ্ছে না। তখন একবারের জন্য, ওই একবারের জন্যই, মনে হয় মেলাটা হয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেখানে প্রচুর জায়গা। কিন্তু যে-কারণেই হোক না কেন, সেবারের মেলায় যে সবাই খুব খুশি হতে পেরেছিলেন, তা মনে হয় না। দর্শকদের দিক থেকে এত বড়, এত ছড়ানো-ছিটানো, আর সেবার এত ধুলো ছিল যে, কারও খুব একটা বোধ হয় সুবিধা মনে হয়নি। আর প্রকাশক, বই-বিক্রেতা এবং মেলা কর্তৃপক্ষের দিকটা আমি সরাসরি বলতে পারব না, তবে মনে হয় তাদেরও খুব সুবিধা হয়নি। কেননা, পরের বছর থেকেই বোধ হয় আবার মেলার জায়গা বদল হল।সম্ভবত এরপর থেকেই মেলা অনেক বছরের জন্য চলে গেল পার্ক স্ট্রিটের মাঠে। এখান থেকে আস্তে আস্তে মেলা বড় হবে, এর চরিত্র বদলাবে। তবে ব্রিগেডের পরের বছরেই পার্ক স্ট্রিটে চলে গেল নাকি আবার একবার ভিক্টোরিয়া ঘুরে গেল, সে আর আমার এখন ভালো মনে নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মেলার গোড়া থেকেই মাঠে কেন্দ্রীয়ভাবে গান বাজানো, কবিতা-আবৃত্তি ইত্যাদির রেওয়াজ ছিল। মেলার মাঠে হালকা চালে ঘুরতে ঘুরতে রবীন্দ্রনাথের গানের কলি কানে যাচ্ছে, তার এক অন্য স্বাদ। একবার মনে আছে, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় পুরোটা শোনা গিয়েছিল রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা। সে-বছর কি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের শতবর্ষ পালিত হচ্ছিল? এইসব খুঁটিনাটি আর এখন মনে পড়ে না। ভাবতে গিয়ে মনে হয়, সত্যিই ওই সাল-তারিখের হিসেবে কী হবে! ওই বাক্যগুলো, ওই কণ্ঠস্বর, অতীত সেই দিনের ওই আবেগ যে আজকের গলায় একবার উঠে এল, এটাই বড় কথা, এটাই মনে রাখার। আমারও মন নির্ভার হয়ে অন্য আনুষঙ্গিক ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ওই শোনাটাই শুধু মনে রেখেছে।
আমাদের বইমেলার পুরাস্মৃতির কথা বলতে গেলে আর একটা বইমেলার কথাও বলতে হবে। অল্প দিনের ব্যবধানে কয়েক বছর আমরা পরপর দুটো বইমেলা পেতাম। একটা ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ পরিচালিত এই বড় বইমেলা। আর একটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত বইমেলা। গিল্ডের মেলার নাম কালে কালে দাঁড়িয়েছে ‘আন্তর্জাতিক কলিকাতা পুস্তক মেলা’। আর ওই মেলাটা কয়েক বছর বাদে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে কয়েক বছর ছিল তারই মধ্যে দুই মেলার চরিত্রের ফারাক ছিল বেশ স্পষ্ট। সরকারি মেলায় বাংলা বইপত্র ছিল প্রধান ব্যাপার। কাজেই চরিত্র ছিল তুলনায় বেশি স্থানীয়। আর গিল্ডের মেলা ছিল তুলনায় অনেক বেশি রঙিন ও উজ্জ্বল– শুধু তাই না, সেখানে ইংরেজি ও বিদেশি বইয়ের সম্ভার ছিল অনেক বেশি চোখে পড়ার মতো। ক্রমে ক্রমে ‘থিম কান্ট্রি’ যখন বেশ জমে বসল তখন থেকে সেই সেই দেশের বইপত্র দেখার সুযোগও বেশি পাওয়া যেত। গিল্ডের মেলার থিম কান্ট্রির আদলে সরকারি মেলায় ভারতের থিম রাজ্যের একটা ধরনও কয়েক বছর চালু ছিল বলে মনে হচ্ছে যেন।
