রোনাল্ড ব্যোমান যেমন তাঁর বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন বর্ধমানের ছবি, মিলিয়ে দেখে নিতে চেয়েছিলেন সবই কি আগের মতো আছে? গল্পের মতো? সেরকমই দেশভাগের পরেও ঠাকুরমা-দিদিমারা যত্ন করে রেখে দেন বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ভিটের ছবি। কখনও তার উত্তরসূরির হাতে যদি তুলে দেওয়া যায়! আজকের মুঠো ফোনের দুনিয়ায় ভিডিও কল করে দেখানো যায় সেই বাসা, গাছপালা, কতটা এক রকম আছে তারা? এমন বিষয় নিয়ে সাহিত্য বা সিনেমা রচিত হয়েছে। দক্ষিণারঞ্জন বসুর ছেড়ে আসা গ্রাম বা সাদাত হোসেন মান্টোর গল্পে দেশভাগের স্মৃতি বারেবারে ফিরে আসে।
অস্কারে মনোনীত প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেত্রী অলিভিয়া কোলম্যানকে নিয়ে কিছুদিন আগেই একটি ডকুমেন্টারি ছবি নির্মিত হয়। কয়েকটি পর্বের এই ডকুসিরিজের উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের বংশতালিকা এবং পূর্বসূরিদের ইতিহাস ঘেঁটে পৌঁছে যাওয়া নিজের অস্তিত্বের শিকড়ে। অর্থাৎ, সাত পুরুষ আগে অন্য মহাদেশের কোনও ইতিহাস বা ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজের পরিবারের গভীর সম্পর্ক আছে কি না, সেই খোঁজ করতে সাহায্য করেন সমাজবিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীরা। কোলম্যান জানতে পারেন, তাঁর ছয় পুরুষ আগের প্রপিতামহ ছিলেন রিচার্ড ক্যাম্পবেল, যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে লন্ডন ও কলকাতার মধ্যে যোগসাধন করতেন। সেই সূত্রেই বিহারে থাকাকালীন এক ভারতীয় রমণীর সঙ্গে সম্পর্কে থাকাকালীন তার পুত্রসন্তান হয়। মানে কোলম্যান যে আসলে ইন্টাররেসিয়াল পরিবারের সন্তান এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত, সেটাই নিশ্চিত করা গেছে তৎকালীন ডায়রি, সরকারি নথি, সংবাদপত্রের তথ্য এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্র থেকে।
এবার আসা যাক রোনাল্ড ব্যোমান প্রসঙ্গে। যদিও এক্ষেত্রে সাত পুরুষ আগে যেতে হবে না, রোনাল্ডের বাবা কার্লিস ব্যোম্যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্ধমানের পানাগড়ে একটি সেনা ছাউনিতে ছিলেন দীর্ঘদিন। ইতিহাস বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকা থেকে প্রচুর সৈন্য বাংলার নানা জায়গায় আসতে শুরু করে। আজকের ক্রিসমাসের প্রধান আকর্ষণ কলকাতার ব্যো-বারাক বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার সৈন্যদের কথা মাথায় রেখেই বানানো হয়েছিল। খুব ছোট থেকেই রোনাল্ড তাঁর বাবার কাছে ভারতের গল্প শুনতেন। বর্ধমান রাজবাড়ি, তার আশপাশের জায়গার সঙ্গে গল্পের মাধ্যমেই তাঁর পরিচয়। ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে এক্ষেত্রে শুধু পারিবারিক ইতিহাস নয়, ঔপনিবেশিক সময়কালের বিবৃতি, যুদ্ধের ইতিহাস, সৈন্যদের জীবন এবং আপামর একটি শতকের ইতিহাসও নির্মাণ করা সম্ভব।
কেবলমাত্র সরকারি নথি বা হার্ড আর্কাইভ নয়, ব্যক্তিগত স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে যে কোনও সময়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা যেতে পারে। তাতে অবশ্যই চিঠি, আত্মজীবনী বা ডায়েরির মতো সূত্র ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। রোনাল্ডের বাবা ভারতে থাকাকালীন বর্ধমান রাজবাড়িতে আমন্ত্রণ পান, এমনকী, সেখানে তোলা কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবিও আমেরিকা থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন রোনাল্ড। প্রশ্ন জাগে, সেই ছবিগুলির সঙ্গে বর্তমান বর্ধমান রাজবাড়ির কতটা মিল আছে? ছবি, ডায়েরি, স্মৃতিকথা, চিঠি– এই সবকিছুর মধ্যে ইতিহাস যেভাবে ধরা দেয়, পাঁচ দশক পর সেই জায়গাগুলো তো আর একরকম থাকে না। আমেরিকার মতো ঝাঁ-চকচকে দেশের সৈন্য-পুত্রর বর্ধমানে আসা এবং বাবাকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার গল্প শুনে মনে হয়, বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে ব্যক্তিমানুষের জীবনও পাল্টে দিয়েছিল!
