আজকাল মনে হয় রাজাকে সংস্কার, ভয় ও অন্যান্য পার্থিব কারণে উলঙ্গ না-বলা গেলেও ধ্রুপদি হিসেবে স্বীকৃত পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার অবস্থার দিকে তাকিয়ে একটি কথা বলাই চলে– আমাদের এই আ-মরি বাংলা ভাষার মাথায় মুকুট আছে কিন্তু শরীরের তলাটিতে বুঝি কিছু নেই। মুকুটের দিকে তাকিয়ে আমরা বলছি ‘শাবাশ, শাবাশ!’ কিন্তু তলার দিকে তাকাচ্ছি না। তাকাতে দেওয়া হচ্ছে না, তাকালেও তা-নিয়ে কথা বলা নিষেধ।
প্রচ্ছদ অর্ঘ্য চৌধুরী
ফেব্রুয়ারি মাস। আন্তর্জাতিক ভাষা-দিবসের মাস। বাংলা ভাষা নিয়ে ‘মরশুমি’-ভাবনার মাস। ভাষার কথা ভাবতে গিয়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’-এর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল এ-কথাও যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘আনন্দমেলা’য় এক সময় ছাপা হত বাংলা ও ইংরেজি ভাষা-বিষয়ক সহজশিক্ষার উপকরণ ‘বাংলা বলো’ আর ‘সহজে ইংরেজি’। নীরেন্দ্রনাথ তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’ ধারাবাহিক ভাবে খবরের কাগজের পাতায় লিখতেন। সাধারণ বাঙালি সমাজের বড় ও ছোটরা সে-সময় এ-জাতীয় যত্নে লেখা, সহজবোধ্য, মনটানা বিষয়গুলি পড়ে ভাষার ঘর-সংসারের অনেক কিছু শিখতেন, ভাবতেন। যখন এসব কাণ্ডকারখানা চলছিল তখন কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার আওতায় থাকা বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। যে পরিবারগুলি শিক্ষার আওতার বাইরে ছিলেন তাঁদের শিক্ষার আওতায় আনার কাজ চলছিল– এই দু’-পক্ষকে বিদ্যালয়স্তরে কীভাবে সহজে পাশাপাশি রেখে বাংলা ভাষার মর্যাদা বজায় রাখা যায়, অন্য ভাষার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক না-গড়ে এবং ইংরেজি শিখে বাংলা ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে শক্তিশালী করা যায় সে-কাজ পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যাব্যবস্থায় সুষ্ঠুভাবে করা গেল না বলেই ক্রমে বাংলা ভাষা পরিসরটি মর্যাদাহীন আত্মবিলাপে ভুগতে শুরু করল।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ বহুশ্রুত ও বহুপঠিত কবিতা। এক সময় কবিতাটি মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী কবিতাটি পড়ত, উত্তর লিখত। রাজার কাপড় নেই অথচ কেউ সে-কথা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। বলতে কেন পারছে না তার কারণ কবি কবিতায় লিখেছিলেন।
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।
আজকাল মনে হয় রাজাকে সংস্কার, ভয় ও অন্যান্য পার্থিব কারণে উলঙ্গ না-বলা গেলেও ধ্রুপদি হিসেবে স্বীকৃত পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার অবস্থার দিকে তাকিয়ে একটি কথা বলাই চলে– আমাদের এই আ-মরি বাংলা ভাষার মাথায় মুকুট আছে কিন্তু শরীরের তলাটিতে বুঝি কিছু নেই। মুকুটের দিকে তাকিয়ে আমরা বলছি ‘শাবাশ, শাবাশ!’ কিন্তু তলার দিকে তাকাচ্ছি না। তাকাতে দেওয়া হচ্ছে না, তাকালেও তা-নিয়ে কথা বলা নিষেধ।
