উনিশ শতকের শেষভাগ। মশাবাহিত রোগে উজাড় গ্রামকে গ্রাম। কলকাতাতেও তার জবরদস্ত আঁচ। এদিকে পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন-সারিতে দেখা গেল একটি দুরন্ত বিজ্ঞাপন: ‘সর্বজ্বরের মহৌষধ এডওয়ার্ড টনিক’। প্রস্তুকারক সংস্থার নাম ‘বটকৃষ্ণ পাল কেমিষ্ট অ্যান্ড ড্রাগিষ্ট’। ‘বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস’ উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ।
ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়িয়েছে নাকি মশা– একসময় একথা বলা হত বটে। গান-গপ্প-কবিতায় এ-নিয়ে কম কৌতুক হয়নি। এমনকী, কলকাতার পরিচয় দিতে গিয়েও কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখছেন, ‘রেতে মশা দিনে মাছি/ এই নিয়ে কলকেতায় আছি’। বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হিসাবে এখনও স্বমহিমায় বিরাজ করছে মশা। বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া। মানুষ যতই চাঁদের ওপিঠে যাক, এ কলকাতায় মানুষের গায়ে-পিঠে মশা কামড়াবেই কামড়াবে। তবে এ তো গেল হালের কথা।
এককালে ম্যালেরিয়া মানেই সাক্ষাৎ যম-কুস্তি! গ্রাম বা শহর– এই ধারণার বিশেষ বদল হত না। কিন্তু উপায় কী? দেশে তখন ব্রিটিশদের রমরমা। সরকারি নির্দেশে শুরু হল কুইনাইন সরবরাহের কাজ। কিন্তু স্রেফ কুইনাইনে মশার দশা থেকে মুক্তি মিলবে না, তৈরি করতে হবে ওষুধ। আবার এদিকে আয়ুর্বেদ ছাড়া যে বাঙালি অন্য কিছুতেই বিশেষ আগ্রহ দেখায় না, সে কিনা খাবে সাহেবের দেওয়া কুইনাইন! কভি নেহি। তাহলে উপায়? হাল ধরলেন এক বাঙালি ব্যবসায়ী। ঠিকই পড়েছেন। ‘বাঙালি ব্যবসা বোঝে না’– এই কথাটা ভ্যাদভ্যাদে মিথ ছাড়া আর কিছুই না, তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন এক বাঙালিই। কে তিনি?
বটকৃষ্ণ পাল। ছোট করে বললে, বি. কে. পাল। নামটা নিশ্চয়ই শোনা। অন্তত যাঁরা কলকাতার বাসিন্দা, কিংবা শোভাবাজার চত্বরে যাতায়াত রয়েছে, তাঁদের কাছে চেনা তো বটেই। আরে, একটা আস্ত রাস্তার নামই তো তাঁর নামে। শোভাবাজার মেট্রো থেকে নেমে গঙ্গার দিকে সোজা হাঁটাপথ। ট্রামলাইন বরাবর এগোলেই শোভাবাজার স্ট্রিট। কিছুদূর হাঁটলে হাটখোলা পোস্ট অফিস, উল্টোদিকে জোড়াবাগান ট্রাফিক গার্ড। আর কয়েক কদম বাড়ালেই মিলবে বিশাল এক বাড়ি। কলকাতার বুকে এরকম বাড়ির সংখ্যা নেহাতই কম নয়। তবে এই বাড়ির বিশেষত্ব বেজায় আলাদা। কারণে এখানে কোনও সদর দরজাই নেই! বদলে আছে এক ‘ডিসপেনসারি’। আরও খোলসা করে বললে, বাড়ির সদর দরজা আসলে একটা বড়সড় ওষুধের দোকানের প্রবেশদ্বার। উপরে লেখা ‘বট কৃষ্ণ পাল কেমিস্ট ড্রাগিস্ট’। সঙ্গে অজস্র নামপাটা। সাদার মধ্যে নীল হরফে লেখা সেইসব বোর্ডের কোনওটায় রয়েছে দোকানের নাম, আবার কোনওটায় লেখা ‘এডওয়ার্ড টনিক’। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এ-ও কোনও ওষুধ, কিন্তু এডওয়ার্ড মানে তো বিখ্যাত সেই এডওয়ার্ড সাহেব! তাঁর নামে কেন এই ওষুধের নাম? তার ওপর বিজ্ঞাপনের বোর্ডে লেখা ‘সর্বজ্বরের মহৌষধী’! জ্বর হলে সাধারণত যে সমস্ত ওষুধ খাওয়ার চল রয়েছে, তার মধ্যে এই টনিকের নাম তো থাকে না। তবে এ কীসের ওষুধ? উত্তর খোঁজার আগে ইতিহাসের পাতা ওল্টাই, দেখি, এই বটকৃষ্ণ পাল আসলে কে?
