আমাদের দৈনন্দিন গেরস্থালি পেরেকময়। না, বোম্বাগড়ের রানির দাদার মতো পাউরুটিতে পেরেক ঠুকি না। আমারা দেওয়ালে পেরেক ঠুকি। এটা-ওটা টাঙাতে, ঝোলাতে। ফি বছর নতুন ক্যালেন্ডার, বাধানো ছবি আর কত কী! বাতাস লেগে ক্যালেন্ডার দোলে। নোনা দেওয়ালে বৃত্তচাপ আঁকা হয়ে যায়। বাড়ি বদল হলে ওই বৃত্তচাপ দেওয়ালে থেকে যায় পুরনো মায়ার মতো।
‘শ্বশুরবাড়ি গেলাম যদি বসতে দিল পিঁড়ে
আর পিঁড়ের মাথায় পেরেক মারা কাপড় গেল ছিঁড়ে।
মরি হায় রে।’
গ্রাম্য গানের ওই নতুন জামাইয়ের নতুন ধুতির মতো আমাদের গেল নিউ ইয়ারে করা সংকল্পে অবস্থা। ফর্দাফাই! ওজন কমানো হয়নি, ল্যাদ কমানো হয়নি। ট্র্যান্স ফ্যাট, অ্যাডেড সুগার, ব্যাড কর্মা নিত্যদিন হুজ্জত পাকিয়েছে। কোথা দিয়ে বছর চলে গেল নিজের কাছেই ‘কেউ কথা রাখেনি’ অবস্থা। বাড়তি ওই বিবেক পেরেকের খোঁচা, বেয়াড়া সুকতলা থেকে যা কেবলই খোঁচা দিয়ে গেছে। মাঝখান থেকে আবার নতুন বছর এসে গেল।
জুতোর পেরেকের কথায় মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’-র কাবুল বর্ণনা মনে পড়ে গেল। ‘কাবুলের যে কোনও বাজারে শতকরা ত্রিশটি দোকান মুচির। পেশোয়ারের পাঠানরা যদি হপ্তায় একদিন জুতোতে লোহা পোঁতায়, তবে কাবুলে তিনদিন। বেশিরভাগ লোকেরই কাজ-কর্ম নেই— কোনও একটা দোকানে লাফ দিয়ে উঠে বসে দোকানির সঙ্গে আড্ডা জমায়, ততক্ষণ নিচের অথবা সামনের দোকানের একতলায় মুচি পয়জারে গোটা কয়েক লোহা ঠুকে দেয়।’ ট্রেনে চিনেবাদাম বিক্রি হয় ‘টাইম পাস’ নামে। সেকালে পাঠানদের ওই জুতোয় পেরেক ঠোকা ছিল ‘টাইম পাস’। জুতোর পেরেক নিয়ে আরেক চমকপ্রদ কাহিনি বলে গিয়েছেন একদা ‘দেশ’ পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁর ‘একটি পেরেকের কাহিনী’ বইয়ে। বিশুদার জবানিতে। চালচুলোহীন বৈদ্যনাথ কলকাতা এসেছে চাকরির খোঁজে। নিকট আত্মীয় থাকতেও তীব্র আত্মসম্মান-সম্পন্ন বৈদ্যনাথ আশ্রয় নিয়েছে বিশুদার কাছে। উদয়াস্ত চলে চাকরির খোঁজ, খাওয়া জোটে না অধিকাংশ দিন। তবু মুখ ফুটে কাউকে কাউকে কিছু বলে না সে। অবশেষে কাজ পায় ধর্মতলার এক ওষুধ ল্যাবরেটরিতে। মাইনে ২০ টাকা। কালীঘাটে বিশুদার বাসা থেকে পায়ে হেঁটে চাকরি করতে যায় বৈদ্যনাথ। যেটুকু পারে সবটা মাকে মানি অর্ডার করে পাঠায়। কিন্তু বাদ সাধল জুতোর পেরেক। পায়ে এমন ক্ষত হল যে, তা থেকে টিটেনাস, গ্যাংগ্রিন হয়ে প্রাণ সংশয়। নিদেনপক্ষে পা কেটে বাদ তো দিতেই হবে। কীভাবে বিধান রায়ের আশ্চর্য প্রতিভা ও চিকিৎসাশক্তির বলে পা বাদ না দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠল বৈদ্যনাথ, তারই মর্মস্পর্শী গল্প শুনিয়েছেন সাগরময় ঘোষ। বৈদ্যনাথের ল্যাবরেটরির চাকরি চলে যাওয়া আর বিধান রায়ের অনুগ্রহে হাসপাতালে ওয়ার্ডবয়ের চাকরি পাওয়া, সে এক অন্য মানবিকতার গল্প।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: একটাই উপন্যাস, লিখছেন ১২ জন!