মেয়েটি ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে, কিন্তু মেয়েটির পরিবার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না । গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ের সঙ্গে অ-তফশিলভুক্ত হলেও আদিবাসী ছেলের সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর পরিকল্পনা যেন মানা যায় না। লাল মাটির দেশ মেয়েটিকে আপন করে নিলেও শহর আপন করেনি। চলছিল টানাপোড়েন। এই সম্পর্ককে কী করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, কীভাবে সব বাঁধা একসঙ্গে পেরিয়ে যাওয়া যায়, এই চিন্তায় দিন কাটছিল। এই টানাপোড়েনের মাঝেই কিছু সময় পার হলে শেষমেশ তারা মত-অমত মাথায় না রেখে জীবনসঙ্গী হিসাবে পথচলা শুরু করে দিল। কেউ সম্মত হল, কেউ হল না।
কর্মসূত্রে অরুণাচল প্রদেশের নীল পাহাড়ে বসবাসকারী এক উচ্চবর্ণের দম্পতির বংশধর এক কন্যা আজকের নায়িকা।
গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাঙালি মেয়ে পাহাড়ি আদিবাসী পরিবেশে বয়ঃসন্ধিকাল কাটিয়ে উচ্চশিক্ষার তাগিদে মা-বাবা-ভাইকে ওই পাহাড়-দেশে ফেলে রেখেই যেতে বাধ্য হল এক বিশাল মহানগরীতে। যা কিনা তার কাছে এক অবাক-করা, অদ্ভুত ও জটিলতায় ভরা অচেনা দেশ। সেখানে এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়েই সম্পূর্ণ অপরিচিত, অপ্রত্যাশিত এক পরিবেশে বাবা-মা-ভাইকে নীল পাহাড় ঘেরা সূর্যোদয়ের দেশে ছেড়ে একাকিত্ব, অসহায়তা আর এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে অধিকাংশ সময় মনমরা হয়েই থাকত। দু’চোখ বেয়ে তার অজান্তে জল ঝরে পড়ত। তারই তিরিশজন সহপাঠীর মধ্যে একটি ছেলে ছোটনাগপুর উপত্যকার শেষাংশের এক গ্রাম থেকে স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে না পড়েই সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা। লালমাটির দেশের ছেলে সে। মাটির সঙ্গে বড় হয়েছিল, শিমুল-পলাশের মধ্যে। সেও শহর চেনে না, রাস্তা চেনে না মহানগরীর। এই অচেনা শহরেই গোঁড়া ব্রাক্ষণবাড়ির মেয়ের সঙ্গে প্রেম হল আদিবাসী ছেলের। কেউ মেনে নিল, কেউ মেনে নিল না এই সম্পর্ক। মেনে নিল না পরিবার। এ শহর, সে শহর ঘুরে তারা একসঙ্গে থাকারই চেষ্টা করতে লাগল। যদি ওদের মেনে নেয় কোনও শহর।
…………………………………………
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে মেয়েটি আরও উচ্চতর শিক্ষার জন্য রাজধানী চলে গেল। সে সময়টা খুব কঠিন মনে হচ্ছিল দু’জনের। ইতিমধ্যে মেয়েটি ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে, কিন্তু মেয়েটির পরিবার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না । গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ের সঙ্গে অ-তফশিলভুক্ত হলেও আদিবাসী ছেলের সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর পরিকল্পনা যেন মানা যায় না।
…………………………………………
যাই হোক, গল্পে ফিরি। মেয়েটি যত শান্ত, ছেলেটি ততই চঞ্চল। ছেলেটি গ্রাম থেকে বিশাল মহানগরীতে এসে শুধু বন্ধুদের সঙ্গে পুরো মহানগরী চষে বেড়ানোর ফলে শহুরে পরিবেশ ও সংস্কৃতি কিছুটা চিনতে পারল। ওদিকে মেয়েটি সবসময় মনমরা হয়েই থাকে। পাহাড়ি জনজাতিদের সংস্কৃতিতে শৈশব, কৈশোর পার করে এই শহুরে সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে যেমন কষ্ট হচ্ছিল, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতার জালে জড়িয়ে পড়ছিল। সহপাঠী ওই দামাল ছেলেটির নজর এড়ায়নি মেয়েটির অহেতুক শান্ত থাকা, উদাসীন হয়ে থাকা, মনমরা হয়ে থাকা। গ্রামের বাড়ির নানা বিধিনিষেধ না থাকার ফলে ছেলেটি এখন উদ্দাম, চঞ্চল ও স্বাধীনভাবে দিন কাটানোর আনন্দে মাতোয়ারা। সে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটির পাশে।
মেয়েটিকে তার নিঃসঙ্গতার ছায়া থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তুলে নিল নিজের হাতে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে, কখনও বা ফাঁকি দিয়েও, একটু মেলামেশা, নানা কথাবার্তা, গল্পগুজব, এখানে সেখানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রকল্প যেমন বাস্তবায়িত হতে চলল, একই সঙ্গে দু’জনে দু’জনের প্রতি এক বিশেষ টান অনুভব করতে লাগল, বন্ধুত্ব গাঢ় হতে লাগল, যাকে আমরা সোজা বাংলায় ‘ভালোবাসা বলে থাকি। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। একসময় এক ভ্যালেন্টাইন ডে-তে ফুল দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে মেয়েটি আরও উচ্চতর শিক্ষার জন্য রাজধানী চলে গেল। সে সময়টা খুব কঠিন মনে হচ্ছিল দু’জনের। ইতিমধ্যে মেয়েটি ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে, কিন্তু মেয়েটির পরিবার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না । গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ের সঙ্গে অ-তফশিলভুক্ত হলেও আদিবাসী ছেলের সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর পরিকল্পনা যেন মানা যায় না। লাল মাটির দেশ মেয়েটিকে আপন করে নিলেও শহর আপন করেনি। চলছিল টানাপোড়েন। এই সম্পর্ককে কী করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, কীভাবে সব বাধা একসঙ্গে পেরিয়ে যাওয়া যায়, এই চিন্তায় দিন কাটছিল। এই টানাপোড়েনের মাঝেই কিছু সময় পার হলে শেষমেশ তারা মত-অমত মাথায় না রেখে জীবনসঙ্গী হিসাবে পথচলা শুরু করে দিল। কেউ সম্মত হল, কেউ হল না।
এখন তারা সুখী দম্পতি। চার বছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে এক নির্ভেজাল ভালোবাসার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আনন্দে, সুখে দিন কাটাচ্ছে। সার্থক ভালোবাসা কোনও জাতি-ধর্ম মানে না, তা তারা প্রমাণ করতে পেরেছে। সার্থক ভালোবাসার জয় হয়েছে। আজও, আমি অনিকেত মাহাতো আর পিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য একসঙ্গে আছি।