এই গরমাগরম ভোটের বাজারে কলকাতা মেট্রোরেলের জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র সরসারি বলে দিলেন, ‘আর নয় লাল!’। এই হবে খবরের শিরোনাম। ও জিনিসের টোপ সঙ্গে সঙ্গে গিলে কৌতূহলে ল্যা ল্যা করতে করতে ক্লিক করবে আমার মতো কিছু মানুষ আর মূল খবরে লেখা থাকবে– ‘পানের পিক ফেলা নিয়ে নাজেহাল কলকাতা মেট্রোরেল কতৃপক্ষ’। তবে এই শিরোনাম থেকে মূল খবরে যাওয়ার মধ্যবর্তী যে সময়টা, হ্যাঁ ওটাকে নানা নামে ডাকা যায় যেমন ‘সতর্কীকরণ’: এই শহরটা তো আপনারও, একটু পরিষ্কার রাখুন না!
কলকাতা মেট্রোরেলের জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র জানিয়েছেন, বর্তমানে কলকাতার প্রায় সমস্ত মেট্রো স্টেশনই ভরে উঠেছে মাখোমাখো লাল ইশকে! যেদিকে মেলিবে চোখ, রাঙা রাঙা ছোপ ছোপ। কারণ একদিকে যেমন প্রবল দ্রুতবেগে, সভ্যতার নিশান উড়িয়ে, নীল মায়াবী আলো গায়ে মেখে, গঙ্গার তলা দিয়ে ছুটে চলেছে মেট্রো। অন্যদিকে তেমনই দ্রুতবেগে, সভ্যতাকে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে, নীলকে ব্যালান্স করতে, রক্তিম ‘ওয়্যাক’ আভা গায়ে, দেওয়ালে, থামে, প্লাটফর্মে, লাইনে মাখিয়ে, গঙ্গার উপরিভাগ গরম করছে নানা মানুষের মুখ। কৌশিকবাবু অবশ্য বারবার অনুরোধ করেছেন, এইভাবে আশপাশ নোংরা না করতে। অনুরোধ করেছেন, এ ধরনের জিনিস আপনার কোনও সহযাত্রী করছে দেখলে তাকে তৎক্ষণাৎ বাধা দিতে। উনি এ-ও জানিয়েছেন যে, মেট্রোরেলে নেশাজাত দ্রব্য বহন করলে জেল পর্যন্ত হতে পারে। থুতু, পানের পিক ইত্যাদি ফেললে হতে পারে ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। কিন্তু ঠিক এখানেই, হ্যাঁ মাই লর্ড, ঠিক এখানেই এবার একটা বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে আমাদের!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুযোগ পেলেই সেটার যথেচ্ছ সদ্ব্যবহার করার কথা ‘মানবপ্রবৃত্তির রচনাবলি’তে একেবারে গোদা, মোটা কালির অক্ষরে লিখে দেওয়া আছে। যখন স্টেশন থেকে শুরু করে শপিং মল– সর্বত্র সিগারেট সেবনে নিষেধাজ্ঞা, তখন তা গুটকা সেবনেও নেই কেন? ট্রেনে, বাসে, অটোতে, সাধারণ দোকানের ভেতর, কোথাও জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে বা অন্য কোনও নেশা করতে করতে ঢুকতে পারবেন? পারবেন না। সিনেমা হলে ভিলেন সিগারেট খাচ্ছে দেখে ক্রেভিংতাড়িত হয়ে আপনি যখন ভাবছেন– ‘আহা গো, বেরিয়েই একটা সিগারেট খাব’– তখন আপনার সহ-দর্শক পাশে বসে, নিমিলীত চক্ষে গুটকা চিবুচ্ছে। এবার ওই চিবুনোর পর যে লালা ওর মুখগহ্বরে সংগৃহিত হবে, তা সে ফেলবে কোথায়?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রশ্নটা হল, কোনও ভালোমানুষের ব্যাটার যদি গুটকা, বা পানমশলা, বা নিদেনপক্ষে জরদা পানের নেশাও থেকে থাকে, তাহলে সেগুলো আয়েশ করে চিবুনোর পর সে পিকটা ফেলবে কোথায়? একটা লোক তো আর সঙ্গে করে বদনা নিয়ে ঘুরতে পারে না রে ভাই! কী করবে? যখন ওর মুখের ভেতর উথালপাতাল ঢেউ উঠছে, আলজিভ কোনওরকমে বীর সৈনিকের মতো একা রক্ষা করছে গড়– যাতে গলা দিয়ে না গলে যেতে পারে সেই তরল বর্জ্য, ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দুর মতো যখন কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রস, গাল ফুলে গিয়েছে, জ্বালা ধরা ক্যানসারের অনুঘটকে টাকরার চামড়া চুলকোচ্ছে, তখন কী করবে লোকটা? ওসব গিলে ফেলার মতো একটা বেরসিক অস্বাস্থ্যকর নিদান তো আর তাকে দেওয়া যায় না তাই না! বাড়িতে থাকলে নয় ঘর অপরিষ্কার হবে– সেই ভয়ে বেসিনে আর বেসিন সাদা রঙের হলে বাথরুমে গিয়ে থুঃ করে ফেলে এল, কিন্তু রাস্তায়? রাস্তায় থাকলে কী করবে সেই অসহায় লোকটা? কী আর করবে দু’-আঙুল ঠোঁটের মাঝে প্লেস করে প্লিচ্ নাদে শহরের রাস্তাঘাটে, দেওয়ালে ও জিনিস খালাস করে দেওয়া ছাড়া?
আর করবে না’ই বা কেন? এই যে বাকিরা সারাক্ষণ চমৎকার সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বেড়াচ্ছে তখন? তাদের নিষেধ-টিষেধ করা তো দূরে থাক, আবার অ্যাশট্রেও জুগিয়ে দিচ্ছ হাতের কাছে! কই, কোনও দামি ক্যাফেতে বসে গুটকা চিবুলে তো কেউ ‘হিয়ার ইজ ইওর থুতুদান স্যার’ বসে মগ এগিয়ে দিচ্ছে না! কফি হাউজ থেকে শুরু করে ঝাঁ-চকচকে রেস্তরাঁ বা পানশালা পেরিয়ে মায় এয়ারপোর্টে পর্যন্ত স্মোকিং জোন রাখতে পেরেছ, কিন্তু ‘চিউয়িং জোন’ রাখোনি? যেখানে একসঙ্গে সকল গুটকা, পানমশলা, জর্দাশৌখিন মানুষ একমনে মোবাইল দেখতে দেখতে চকাম চকাম তামাক চিবুবে আর নির্দিষ্টস্থানে পিক ফেলবে। রাখোনি যখন তখন তো বাবা সহ্য করতেই হবে! তাছাড়া এই যে গাড়ি বা বাসের জানলা দিয়ে হাত বের করে যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা, নাক টেনে নাভিমূল থেকে কফ বের করে এনে ক্যাজুয়ালি রাস্তায় নিক্ষেপ করার যে অভ্যাস, সেইবেলা কিছু হয় না? যত দোষ পানমশলায়? ক্লাসিস্ট কোথাকার!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন রোদ্দুর মিত্রর লেখা: রাকেশ শর্মার সাম্যবাদ শুধু পৃথিবীতে আটকে নেই