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পদাবলি সাহিত্যে রাধার অভিসারের প্রস্তুতির কথা বলা আছে। অন্ধকার রাত, পিচ্ছিল কণ্টকাকীর্ণ পথ, নূপুরের শব্দ শুনে নন্দিনীর বাগড়া, এইসব কিছু কনটিনজেন্সি মুকাবিলার জন্য রাধিকা উঠোনে জল ঢেলে পিছল করে তাতে কাঁটা পুঁতে চোখ বেঁধে নূপুরে কাপড় জড়িয়ে হাঁটা প্র্যাকটিস করছেন। হতেই পারে কীলক, অর্থাৎ পেরেক কখন কখন কাঁটার প্রক্সি দিত রাধিকার প্র্যাকটিস সেশনে।
মরচেপড়া পেরেক নিয়ে বুদ্ধদেব বসু কবিতা লিখেছেন, ‘পড়ে ছিল মরচেপড়া পেরেক, পচা কাঠের টুকরো থেকে বেড়িয়ে।/ সেদিন আশ্বিনের সকাল, এক বুড়ি ঘুঁটে দিচ্ছে দেওয়ালে,/ বাতাসে দুলছে লাল পদ্মের কুঁড়ি– আমাকে ইশারা করে ডাকল,/ সেই মরচেপড়া পেরেক, পচা কাঠের টুকরো থেকে বেড়িয়ে।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জুতোর পেরেকের কথায় মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’-র কাবুল বর্ণনা মনে পড়ে গেল। ‘কাবুলের যে কোনও বাজারে শতকরা ত্রিশটি দোকান মুচির। পেশোয়ারের পাঠানরা যদি হপ্তায় একদিন জুতোতে লোহা পোঁতায়, তবে কাবুলে তিনদিন। বেশিরভাগ লোকেরই কাজ-কর্ম নেই– কোনও একটা দোকানে লাফ দিয়ে উঠে বসে দোকানির সঙ্গে আড্ডা জমায়, ততক্ষণ নিচের অথবা সামনের দোকানের একতলায় মুচি পয়জারে গোটা কয়েক লোহা ঠুকে দেয়।’ ট্রেনে চিনেবাদাম বিক্রি হয় ‘টাইম পাস’ নামে। সেকালে পাঠানদের ওই জুতোয় পেরেক ঠোকা ছিল ‘টাইম পাস’।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
মানবের পরিত্রাণে যিশু পরেছিলেন কাঁটার মুকুট। বিদ্ধ হয়েছিলেন ক্রুশে। তাঁকে গাঁথা হয়েছিল ওই পেরেক দিয়ে। মধ্যযুগীয় অত্যাচারের বিভিন্ন পেরেক ও গজালের বিচিত্র সব ভূমিকা ছিল।
পিতামহ ভীষ্মর শরশয্যার কথা সবাই জানি। বিজ্ঞান বলে, আদতে পেরেকের বিছানায় শোয়া কোনও ব্যাপারই না। শরীরের ওজন সমানভাবে ভাগ হয়ে গেলে পেরেক ঢুকে রক্তারক্তি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
আমদের ছোটবেলায় বাগাডুলি খেলার চল ছিল। এখন টাচফোনের যুগে সেসব খেলা উঠে গেছে। কানাউঁচু কাঠের বোর্ডের মাথার দিকটা ছিল অর্ধবৃত্তাকার। কাঠি দিয়ে লোহার বল চালতে হত পয়েন্টের জন্য। বোর্ডে থাকত ছোট ছোট পেরেক পোঁতা ঘর, নানা ঘরের নানা পয়েন্ট। সেইসব ঘরে লোহার বল আটকালে মিলত পয়েন্ট। পাড়ার হাইজাম্প কিংবা পোল ভল্টেও দু’দিকে দুটো বাঁশের খুঁটিতে সারি সারি পেরেক পুঁতে দড়ি দিয়ে উচ্চতা কমানো বাড়ানো হত।
আমাদের দৈনন্দিন গেরস্থালি পেরেকময়। না, বোম্বাগড়ের রানির দাদার মতো পাউরুটিতে পেরেক ঠুকি না। আমারা দেওয়ালে পেরেক ঠুকি। এটা-ওটা টাঙাতে, ঝোলাতে। ফি বছর নতুন ক্যালেন্ডার, বাধানো ছবি আর কত কী! বাতাস লেগে ক্যালেন্ডার দোলে। নোনা দেওয়ালে বৃত্তচাপ আঁকা হয়ে যায়। বাড়ি বদল হলে ওই বৃত্তচাপ দেওয়ালে থেকে যায় পুরনো মায়ার মতো।