একটা ঘর। দু’জন মানুষ। কোনও কথা নেই। হাত অবশ। পা নড়ে না। আঙুল শুধু স্ক্রল করতে করতে থাকে। দেখে, ইমোশনাল সাপোর্টের জন্য তৈরি হয়েছে এআই। নারী। পুরুষ। নির্বিশেষে। দু’জন মানুষের হৃদয় পচে যায়। মেয়েটির চুলে বিলি কেটে দেয় না ছেলেটি। তারা রিল দেখে। আলো কমে আসে। অস্তিত্বের? মস্তিষ্কটি রিলসাগরে ভেসে যায়। একতাল মাংস যেন। দুর্গন্ধময়। আমরা দেখি, স্মার্টফোনের আলো দু’জন মানুষের মুখে। বাকিটা নিঃস্ব। তারা অনলাইন। অবনী, অনলাইন আছ?
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
একটা ঘুণপোকা। কখন, কীভাবে আর কবে সভ্যতার সুষুম্নাকাণ্ডে প্রবেশ করেছে সন্তর্পণে, তা আমরা ঢের জেনেছি। প্রথমেই, যৌথতার শিকড় পচে গিয়েছে। তারপর দিন যায়। এক মানুষের প্রতি অপর মানুষের ভালোবাসার আকরে হঠাৎ করে জন্ম নেয় দ্বিধা। ভয়। ঘৃণা। সহজ সহজ যে বিশ্বাস, একটা কুসুমভাঙা আলোর মতো, অগত্যা পচেই যায়। ১৯৮৩ সাল। এমনই কোনও ডিসেম্বরে, ভাস্কর চক্রবর্তী ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন: ‘আমি যাদের ভালোবাসি, তারাও আমাকে ভালোবাসে, এই সহজ বিশ্বাস যেন কোনোদিন মিলিয়ে না যায়।’
এ-কথার ওপর হিম জমে গেছে, হে পাঠক। হাত-পা ছুড়তে পারছে না আর। টের পাই। টের পাই, উত্তর-আধুনিক পৃথিবীতে সকলে প্রত্যেকে একা। প্রেম নেই। বিস্ময় নেই। পুঁজিবাদ বলছে, কে বলল তুমি একা? এই নাও অ্যাপের ঝুলি। খাওয়া। ঘুম। শপিং। বন্ধু। এভ্রিথিং। একেবারে আঙুলের ডগায়।
বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে শেষ যে ছবিটি তৈরি করলেন, নাম দিয়েছেন ‘সিটিআরএল’। কন্ট্রোল, অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণের আভাস। আমরা দেখছি, একা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে এআই। এআই পছন্দ করে দিচ্ছে পোশাক। প্রিয় গয়নাটি। এবং প্রেমিক। এআই দেখছে আমরা ঘুমোচ্ছি। ঘুমোতে ঘুমোতে কাঁদছি। খাচ্ছি। সর্বক্ষণ কথা বলছি। এআই যেন ‘অমর সঙ্গী’। বিশ্বস্ত? ভালোবাসা যায়? মানুষের মতো? এহেন প্রশ্নেরই সম্মুখীন করছে ছবিটি। শেষাবধি প্রকাণ্ড যে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে, সেখানে আমরা উদোম। একা। ক্ষয়ে যাচ্ছি। ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়, প্রকৃত প্রস্তাবেই, নিরালম্ব। বায়ুভূত। আর একুশ শতকে রিলনির্ভর।
তবে মানব-মস্তিষ্ক এই মুহূর্তে করছেটা কী? জাস্ট পচে যাচ্ছে। এটুকুই। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিচারে, এ-বছর ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ তকমাটি পেল– ব্রেইন রট। যে-মস্তিষ্ক পচে যাচ্ছে। কোন মস্তিষ্ক? জেন-জি থেকে সক্কলের। কারণ, সে নিষ্ক্রিয়। স্মার্টফোনে গভীর রাত পর্যন্ত সে দেখে কোন দোকানের পরোটা কতখানি পাতলা। যেন সে মন্ত্রপূতঃ, তাই দেখছে ঘরে বসেই কীভাবে তৈরি করা যায় অ্যাটম বোম। কীভাবে পরিষ্কার করতে হয় কর্দমাক্ত কার্পেট। কোন হোটেলে ৯৯ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস। এ-সবই ‘কন্টেন্ট’। ভালো, মন্দ– দুই-ই। কন্টেন্টের কমতিও নেই। যতদিন যায়, চতুর্দিক ভরে ওঠে শুধু কন্টেন্টে। আর মানুষ? একেকটি ডেটাবেস। মস্তিষ্কে কন্টেন্টের অনন্ত স্রোত। আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। সাঁতরে পাড় খুঁজব, সে ইচ্ছেও মরেছে। আসলে যার হাতে যত বেশি তথ্য, এ-দুনিয়ায় সে-ই রাজা।
……………………………………….
বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে শেষ যে ছবিটি তৈরি করলেন, নাম দিয়েছেন ‘সিটিআরএল’। কন্ট্রোল, অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণের আভাস। আমরা দেখছি, একা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে এআই। এআই পছন্দ করে দিচ্ছে পোশাক। প্রিয় গয়নাটি। এবং প্রেমিক। এআই দেখছে আমরা ঘুমোচ্ছি। ঘুমোতে ঘুমোতে কাঁদছি। খাচ্ছি। সর্বক্ষণ কথা বলছি। এআই যেন ‘অমর সঙ্গী’। বিশ্বস্ত? ভালোবাসা যায়? মানুষের মতো? এহেন প্রশ্নেরই সম্মুখীন করছে ছবিটি।
……………………………………….
মস্তিষ্কে পচন, অর্থ হয়, স্মৃতিও অথৈ জলে। একবারও মোবাইল স্ক্রিনে টাচ না করে, শেষ কোন সিনেমাটি দেখেছেন আপনি? গভীর মনোযোগে? বই পড়তে পড়তে ভুলে গেছেন সোশাল মিডিয়ার যাবতীয় ক্যাচাল? স্মৃতির নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে। সোশাল মিডিয়ার অ্যালগোরিদম অথবা ফেসবুকের নোটিফিকেশন মনে করিয়ে দেয়, আজ কার জন্মদিন! মণিপুরে কতজন মরে গেছে, ঘরে আগুন জ্বলেছে কতজনের, এ-দেশে রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যা কত– এগুলো স্মৃতি থেকে লোপাট করে দেওয়াই শ্রেয়। চলুন, বরং দেখি, ফ্লিপকার্টে কী অফার চলছে!
সমস্তটাই আসলে নিয়ন্ত্রণের মায়াজাল। মানুষ থেকে ক্রমশ ক্লান্ত, অবসন্ন, ভুতুড়ে একটা জীব। এই তো মনুষ্যজাতির আকাঙ্ক্ষিত বিবর্তন। সেই কারণেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি বেছে নিয়েছে ব্রেইন রট। তারা বলছে, শব্দটি যে অর্থ প্রতিফলিত করছে সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে, এই সময়ের নিরিখে তা যথাযথ। বিপুল টাকা খরচ করে, যে ডিজিটাল অভ্যাস তৈরি করলাম আমরা, প্রয়োজনীয় ওষুধ অথবা আলু-পটল-ঢ্যাঁড়শ ঘেঁটে শখের বাজারটিতেও ইতি টানলাম, আদতে আমরা একা হলাম। মানসিক স্বাস্থ্যটি গেল বিগড়ে। একশো হাজার ইন্সটাগ্রাম রিল ভুলিয়ে দিল দুঃখ। বলল, পৃথিবীতে সবাই পারফেক্ট। একমাত্র তুমি বেমানান।
………………………………………..
আরও পড়ুন সেবন্তী ঘোষ-এর লেখা: যা ছিল ভোরের শিশির, তা ডিজিটাল যুগে পরিণত হল বিকারের একতাল মাংস পিণ্ডে
………………………………………..
একটা ঘর। দু’জন মানুষ। কোনও কথা নেই। হাত অবশ। পা নড়ে না। আঙুল শুধু স্ক্রল করতে করতে থাকে। দেখে, ইমোশনাল সাপোর্টের জন্য তৈরি হয়েছে এআই। নারী। পুরুষ। নির্বিশেষে। দু’জন মানুষের হৃদয় পচে যায়। মেয়েটির চুলে বিলি কেটে দেয় না ছেলেটি। তারা রিল দেখে। আলো কমে আসে। অস্তিত্বের? মস্তিষ্কটি রিলসাগরে ভেসে যায়। একতাল মাংস যেন। দুর্গন্ধময়। আমরা দেখি, স্মার্টফোনের আলো দু’জন মানুষের মুখে। বাকিটা নিঃস্ব। তারা অনলাইন। অবনী, অনলাইন আছ?
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।