আমার এক মাস্টারমশাই, বাংলার এক অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদ, শুনেছি বছর তিরিশেক আগে তাঁর ছাত্রাবস্থায় ওই পাঁচ নম্বর ট্রামেরই জানালার গরাদে ঝুলিয়ে রাখা ছাতাটি ভুলে ফেলে এসে কলেজচত্বরে বিস্তর হা-হুতাশ করতে শুরু করেন, কিন্তু কপাল ঠুকে উল্টো দিকে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর সহর্ষে দেখেন ধর্মতলা-ফিরতি ট্রামের জানালার গরাদে তাঁর সাধের ছাতাটি, ঈষৎ অভিমানী বক্রভঙ্গিমায়, তখনও ঝোঝুল্যমান। ‘আফ্ফ আমার ছাতা’ বলে চাপা ও সোল্লাস গর্জন-সহযোগে একনাথ সোলকার-সদৃশ দক্ষতায় বাইরে থেকে স্তম্ভিত ট্রামযাত্রীর নাকের ডগা থেকে তাঁর ছাতাটি তুলে নেওয়ার গল্প আমাদের প্রজন্মের গণপরিবহণ ও ফেলে-আসা এক অন্য নাগরিক মানসের মায়াবিধুর ইতিহাসে চিরতরে ঠাঁই পেয়েছে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
মফস্সলে কাটানো আমার শৈশব আর বাল্যে রেলগাড়ির এক সম্মোহক আকর্ষণ তো ছিলই, আর কালেভদ্রে কলকাতা এলে একটা আলটপকা রোম্যান্স তৈরি হত ট্রাম নিয়ে। মা-বাবার সঙ্গে আমার গন্তব্য ছিল প্রধানত উত্তরে বেলগাছিয়া আর দক্ষিণে ভবানীপুর আর হিন্দুস্তান পার্ক, আর এর প্রতিটাতেই ছিল ট্রামের গতিবিধি। সেই সময়ে ট্রামে চেপে গিয়েছি বেলগাছিয়া থেকে শ্যামবাজার, অথবা হাজরা মোড় থেকে গড়িয়াহাট। অদম্য বাসনা সত্ত্বেও চালকের ঠিক পিছনে ডানদিকের কোনাকুনি জানালা-শোভিত সিটটি পাইনি কখনও, ওই সময়ে ভাগ্যে জোটেনি ময়দান বা গঙ্গার ধার দিয়ে সাঁইসাঁই ধাবমান ট্রামে চড়ার সুযোগও।
সেই সব অপূর্ণ শখ, মাত্র দু’-একবারের জন্য হলেও, মিটল যখন এর অনেক পরে কলকাতায় এলাম কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। ছাত্র-অর্থনীতির মতো সহজ করে শ্রেণিভেদের তারতম্য বোঝার সুযোগও এনে দিল সেই ট্রাম। বাদুড়ঝোলা বাসের পাদানিতে পা ঠেকিয়ে গুঁতিয়ে ওঠার মতো রিস্ক ট্রামে সচরাচর নিতে হয় না, আমাদের সেই সময়কার বুঝভুম্বুল বেলবটম প্যান্ট আর ডাকব্যাকের সাইডব্যাগটি সামলে দৌড়ে টুক করে পাদানিতে লাফিয়ে উঠে পড়লেই হল। বাড়তি সুবিধে হচ্ছে, বেলগাছিয়া থেকে কলেজ স্ট্রিটের মোড় অবধি বাসভাড়া ২৫ পয়সা, কিন্তু ট্রামের ফার্স্ট ক্লাসে চাপলেও ২০ পয়সা, আর সেকেন্ড ক্লাসে মাত্রই ১৫। পাঁচ পয়সার দাম তখন অনেক, নিরর্থক এক পাতলা ফোমের পশ্চাদাশ্রয়ের জন্য ৩৩ পার্সেন্ট এক্সট্রা ফ্রি পথখরচ ছেড়ে দেওয়ার কোনও মানেই ছিল না, বিশেষ করে আমার ক্লাসের অভিজাত সহপাঠিনীরা তাদের ঈষৎ বক্র ভ্রু-ভঙ্গিমা নিয়ে অকুস্থলে হাজির না থাকলে। বিলক্ষণ, ট্রাম কোম্পানির ওয়েবসাইটে এই আজ অবধি লেখা আছে এই দরিদ্রবান্ধব যান নাকি ‘সুট্স দ্য পকেট্স অফ দ্য লোয়ার সেকশন্স’।