এসবই ময়দান পর্বের কথা। ওই পার্ক স্ট্রিটের বইমেলাতে একবার আগুন লাগার দুর্ঘটনা ঘটল। কোনও এক খাবারের স্টল থেকে বোধহয় আগুন ছড়িয়েছিল। উৎস সম্ভবত কখনই খুব পরিষ্কার হয়নি, অন্তত প্রকাশ্যে। বইয়ের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে দমকল ও সমবেত সকলের প্রচেষ্টায় আরও বড় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। সাময়িক বইমেলা বন্ধ ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার তৎপর সহযোগিতায় মেলা দু’-একদিনের মধ্যেই আবার খুলেছিল। কলকাতা বইমেলার প্রত্যাশী দর্শকের আশায় একেবারে ছাই পড়েনি। তবে তারপর থেকে মেলা যতদিন ময়দানে ছিল অবশ্যই খেয়াল করা গেল যে, খাবার রান্না করার জায়গা মেলা প্রাঙ্গণের বেশ খানিকটা বাইরে থাকত। আর অন্য একটা বড় ব্যাপার ঘটল। পরিবেশগত কারণে মেলাকে শহরের জনাকীর্ণ মধ্য অঞ্চল থেকে সরানোর দাবি খুব জোরালো হয়ে উঠল। এতদূর যে, কলকাতার চারু জনমন প্রায় ময়দানপন্থী এবং তার বিরোধী পরিবেশপন্থী– এই রকম দুই ভাগে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল। শেষমেশ বইমেলা ময়দান থেকে ঠাইঁনাড়া হল। পার্ক স্ট্রিটের সায়েন্স সিটি মোড়, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের স্টেডিয়াম ইত্যাদি জায়গায় ঠোক্কর খেতে খেতে বর্তমানে সল্টলেকের বাস ডিপোর পাশের মাঠে আস্তানা পেয়েছে। এরই মাঝখানে কোনও এক সময়ে বইমেলার প্রবেশমূল্য উঠে গিয়েছে। টিকিট ছাড়াই সবাই এখন ঢুকতে পারে। কালে কালে মেলায় ভিড় প্রচুর বেড়েছে, তবে তা ঠিক এই টিকিট না-থাকার জন্য কি না, তা বলা শক্ত।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চলল, আমাদের বইমেলা সাবালক হয়েছে, স্মার্ট হয়েছে, হয়তো খানিকটা পেশাদারি দক্ষতাও অর্জন করেছে। কিন্তু হাত-পা ছড়ানো ঢিলেঢালা আলসেমির বিলাসিতাও তাকে খানিক ছাড়তে হয়েছে। সময়টা যে বদলেছে। মঁমার্ত-ভাবনার সূচনা কি এই ক্রান্তি-লগ্নের ভাবনা-বিন্দু বলে ভাবা চলে, অন্তত প্রতীকী অর্থে?
গোড়ার দিকের বইমেলায় শেষের এক দিন বা দু’-দিন বই বাজার হত। আক্ষরিক অর্থে ঢেলে বিক্রি করা হত বই। ইংরেজি-বাংলা সব রকমের বই। টাল করা বইয়ের মধ্যে থেকে নিজের দরকারের বইটা ছেনে বের করতে হত। স্বাভাবিক যে, প্রায় জলের দামে পাওয়া যেত বইগুলো। তাও একটু-আধটু দর দাম করার ঝোঁক দেখা যেত না, তা নয়। ফল কী হত, তা আর এখন মনে নেই। মনের অবস্থা শুধু যে আমারই এরকম, তা তো নয়। কাজেই আর দেরি না করে বইমেলা কর্তৃপক্ষের তরফে এই মেলার নির্ভরযোগ্য তথ্য-ইতিহাস একটা রচনা করার কাজে এখনই হাত দেওয়া সমীচীন। মেলার সুবর্ণ জয়ন্তী আগতপ্রায়।
স্বীকৃতি: বইমেলার সমবয়সি অপু দু’-একটা স্মৃতির ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছে।