এলিয়ট-এর ১৯২২-এ লেখা ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’-এর ১৪ বছর পরে, ১৯৩৬-এ, ৭৪ বছরের রবীন্দ্রনাথ লিখলেন বটে ‘রোদন-ভরা এ বসন্ত সখী’, কিন্তু এক ইঞ্চি বেরতে পারলেন না বাঙালির চেনা রোমান্টিকতা থেকে। বরং বলা যায় তার সমস্ত গানটি জুড়ে যেন সেই প্রাচীন পদাবলির বাতাবরণ: যেখানে বিরহবেদনা রাঙিয়ে উঠছে কিংশুকরক্তিমরাগে, যেখানে কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা পরেছে নব পত্রালিকা, যেখানে কুঞ্জবনের সমস্ত মুকুল যত আবরণবন্ধন ছিঁড়তে চাইছে।
ব্রাউনিং, ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং, মনেপ্রাণে জেগে উঠলেন ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে, এপ্রিলের আগমনে। পৃথিবী শুনল তাঁর উল্লাসের উচ্চারণ: “ও! টু বি ইন ইংল্যান্ড নাউ দ্যাট এপ্রিল’স দেয়ার!” এপ্রিল মাস মানে ইংল্যান্ডে শুরু হল শীতের প্রস্থানপর্ব। গলছে বরফ। তুষারের উপর চিকচিক করছে নতুন রোদ্দুর। শীতের আবরণে, তুষারের তলায়, এতদিন ঘুমিয়ে ছিল প্রাণ। মাটির তলায় শিকড়ে-বাকড়ে নিদ্রিত ছিল অনুভব। এবার যাচ্ছে শীত। ফিরছে প্রাণের স্পন্দন। ফিরছে অনুভবের জাগৃতি। ফিরছে ফুল ফোটার, পাখির গানের, চারিদিকে সুন্দরের সমারোহের সম্ভাবনা। ফিরছে অপেক্ষা, আশা, আনন্দ। ফিরছে উষ্ণতা ও আলোর প্রতিশ্রুত প্রততি।
এপ্রিলের শুরুতেই এই হল রবার্ট ব্রাউনিংয়ের বসন্তবন্দনার রোমান্টিক সারাৎসার, তাঁর অনন্য নস্ট্যালজিক লিরিক ‘হোম থটস্ ফ্রম অ্যাব্রড’-এ! ব্রাউনিংয়ের এই মেদুর রোমান্টিকতা ১৮৪৫-এর। ঠিক ৭৭ বছর পরে, ১৯২২-এ, তাঁর ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কাব্যের একেবারে প্রথম পংক্তিতেই এই রোমান্টিক মধুর মেদুরতার বেলুনে পিন ফোটালেন টমাস স্টার্ন এলিয়ট: ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’। বলা যেতে পারে এলিয়ট-এর এই একটি পংক্তির অবিকল্প অভিঘাতে সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হল নতুন কাব্যদর্শন, শেষ হল রোমান্টিকতার, জন্মাল নবধারার কবিতা ও কাব্যশৈলী!
এলিয়ট-এর ১৯২২-এ লেখা ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’-এর ১৪ বছর পরে, ১৯৩৬-এ, ৭৪ বছরের রবীন্দ্রনাথ লিখলেন বটে ‘রোদন-ভরা এ বসন্ত সখী’, কিন্তু এক ইঞ্চি বেরতে পারলেন না বাঙালির চেনা রোমান্টিকতা থেকে। বরং বলা যায় তার সমস্ত গানটি জুড়ে যেন সেই প্রাচীন পদাবলির বাতাবরণ: যেখানে বিরহবেদনা রাঙিয়ে উঠছে কিংশুকরক্তিমরাগে, যেখানে কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা পরেছে নব পত্রালিকা, যেখানে কুঞ্জবনের সমস্ত মুকুল যত আবরণবন্ধন ছিঁড়তে চাইছে। একথা ঠিক, এই একটি লাইনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্তের রোদনে নিয়ে এসেছেন তীব্র সেক্সুয়ালিটি, আমাদের মনে পড়ে যায় তাঁর গল্পের চরিত্র এলাকে, যে ছাদের অন্ধকারে প্রেমিকের সামনে তার বুকের সমস্ত আড়াল উপড়ে ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ১৯৩৬-এও আসেনি সেই আধুনিক ভাবনার বিস্ফোরণ, যা ঘটিয়েছেন এলিয়ট ১৪ বছর আগে।
রবীন্দ্রনাথের ‘রোদনভরা বসন্ত’ আর এলিয়ট-এর ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’ এক বস্তু নয়। আকাশপাতাল পার্থক্য। মূল পার্থক্য, রবীন্দ্রনাথ আপাদমস্তক রোমান্টিক আবেগ ও তাড়নায় চুপচুপে হয়ে ডুবে আছেন। তাঁর যৌনতার প্রকাশেও নবপত্রালিকার ঢাকনা! কুঞ্জবনের সমস্ত মুকুল, অর্থাৎ শরীরের সমস্ত ডাক, নিঃসঙ্গ বসন্তে সব আবরণ ছিন্ন করে বেরতে চাইছে। কিন্তু ছিঁড়তে পারছে কি? যেভাবে হাজার ক্যামেরার সামনে বুকের ঢাকনা ছিঁড়ে ‘পয়জন্’ ঢেলে সেই সুরভির উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন এলিজাবেথ টেলর!