সে যাই হোক, নিত্যি দেখলেও তখন মনে ধন্ধ জাগেনি, ফার্স্ট ক্লাসে উঠে সামনের দিকে ধাবমান ট্রামের অভিমুখে কেন ছেলেদের জন্য ‘এয়ারক্রাফট-স্টাইল সিটিং’, আর পিছন দিকেই কেন গতিপথের আড়াআড়ি মেয়েদের জন্য লম্বা, টানা বেঞ্চি? এ-ও ভাবিনি, সেকেন্ড ক্লাসের বসার ব্যবস্থায় কেন লিঙ্গভেদ নেই, সে কি সমাজমানসে ‘দ্য লোয়ার সেকশন্স’ এক তারতম্যহীন বর্গ বলে? অনেক পরে বুঝি, কালেভদ্রের রেলভ্রমণে সেকেন্ড বা স্লিপার ক্লাসে ওঠা আমার কাছে ছিল সংগতির বাধ্যবাধকতার ব্যাপার, কিন্তু ট্রামের ফার্স্ট ‘অথবা’ সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণের মধ্যে ছিল এক মনস্ক, দৈনন্দিন ‘চয়েস’, যা হয়তো ‘ভদ্রলোক’ বাঙালির মানসিকতার কোনও ঝোঁকের প্রতি নির্দেশ করে।
কলেজ জীবনে ক্লাস কেটে মেট্রো বা নিউ এম্পায়ারে সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্য আমাদের, বন্ধুদের ফেভারিট বাহন ছিল পাঁচ নম্বর ট্রাম, যা কি না মৌনমুখর ইতিহাসের পদচিহ্ন বুকে নিয়ে টিকে আছে এখনও, বস্তুত প্রায় ওই আসন্ন মৃত্যুঘণ্টার মুহূর্তটি অবধি। আমার এক মাস্টারমশাই, বাংলার এক অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদ, শুনেছি বছর তিরিশেক আগে তাঁর ছাত্রাবস্থায় ওই পাঁচ নম্বর ট্রামেরই জানালার গরাদে ঝুলিয়ে রাখা ছাতাটি ভুলে ফেলে এসে কলেজচত্বরে বিস্তর হা-হুতাশ করতে শুরু করেন, কিন্তু কপাল ঠুকে উল্টো দিকে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর সহর্ষে দেখেন ধর্মতলা-ফিরতি ট্রামের জানালার গরাদে তাঁর সাধের ছাতাটি, ঈষৎ অভিমানী বক্রভঙ্গিমায়, তখনও ‘ঝোঝুল্যমান’। ‘আফ্ফ আমার ছাতা’ বলে চাপা ও সোল্লাস গর্জন-সহযোগে একনাথ সোলকার-সদৃশ দক্ষতায় বাইরে থেকে স্তম্ভিত ট্রামযাত্রীর নাকের ডগা থেকে তাঁর ছাতাটি তুলে নেওয়ার গল্প আমাদের প্রজন্মের গণপরিবহণ ও ফেলে-আসা এক অন্য নাগরিক মানসের মায়াবিধুর ইতিহাসে চিরতরে ঠাঁই পেয়েছে।
…………………………………………..
এ-ও ভাবিনি, সেকেন্ড ক্লাসের বসার ব্যবস্থায় কেন লিঙ্গভেদ নেই, সে কি সমাজমানসে ‘দ্য লোয়ার সেকশন্স’ এক তারতম্যহীন বর্গ বলে? অনেক পরে বুঝি, কালেভদ্রের রেলভ্রমণে সেকেন্ড বা স্লিপার ক্লাসে ওঠা আমার কাছে ছিল সংগতির বাধ্যবাধকতার ব্যাপার, কিন্তু ট্রামের ফার্স্ট ‘অথবা’ সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণের মধ্যে ছিল এক মনস্ক, দৈনন্দিন ‘চয়েস’, যা হয়তো ‘ভদ্রলোক’ বাঙালির মানসিকতার কোনও ঝোঁকের প্রতি নির্দেশ করে।
…………………………………………..