শুধু বিশ্বযুদ্ধ কেন, অলিভিয়া কোলম্যানের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসন বা আমাদের মতো পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে দেশভাগ; এই সুবিশাল ঐতিহাসিক পর্বগুলো কীভাবে পারিবারিক স্মৃতিকে খণ্ড খণ্ড করে দেশ, কাল, স্থানে ভাগ করে দেয়। তারপর আমরা খুঁজতে থাকি কোথায় আমার দেশ, কোনটা আমার সময়। রোনাল্ড ব্যোমান যেমন তাঁর বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন বর্ধমানের ছবি, মিলিয়ে দেখে নিতে চেয়েছিলেন সবই কি আগের মতো আছে? গল্পের মতো? সেরকমই দেশভাগের পরেও ঠাকুরমা-দিদিমারা যত্ন করে রেখে দেন বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া ভিটের ছবি। কখনও তার উত্তরসূরির হাতে যদি তুলে দেওয়া যায়! আজকের মুঠোফোনের দুনিয়ায় ভিডিও কল করে দেখানো যায় সেই বাসা, গাছপালা, কতটা এক রকম আছে তারা? এমন বিষয় নিয়ে সাহিত্য বা সিনেমা রচিত হয়েছে। দক্ষিণারঞ্জন বসুর ছেড়ে আসা গ্রাম বা সাদাত হোসেন মান্টোর গল্পে দেশভাগের স্মৃতি বারেবারে ফিরে আসে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দৌলতে তৈরি হওয়া ১৯৪৭ পার্টিশন আর্কাইভ (1947 partition archive) বিগত অনেক বছর ধরে ব্যক্তিগত স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাস নির্মাণের চেষ্টা করছে। আমরা যারা সেখানে ইন্টারভিউ নিয়েছি, উদ্বাস্তু মানুষরা যখন তাদের পুরনো বাড়ির ছবি দেখাতেন, সেগুলো নিয়ে উজ্জ্বল চোখে বর্ণনা করতেন হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা, মনে হত ব্যক্তিগত পারিবারিক ঐতিহ্য এভাবেই বোধ হয় ইতিহাসের মেটা ন্যারেটিভ তৈরি করে। পার্থক্য এটুকুই যে, ব্রিটিশ অভিনেত্রী কোলম্যান বা আমেরিকার রোনাল্ডের মতো সেই স্মৃতিচারণা মধুর নয়, তাতে মিশে আছে রক্ত, কান্না, ধর্ষণ এবং দারিদ্রের মতো বিষয়।
তবে বিশ্বযুদ্ধ হোক বা দেশভাগ, আশ্চর্যের কথা হল, ব্যক্তিগত স্মৃতি, তা সে মধুর হোক বা মেদুর , ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ‘মাইক্রো হিস্ট্রি’ বলে যে ধারাটি বিগত কয়েক দশকে প্রবর্তিত হয়েছে ( Carlo ginzburg-এর সৌজন্যে) সেখানে ব্যক্তিগত বা একজন লোকের বয়ান থেকেও যে ইতিহাস নির্মাণ করা যায়, এমনই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। সেই সূত্রে উল্লেখ্য, ভারতে সরকারের বিদেশমন্ত্রক-এর ( ministry of external affairs ) একটি স্কিম হল ‘tracing the roots’, এই স্কিমে বলা হয়েছে, ভারতের বাইরে থাকা কোনও ব্যক্তি যদি মনে করেন তার ইন্ডিয়ান রুট খুঁজে বের করবেন, তাহলে ৩০,০০০ বিদেশি মুদ্রা দিয়ে এই স্কিমের আওতায় আসা সম্ভব। নির্দিষ্ট এজেন্সি সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে উক্ত ব্যক্তির যাতে পারিবারিক ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে যদি একান্তই কোন সুফল না পাওয়া যায়, তাহলে ভারত সরকার ২০,০০০ টাকা ফেরত দেবে।
টুরিজম, হেরিটেজ বা হিস্ট্রি ওয়াক আজকাল এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, দেশভাগ কলকাতা, দিল্লি বা মুম্বইয়ের মতো শহরের ইতিহাসকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে, সেখানে ‘tracing the roots’-এর মতো স্কিম সত্যি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়।
সম্প্রতি ‘routledge’ নামক একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা থেকে ‘ancestral Heritage tourism’ নামে একটি নতুন গবেষণামূলক প্রবন্ধ বের হয়। সুইডেনের এক লেখক অ্যানচেস্ট্রাল হোমল্যান্ড বা পূর্বজদের হারিয়ে যাওয়া বাড়ির খোঁজকে যুক্ত করেছেন পর্যটনশিল্পের সঙ্গে। এখানে বলা হচ্ছে, ঐতিহ্য কেবলমাত্র একটি বাড়ি, স্থাপত্য বা ধরাছোঁয়ার জিনিস নয়, বরং এটি স্মৃতি, পারিবারিক মেলামেশা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গেও জড়িত। তাই পর্যটনশিল্পের বাণিজ্যিক দিককে যদি ইতিহাস বা পারিবারিক ঐতিহ্য খোঁজের সঙ্গে মেলানো যায়, তাতে ক্ষতি কী? হেরিটেজ তকমা পেলে রক্ষণাবেক্ষণ করার সুবিধা রয়েছে। ঠিক যেমন ব্যোমানের বাবার বর্ণিত ‘ম্যাহতাব মানঝিল’ (বর্ধমান রাজবাড়ি) কয়েক বছর আগে হেরিটেজ বিল্ডিং বলে অভিহিত হয়েছে।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….