এলিয়ট-এর বসন্তে প্রেম নেই। তা-ই বিরহও নেই। পরিবর্তে আছে এপ্রিল-বিরোধী এমন ভাব ও ভাষা যা কখনও কোনও কবি এইভাবে নাগালে পাননি:
এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস। কারণ মৃত মাটিতেও এই মাস
ফোটাচ্ছে লাইল্যাকস্। ভালো নয়, ভালো নয়, প্রাণের
এই প্রত্যাবর্তন। কারণ প্রাণ-ই মেশায় স্মৃতি ও
বাসনা। এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস, কারণ এপ্রিল ফিরিয়ে
আনে প্রাণ, আর প্রাণ মরা শিকড়ে বসন্তের বৃষ্টি দিয়ে
ধরায় স্পন্দন। শীতই তো বেশ ছিল। কারণ তুষার
চাপা দিয়ে শীত আমাদের উষ্ণ রেখেছিল। শীত
সমস্ত মাটিকে স্মৃতিচ্ছন্ন তুষারে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল।
প্রাণকে ফিরিয়ে এনে, ঘুম ভাঙিয়ে, এপ্রিল বড় সর্বনাশ করল আমাদের।
কী দেখছি আমরা চারপাশে?
১০২ বছর আগে এপ্রিলের সর্বনাশের কথা, যন্ত্রণার কথা লিখে গেছেন এলিয়ট। আজও আমাদের চারধারে সেই এপ্রিল কী ভয়ংকর সত্যি:
মানবের সন্তান, কী দেখছ তুমি এই মুহূর্তে বসন্তের
প্রারম্ভে তোমার চারিদিকে: ‘আ হিপ অফ
ব্রোকেন ইমেজেস’, যেখানে জ্বলন্ত সূর্য নেমে আসছে
নিরন্তর, আর যেখানে মৃত বৃক্ষেরা দান করে না কোনও
ছায়ার আশ্রয়। এমন কি ঝিঁঝির ডাকেও নেই
মুহূর্তের রেহাই। শুকনো পাথরে কান পেতে শোনো,
অন্তরে নেই জলের শব্দ। দুটি ছায়া এখনও জ্যান্ত আছে বটে এই
মৃত বসন্তেও। একটি ছায়া রোদে হাঁটে তোমার
পিছন পিছন। আর অন্য ছায়াটি ভর সন্ধ্যায়
খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তোমার মোকাবিলা করবে বলে।
বরং আমি তোমাকে দেখাতে পারি এমন
বসন্তে আমার একমুঠো ধুলোয় বিশুদ্ধ ত্রাস। ‘আই
উইল শো ইউ ফিয়ার ইন আ হ্যান্ডফুল অফ ডাস্ট!’
এই বিশুদ্ধ ভয়ের মুঠো-মুঠো স্বাদ কি আমরা সত্যি পাচ্ছি না এই বসন্তে? আমি চারপাশের চেনা মানুষগুলোর দিকে তাকাই। সবাই গোল হয়ে একই জায়গায় হাঁটছে। ‘আই সি ক্রাউডস্ অফ পিপল্, ওয়াকিং রাউন্ড ইন আ রিং। আমাদের শহরটা কি ‘আনরিয়েল সিটি’! মানুষ, দলে দলে মানুষ হাঁটছে লন্ডন ব্রিজে (পড়ুন, হাওড়া ব্রিজ)।
‘আই হ্যাড নট থট ডেথ হ্যাড আনডান সো মেনি।’ আমি ভাবিনি মৃত্যু শেষ করেছে এত মানুষ!
এইবার এলিয়ট এলেন তাঁর নিষ্ঠুরতম বসন্তের একেবারে অন্তর কথায়। আমরা কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, শুধু ভেবে দেখুন। এলিয়ট ভাবতে পেরেছিলন ১৯২২-এ। বুঝবেন, কোথায় রবীন্দ্রনাথের ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ আর কোথায় এলিয়ট-এর ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’। আমরা কি প্রতিদিন দেখছি না চোখের সামনে মৃত্যুমিছিল? মনে কি হচ্ছে না, গাছে গাছে ফুটছে শবের ফুল!
এবার শুনুন ১০২ বছর আগে টি.এস.এলিয়ট-এর অমোঘ প্রশ্ন:
‘That Corpose you planted last year
in your garden,
Has it begun to sprout? Will it
bloom this year?’
সেই যে তুমি শবদেহটি তোমার বাগানে গত বছর রোপন করেছিলে, তাতে কি মুকুল ধরেছে? কী মনে হয় তোমার? শবের সেই গাছ মঞ্জরিত হবে তো এই বসন্তে? ঝুলবে তো থরে থরে শব সেই মঞ্জরিত বৃক্ষে?
পাশে রাখুন, রবীন্দ্রনাথের:
কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা,
সারা দিন-রজনী অনিমিখা, কার পথ চেয়ে জাগে।
তফাতটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে? প্রয়োজন কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো, কার বসন্ত আমাদের একেবারে প্রতিদিনের বাস্তব?