বাংলা ভাষা বা যে-কোনও ভাষার ভিত্তি দৃঢ় করতে গেলে বিদ্যালয় স্তরে সেই ভাষাটির প্রয়োগ ও ব্যবহারের উপর নজর দিতে হয়। গণপরিসরে সেই ভাষাটি কীভাবে বিস্তার লাভ করে তা ভাবতে হয় এমনকী, এই ক্ষেত্র দু’টি দৃঢ় হলে ভাবতে হয় সাধারণের শিক্ষায় ও উচ্চশিক্ষায় এর প্রয়োগ কতটা-কীভাবে করা সম্ভব। উনিশ শতকে বাংলা ভাষাচর্চার ইতিহাসের দিকে তাকালে সে-ঘটনাই চোখে পড়ে। ভার্নাকুলার স্কুল তৈরি হল, বাংলা শেখানোর জন্য প্রাইমার লেখা হল, বাংলা ভাষাকে বিদ্যালয় স্তরে অন্য বিষয়ের বাহন করে তোলার চেষ্টা জারি রইল। এই চেষ্টার পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’-এর মতো পত্র প্রকাশ করে সাধারণের সঙ্গে কৃতবিদ্য শ্রেণির সংযোগ ঘটাতে চাইলেন। বালক-বালিকাদের জন্য বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশ শুরু হল– ‘মুকুল’, ‘সখা’, ‘বালক’ পরবর্তী কালে ‘সন্দেশ’। রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার হেরফের’ লিখলেন। এই তলার ভিত্তি যখন দৃঢ় হয়ে উঠছে গণপরিসরে যখন বাংলা বেশ জায়গা করে নিচ্ছে তখনই উচ্চপর্যায়ে বাংলা-ভাষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। উচ্চপর্যায়ে মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রবেশের সুযোগ যাঁদের হল না নানা জীবিকায় যাঁরা অংশগ্রহণ করলেন তাঁদের মধ্যে ‘শিক্ষার বিকিরণ’ কীভাবে ঘটানো যায় তার নানা মডেল তৈরি হল। যেমন ‘প্রবাসী’ পত্রিকাতে যদুনাথ সরকারের নামে সাধারণের জন্য নানা-বিদ্যাবিষয়ক সহজ বই লেখার বিজ্ঞাপন প্রদান করা হয়েছিল। তলা ও উপর দুয়ের মধ্যে সহজ-সংযোগ জরুরি।
সময় ও পরিস্থিতি বদলায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ধারার বিদ্যালয়-ব্যবস্থার কথা ভাবা যাক। এখনও পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক স্তরে বাংলা-মাধ্যম ব্যবস্থার আওতায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীর অন্তত ৭০ শতাংশ বা তার বেশি অংশ পড়াশোনা করে। কয়েক প্রজন্মের পারিবারিক শিক্ষার সুবিধেপ্রাপ্ত সামর্থবান পড়ুয়াদের বড়ো অংশ বেসরকারি বিদ্যালয় ব্যবস্থায় চলে গেছে, সে-ব্যবস্থায় বাংলা প্রথম ভাষা নয়। তার বাইরে মূলধারায় যে পড়ুয়ারা রয়েছে তাদের মধ্যে যারা ক্লাস সিক্স-সেভেন-এইটে পড়ে তারা কি বাংলা ভাষায় সহজ স্বাভাবিক ভাবে নিজের চিন্তা প্রকাশ করতে পারে! নিজের চিন্তা প্রকাশ করার কথা থাক, বাংলা ভাষায় লেখা কোনও একটি বিষয়ের বই পড়ে নিজের মতো করে বিষয়টি বুঝতে পারে! খুব বেশি কিছু নয় এটুকুই যদি ক্লাস এইটের পড়ুয়া করে উঠতে পারে তাহলে অনেকটা হল। এ যদি করা সম্ভব না হয় তাহলে ধরে নিতে হবে আমাদের বাংলা ভাষার মুকুট আছে তলার কাপড়টি উধাও। ঐতিহ্যের মুকুট, অতীতের ধন-সম্পদের স্মৃতিবাহী রাজমুকুট– এ পর্যন্তই, তার বেশি নয়। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয় স্তরটি পোক্ত না-হলে উপর মহলটি একসময় ভেঙে পড়বে। বিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে নানা কাজ করা যায়। তবে সে কাজ করার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সরকারি ও সরকার পোষিত বিদ্যালয়গুলিতে উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাড়া ভাষা শিক্ষা কেন সমস্ত শিক্ষাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
বাংলা ভাষার জন্য বিদ্যালয় স্তরটি বস্ত্র-বয়নের কাজ করে। ভাষার মোটা ভাত-কাপড় তো সেই জোগায়। সেই জোগান বন্ধ হয়ে গেলে বা সেই ভাত-কাপড় দেওয়ার উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা না থাকলে ভাষা-শরীর জীর্ণ ও বস্ত্রহীন হবেই। তখন মাথায় মুকুট পরিয়ে অলংকার চাপিয়ে যে ভাষা-শরীরটি প্রদর্শন করার চেষ্টা চলে তা সামঞ্জস্যহীন, হাস্যকর শুধু নয় বড় বেদনার। পরান্নভোজী, কৃপাপ্রার্থী, উমেদার বাঙালি একথা না-বললেও কথাটা সত্য।