অদূরেই বইমেলা। বই বিক্রির বিপুল পশার। স্টল ও চঞ্চল লোকজন। প্রচুর আলোচনা চক্র, কবিতা পাঠ, গল্পপাঠ, লেখক-পাঠক সম্মিলন। কিন্তু বহুকাল হল, একটি জরুরি বিষয় এড়িয়ে চলে যাচ্ছে বাংলা বইয়ের বাজার, বাংলা বইয়ের অভিভাবকবৃন্দও। কিংবা তাঁরা সম্ভবত হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বিষয়টি– বুক পাইরেসি। বইয়ের নকলনবিশি। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যার বিপুল রমরমা। বাংলা বই-প্রকাশনার ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় করতে যা নিয়ে কথা না বললেই নয়। সদ্য সন্মাত্রানন্দ লিখিত ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ বইটির ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড ঘটেছে।
একজন লেখক, হোন তিনি দক্ষ ভাষাশিল্পী অথবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা শব্দশ্রমিক, নিজেকে ধীরে ধীরে নিঃশেষিত করেই একটি দীর্ঘ রচনা সম্পূর্ণ করেন। সাহিত্যকর্মের ওটিই প্রধানতম শর্ত– আত্মবিলয়। বিশেষত বাংলা ভাষায় লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখকের সামনে বিরাট কোনও স্বপ্নের হাতছানি ক্রমশই অবান্তর হয়ে এসেছে। অঙ্গুলিমেয় কিছু পাঠক যদি ভালোবেসে তাঁর লেখাটি পড়েন, ভালো-মন্দ পাঠোত্তর অনুভূতির কথা জানান, তবে ওইটুকুই লেখকের দিক থেকে এ মরুভূমিতে মরূদ্যানসম। এবং বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁরাও স্বল্প বিত্ত নিয়ে প্রাণান্ত প্রয়াস করেন একটি লেখাকে যথাসম্ভব শোভনসুন্দররূপে পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার। প্রকাশক ছাড়াও প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট কর্মীদেরও রুজি-রোজগার এই প্রয়াসের সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িত। নিছক জীবিকার প্রয়োজনেই যে এতগুলো মানুষ বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, তাও নয়। অনেকেই অন্যতর নিশ্চিত জীবিকার আশ্রয় ছেড়ে কেবল ভালোবাসার টানে বইপ্রকাশের কাজ নিয়েছেন; অন্তত সে-সংখ্যাটা খুব অপ্রতুল নয়।
আরও পড়ুন: কাদম্বরীকে বঙ্গজ লেখকরা মুখরোচক করে তুলেছেন বলেই মৃণালিনীকে বাঙালি জানতে চায়নি
এমন একটা পরিস্থিতিতে কোনও একটি বই হয়তো কিছুটা পাঠকপ্রিয়তা পেল, খানিকটা স্বীকৃতিও মিলল তার কপালে। ঠিক এই বিন্দু থেকেই সেই বই, তার লেখক ও প্রকাশকের ভাগ্যাকাশে অকালবৈশাখীর মেঘ ঘনাতে থাকে। এক তো পাঠকপ্রিয়তার বিপরীতেই আছে বহু সমব্যথাহীন নিন্দা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ঝড়, সে-ঝড়কে না হয় ‘অনিবার্য’ বলেই মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু তার পরেও এক বিচিত্র পাইরেসির বাজার ক্রমাগত দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আক্রমণ শানাতে থাকে বইটির প্রচার ও বিপণনের পথে। বিশেষ করে, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে এই নকলনবিশির ঢালাও হাট আছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত বহু বইয়ের পাইরেটেড কপি ঢেলে বিক্রি হয়। স্ক্যানার মেশিন ও আরও অন্যান্য কলকব্জার কল্যাণে ওকাজ তো এখন জলভাত! তাও কোনওমতে ঢোক গিলে মেনে নেন ভারতের লেখক ও প্রকাশকবৃন্দ। কিন্তু এহো বাহ্য, আগে কহ আর! পাইরেটেড কপির পরে বাংলাদেশের বাজারে নামতে থাকে সে-দেশের কোনও কোনও ভুঁইফোড় প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বইটির জাল মুদ্রণ। লেখক বা মূল প্রকাশকের কোনওরকম অনুমতি ছাড়াই এসব ভুঁইফোড় প্রকাশনা বইটি ছেপে ফেলে, তাতে তারা তাদের প্রকাশনার নাম, লোগো ইত্যাদি সবই ব্যবহার করে। যেন ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, যেন তারা লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি নিয়েই এই ‘মহান কর্মে’ হাত দিয়েছেন, এমন একটা বেপরোয়া পায়াভারি ভাব তাঁদের আচার-ব্যবহারে ফুটে ওঠে। নীতিনিয়মের আইনশৃঙ্খলার তাঁরা কোনও তোয়াক্কাই করেন না।