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আর দেখো বাবা, সুযোগ পেলেই সেটার যথেচ্ছ সদ্ব্যবহার করার কথা ‘মানবপ্রবৃত্তির রচনাবলি’তে একেবারে গোদা, মোটা কালির অক্ষরে লিখে দেওয়া আছে। যখন স্টেশন থেকে শুরু করে শপিং মল– সর্বত্র সিগারেট সেবনে নিষেধাজ্ঞা, তখন তা গুটকা সেবনেও নেই কেন? ট্রেনে, বাসে, অটোতে, সাধারণ দোকানের ভেতর, কোথাও জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে বা অন্য কোনও নেশা করতে করতে ঢুকতে পারবেন? পারবেন না। সিনেমা হলে ভিলেন সিগারেট খাচ্ছে দেখে ক্রেভিংতাড়িত হয়ে আপনি যখন ভাবছেন– ‘আহা গো, বেরিয়েই একটা সিগারেট খাব’– তখন আপনার সহ-দর্শক পাশে বসে, নিমিলীত চক্ষে গুটকা চিবুচ্ছে। এবার ওই চিবুনোর পর যে লালা ওর মুখগহ্বরে সংগৃহিত হবে, তা সে ফেলবে কোথায়? বাথরুমের দেওয়াল, মেঝে, ছাড়া? নিষেধ নেই। মানা নেই। বাধা নেই। পায়ে পড়ে সাধা নেই, রা’ কেড়েছে রাধা নেই। যদিও ‘চেবাও তামাকপক্ষ’ তর্ক তুলে আনতে পারে যে, সিগারেট খেলে আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডের মতো ‘হিস্টোরিক্যালি অ্যাকিউরেট’ ছবির দৃশ্য তুলে এনে সে কথার স্বপক্ষে প্রমাণও দিতে পারে। বলতে পারে সিগারেটে প্যাসিভ স্মোকিং হয়। মারণ ধোঁয়ায় আশপাশের মানুষের কষ্ট হয়। অন্য যে কোনও নেশাতেও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও ঝামেলা সৃষ্টি করার দৃষ্টান্ত তো ভুরি ভুরি। গুটকা বা পানমশলায় ওসব কিছু হয়? জলের মতো সহজ উত্তর– না, মোটেই হয় না! গুটকায় বা পানমশলায় ক্ষতি শুধু দুটো বিষয়ের হয়– স্পেস এবং টাইমের। যিনি ও জিনিস সেবন করছেন তার ক্যানসার জাতীয় মারণ রোগ হয়ে জীবনের টাইমস্প্যান কমে যেতে পারে। সঙ্গে যে স্পেসে উনি রয়েছেন তা ঘা-ঘিনঘিনে, অস্বাস্থ্যকর লালার নানা শেডের লাল প্রলেপে ভরে উঠতে পারে।
তাই এই গরমাগরম ভোটের বাজারে কলকাতা মেট্রোরেলের জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র সরাসরি বলে দিলেন, ‘আর নয় লাল!’। এই হবে খবরের শিরোনাম। ও জিনিসের টোপ সঙ্গে সঙ্গে গিলে কৌতূহলে ল্যা ল্যা করতে করতে ক্লিক করবে আমার মতো কিছু মানুষ আর মূল খবরে লেখা থাকবে– ‘পানের পিক ফেলা নিয়ে নাজেহাল কলকাতা মেট্রোরেল কতৃপক্ষ’। তবে এই শিরোনাম থেকে মূল খবরে যাওয়ার মধ্যবর্তী যে সময়টা, হ্যাঁ ওটাকে নানা নামে ডাকা যায় যেমন ‘সতর্কীকরণ’, ‘এই শহরটা তো আপনারও, একটু পরিষ্কার রাখুন না!’, ‘এইভাবে পানের পিক ফেলা ভীষণ অস্বাস্থ্যকর’, ‘এ কী করছেন দাদা?’, ‘আপনার কিন্তু জরিমানা হতে পারে’ ইত্যাদি, প্রভৃতি ও অন্যান্য। কিন্তু ওই, শেক্সপিয়র নামে কী যায় আসে সূত্র অনুযায়ী– ‘একেবারে ছোট বয়সেই বাইরে থেকে প্রযুক্ত শিক্ষার বল দ্বারা মননের পরিবর্তন না ঘটালে স্থির মানুষ নিশ্চিন্তে চারপাশ নোংরা করবেই আর অস্থির মানুষ তাই দেখে আরও অস্থির হয়ে নিষেধ করতেই থাকবে।’ পুরোটাই বৈজ্ঞানিক ব্যাপার।