আমাদের সেইসব দিনে ট্রামের দীর্ঘ পূর্ব-ইতিহাসের খবর রাখতাম না, জানতাম না যে স্বাধীনতার উত্তরকালে আমাদের প্রতিরোধ-আন্দোলনের ঐতিহ্যকে আবার ঝালিয়ে নেওয়া শুরু ১৯৫৩ সালের জুন-জুলাই মাসে, যখন সেকেন্ড ক্লাস ট্রামভাড়া এক পয়সা– তিন থেকে চার পয়সা, আবার সেই ৩৩ পার্সেন্ট– বৃদ্ধির প্রতিবাদে উত্তাল জনরোষে ফেটে পড়ে কলকাতা, ট্রামলাইনে ব্যারিকেড বসানো ছাড়া আগুন ধরিয়েও দেওয়া হয় কয়েকটি ট্রামে। জানতাম না সত্তর বছর আগে আর এক অক্টোবরের সেই ভয়ংকর দিনটির কথাও, যখন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এক পড়ন্ত বিকেলে এক ধীরগামী ট্রাম চাপা দেয়, ‘লাশকাটা ঘরে’ ঠেলে দেয় আমাদের প্রিয় কবিকে। সেই ট্রামটিও শুনেছি পরে কোনও ভাবে আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়ে যায়। ৭০ বছর আগের সেই সময় ‘ধুলো আজ’, আমাদের প্রিয় এক লাজুক ও বিষণ্ণ কবি ও তাঁর ঘাতক ট্রাম, দুইই ‘ছাই হয়ে আছে’, কোনও এক ধূসর পাণ্ডুলিপির পাতায় হয়তো আজও চলে তাহাদের কথোপকথন।
ট্রামের এই বিদায়বেলায় একটা চাপা কষ্ট বুকের মধ্যে খোঁচায়, কেন আরও চড়লাম না? কেন গ্যালিফ স্ট্রিট থেকে টালিগঞ্জ অবধি শহরকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ছুটে চলা পঞ্চাশ নম্বর ট্রামে শখ করেও উঠলাম না কোনও দিন? মানিকতলা মোড়ে ওভারহেড তার থেকে খসে পড়া ট্রলি পোলটি আবার লাগিয়ে দেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ, সদ্য বিড়ি-ধরানো সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় কন্ডাকটর ভদ্রলোকটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করলাম না কেন দু’মিনিট? কেন মেলবোর্ন-কলকাতা ট্রামপ্রেমী সংগঠনের সঙ্গে সহমর্মিতা দেখালাম না, হেরিটেজ ট্রামে উঠলাম না, রান্না-খাওয়া নিয়ে কিঞ্চিৎ চর্চা করা সত্ত্বেও কেন ময়দানের ভিক্টোরিয়া ট্রামকার রেস্তোরাঁটিতে পদার্পণ করলাম না কোনও দিন, এমনকী, অল্প দূরত্বে থেকেও শহরের তিনশো বছরের জন্মোৎসবে সুচিত্রা মিত্রের উপস্থিতিতে এবং উনিশ শতকের পোশাক-শোভিত কর্মীদের তদারকিতে ঘোড়ায়-টানা ট্রামের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার অবিস্মরণীয় মুহূর্তটিরও শরিক হলাম না কেন?
…………………………………………..
আরও পড়ুন ‘ট্রামবাংলা’য় শ্রাবন্তী ভৌমিক-এর লেখা: পাখির ডাকে নয়, ঘুম ভাঙত ভোরের প্রথম টুং-টাং শব্দে
…………………………………………..
অতীতবিলাসী ভদ্রলোক বাঙালির মজ্জাগত এই সব অপূর্ণ বাসনা নিয়েই আমার পড়ন্ত বেলার বেঁচে থাকা। তবে জানি, ট্রাম চলে যাবে, কিন্তু তার আবছায়া অবয়বের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থেকে যাবে আমাদের দৈনন্দিন সংগ্রামের ইতিহাস, আর প্রেমের ইতিহাসও, আমাদের ক্লিন্নতার ইতিহাস, আবার আমাদের আশার ইতিহাসও, যেমন সত্যজিতের মহানগর-এর প্রারম্ভিক আর অন্তিম দৃশ্য। এই বহুবর্ণ পটেই আঁকা হয়ে থেকে যাবে আমাদের নিজস্ব ‘স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’। “পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল”।
..………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………