অতি সম্প্রতি আমার প্রথম উপন্যাস ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ বইটির ভাগ্যেও এই একই ব্যাপার হচ্ছে। এর আগে বইটির বহু পাইরেটেড কপি বাংলাদেশের হাটে বিক্রি হয়, সে-খবর আমরা আমাদের ওদেশের সহৃদয় ও সহমর্মী পাঠকদের কাছ থেকে পেয়েছি। এখন আবার বাংলাদেশের এক অখ্যাত প্রকাশন-সংস্থা ‘আকাশ প্রকাশনী’ কাউকে না বলে-কয়েই বইটিকে তাঁদের ‘আপন’ করে নিয়েছেন। নিজেদের নাম ও লোগো ব্যবহার করে বইটিকে ছেপে তাঁরা বইটি বাজারে ছেড়েছেন। এর জন্য তাঁরা আমার বা আমার বইটির একমাত্র প্রকাশক ‘ধানসিড়ি প্রকাশন’-এর কর্ণধার শুভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কোনও অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি।
আমার এই বইটির ক্ষেত্রে যা ঘটছে, আদৌ তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পশ্চিমবঙ্গের যেকোনও সামান্য পরিচিত বইয়ের ভাগ্যেই এই ভবিতব্য অপেক্ষা করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা প্রকাশনাগুলি থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত বইয়ের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার অহরহ ঘটে চলেছে। কেউ খবর পান, কেউ খবর পান না।
আরও পড়ুন: এদেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি
এমন নয় যে, এর বিরুদ্ধে কোনও আইনসংগত ব্যবস্থা নেই। আছে। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু ভিন্ন এক দেশ, আমাদের দেশের ভেতরে হলে কপিরাইট-আইনের সাহায্যে ব্যবস্থা নেওয়া যতটা সহজ, ভিন্ন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা দীর্ঘ ও আইনি জটিলতার কারণে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবু ব্যবস্থা তো আছেই, যদি লেখক-প্রকাশকরা এ নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদে সোচ্চার হন, তাহলে এই অসৎ কর্মের প্রবাহ কিছুটা হলেও রুখে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে অসহায় লেখক ও স্বল্প পুঁজির প্রকাশক মামলা চালানোর খরচ জোগাতে পারবেন না ভেবে এই বিজাতীয় হ্যাঙ্গাম থেকে নিজেকে দূরে রেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে থাকেন। আর এই অক্ষম দীর্ঘশ্বাসের নীচে দিনে দিনে জমে উঠতে থাকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অতি বড় অবৈধ বইবাজার। যার অনেকটাই দরিদ্র লেখক, প্রকাশক ও প্রকাশনাকর্মীদের সৎ প্রয়াস ও রক্ত-জল-করা শ্রমের মূল্যে নির্মিত।
কথা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বা বরাক উপত্যকায় তো ছড়িয়ে আছেন অজস্র সত্যিকারের বইপ্রেমী পাঠক, যাঁরা আইনসংগত উপায়েই বাংলাভাষায় লিখিত যেকোনও বইয়ের মূল প্রকাশনা-সংস্থা থেকে প্রকাশিত রূপটিই কেনেন, মন দিয়ে বই পড়েন তাঁরা, আলোচনাও করেন কেউ কেউ গণ-মাধ্যমে। খোদ বাংলাদেশেই তো আছেন কতজন সত্যিকারের সহমর্মী পাঠক। একটি বইয়ের প্রতি পাঠকদের ভালোবাসা অকুণ্ঠ না হলে কি বইটির ২২তম মুদ্রণ শেষ হয়ে আসে? নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা-র ক্ষেত্রে তাই তো হয়েছে। এই যে সহৃদয়তা আমি অন্তত আমার পাঠকদের কাছ থেকে পেয়েছি, তার থেকে পাঠকশক্তি সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধাবান প্রত্যয় আমার মনে তৈরি হয়েছে। শুধু আমার লেখাই নয়, এই পাঠকেরা আরও কতজন লেখকের কত বই পড়েন, সেসব বইয়ের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা না থাকলে আমরা যারা সামান্য লেখালেখি করি, নতুন বই-প্রকাশের সাহস কি পেতাম? নাকি আমাদের প্রকাশকরাই বইপ্রকাশে আগ্রহী হতেন? তাই এই বিপর্যয়ের দিনে এইসব সহমর্মী পাঠকরাও কেন-বা সংঘবদ্ধ হন না? কেন অসদুপায়ে প্রকাশিত নকল বইয়ের প্রকাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তাঁরা সোচ্চার হন না? বাংলাদেশের লেখক, প্রকাশক এবং অনুরাগী পাঠকরাও কেন-বা এর প্রতিবাদ করবেন না? লেখক-প্রকাশক-পাঠক মিলে একটিই তো সারস্বত গোষ্ঠী, যা পাঠ ও চর্চার প্রদীপটিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিয়ে যান। তাই আমাদের মধ্যে কেউই এই সমস্ত অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সাধ্যমতো রুখে দাঁড়ানোর দায় অস্বীকার করতে পারি না।