১৮৩৫ সাল। এক ব্যবসায়ী পরিবারেই জন্ম হয় বটকৃষ্ণ পালের। আদিবাড়ি হাওড়ার শিবপুর থেকে কিশোর বয়সেই বাবা-মা-কে হারান। চলে আসেন কলকাতায়। পড়াশোনাতেও যতিচিহ্ন পড়ে দ্রুতই। কিন্তু করেকম্মে খেতেও হবে। অতএব মামার মশলার দোকানে নানা খুচরো কাজ। তবে শুধুমাত্র মশলা নয়, দোকানে বিভিন্ন অ্যালোপ্যাথি ওষুধও মজুত রাখতেন সেই মামা। সেই থেকেই ওষুধের প্রতি তাঁর ‘বিশেষ আকর্ষণ’। ব্যবসা ভালই চলতে থাকে। ১৮৫৫ সালে, বছর ২০-এর বটকৃষ্ণ, খুলে ফেলেন একটা আস্ত ওষুধের দোকান। শোনা যায়, ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোম্পানি’-র যাত্রা শুরু সেই থেকেই।
তখনকার দিনে এই দোকানই ছিল ব্রিটিশ কলকাতার প্রথম অ্যালোপ্যাথি ওষুধের দোকান। এমনকী, খাস ব্রিটিশরাও তাঁর কাছেই ওষুধ কিনতে আসতেন। তবে আজকের এই প্রাসাদসম বাড়ি তখন ছিল না। সামনের এই দোকানের আকারও খানিক ছোটই ছিল। ধীরে ধীরে ব্যবসার পসার বাড়তে থাকল। কলকাতার আরও কিছু জায়গায় দোকান খুললেন বটকৃষ্ণ। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ছাড়াও দন্ত চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসার বিভিন্ন সরঞ্জাম পাওয়া যেত সেইসব দোকানে। তবে এর মধ্যেই ঘটল এক অদ্ভুত কাণ্ড! সেই ঘটনার পর থেকেই যেন নিজস্ব পরিচয় পেল এই কোম্পানি।
সে আমলে বহু ব্রিটিশ যুবক কলকাতায় আসত কাজের খোঁজে। অনেক সময় ব্রিটেন থেকেই তাঁদের পাঠানো হত ভারতে। ১৮৮৭ সালে এমনই এক কাজ নিয়ে দেশে এলেন এডওয়ার্ড স্ট্যানলি। শোনা যায়, কোনও এক সরকারি ডিভিশনের সহকারি ইঞ্জিনিয়র হিসাবে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই এডওয়ার্ড সাহেবেরও ওষুধের ব্যাপারে খুঁটিনাটি খবর রাখতেন। সেই সূত্রেই বটকৃষ্ণের দোকানে আনাগোনা শুরু হয় তাঁর। এমনই একদিন বেখেয়ালে বটকৃষ্ণ পালের দোকানে নিজের টাকার থলি ফেলে রেখে চলে যান স্ট্যানলি সাহেব। সবটাই অবশ্য প্রচলিত কাহিনি, কিন্তু বলা হয়, সেই থলিতে যা টাকা ছিল– তার বর্তমান বাজার মূল্য কোটি টাকা। তবে সেই থলি স্ট্যানলি সাহেবকে দায়িত্ব নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বটকৃষ্ণ।
এ ঘটনার সুবাদে দু’জনের হৃদ্যতা আরও বাড়ে। এরপরই নিজের এক ওষুধের ফরমুলা বটকৃষ্ণকে দেন এডওয়ার্ড। সেই ফরমুলা থেকেই বটকৃষ্ণ বানিয়ে ফেলেন ‘এডওয়ার্ড টনিক’। মূলত ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক। মূল উপাদানও কুইনাইন। কিন্তু বটকৃষ্ণ এর মধ্যে এমন কিছু মিশিয়েছিলেন, বা তাঁর নিজস্ব কিছু রদবদলের জেরেই এই ওষুধ হয়ে ওঠে সর্বজ্বরের মহৌষধী। স্রেফ ম্যালেরিয়া নয়, যে কোনও জ্বরের ক্ষেত্রেই কাজে দিত এই টনিক। কোম্পানির তরফে আজও দাবি করা হয়, এই ওষুধ ঠিকমতো খেলে কোনও জ্বর কাবু করতে পারবে না। বর্তমানে দোকানের হাল ধরেছেন বটকৃষ্ণের পঞ্চম প্রজন্ম। খাস কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এখনও যথেষ্ট। সংবাদ এ-ও বলছে, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ হবে ভয়াবহ! ডেঙ্গু মহামারী রূপ নিচ্ছে কি না, তা নিয়ে জোর ভাবনাচিন্তা। ভরসা করে দেখবেন নাকি বটকৃষ্ণ পালকে?