Robbar

কবে আছি, কবে নেই..

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 7, 2024 5:53 pm
  • Updated:July 11, 2024 5:39 pm  

সেতুর পর সেতু ভেঙে পড়ছে বিহারে। সেতু মানে তো একদিকের সঙ্গে অন্যদিককে আঁকড়ে ধরা উন্নয়নও। তার সলিলসমাধি ঘটছে, প্রতিদিন। বিহার তা রাজ্যের নাম মাত্র। হতে পারে তা যে কোনও দিন, যে কোনও জায়গায়। আট লেন ন্যাশনাল হাইওয়ের সুখ মেশানো আচ্ছে দিন হোঁচট খায়। জেগে ওঠে। হোঁচট খায় ফের। নিজেকে কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে কর্কশধ্বনি শুনতে পাই। এক আমি, অন্য আমির সঙ্গে যুদ্ধ করে, অস্ত্র সাজায়।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

মনোবিদ বন্ধু তার চেম্বারে আসা এক রোগীর গল্প শোনাচ্ছিল। জানতে পারলাম, রোগী মধ্যবয়স্ক। বিহারি মানুষটি আর কয়েক বছরের মধ্যেই পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলবেন। জীবনে একটি কাজই করেছেন এবং আমৃত্যু করে যাবেন বলে ভাবেন। তা হল, হলুদ ট্যাক্সি চালানো। তিনি বিশ্বাস করেন, দুনিয়ার সেরা সুখ লুকিয়ে রয়েছে হাওড়া স্টেশনে। এই স্টেশন কাউকে শূন্য হাতে, মানে খালি গাড়িতে ফেরায় না। প্রতি মুহূর্তে এখানে ট্যাক্সির চাহিদা তুঙ্গে! বহু ঘণ্টার সফর শেষে হাওড়া স্টেশনে পা রাখা ক্লান্ত যাত্রীদের থেকে কোনওরকম সংকোচ না করে চেয়ে ফেলা যায় বেশ কিছু এক্সট্রা। অধিকাংশ যাত্রীই নাকি কিছু মাইন্ড করেন না। দিয়ে দেন, হাত খুলে। এত কিছু যে স্টেশন চত্বর উপহার দেয়, তা লক্ষীমন্ত হবে না কেন?

Iconic Howrah Bridge heads for a health check-up after two decades | India News - Business Standard

এত পর্যন্ত ঠিক ছিল। সমস্যা হল, উঠল বাই তো হাওড়া যাই বলে স্টেশন চত্বরে গাড়ি হাঁকাতেন যে মানুষটি, তিনি আর সেতু পেরতে চাইছেন না। হাওড়া ব্রিজ হোক কিংবা দ্বিতীয় হুগলি সেতু, দূর থেকে নদী দেখামাত্রই গাড়িটা সাইড করে দিচ্ছেন রাস্তার এক ধারে। ‘গঙ্গা মাঈ কি জয়’ বলে একবার নদীর দিকে আর একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কীসব যেন বিড়বিড় করছেন। নো পার্কিং রাস্তায় উল্টোপাল্টা গাড়ি সাইড করার ফলে আলটপকা জরিমানাও গুনেছেন বেশ কয়েকবার। নদী আর তাঁর পেরতে মন চায় না। প্রাণে দেয় না। কোনওক্রমে ব্রিজ পেরিয়ে হাওড়ায় ঢুকে গেলে একটু পরেই যাত্রী নিয়ে যখন ফের কলকাতামুখী হন, তখনও তাঁর মনের মধ্যে চাউমিনের মতো পাক খায় সেই একই সমীকরণ।

মানুষটি শুধু ভাবেন, সেতুটা ভেঙে পড়বে না তো? কয়েক লক্ষ বার কয়েকশো সেতু পেরিয়েছেন এই ড্রাইভারি জীবনে। কখনও এমন মনে হয়নি কোনও দিন। এখন হয়। ভয়ে কিংবা অবসাদে বাড়িতে একপ্রকার বসে গিয়েছিলেন। যদি ব্রিজ পেরতে হয় ফের! গাড়ি না চালালে আটা আসে না। তাই বাড়ির লোকের চাপে আর থাকতে না পেরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার দুম করে কী হয়ে গেল ডাক্তারবাবু? শুধু তো একটু খবরই পড়েছিলাম।’ একটু থেমে, রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলেছিলেন, ‘আমার দেশটার কী হয়ে গেল বলতে পারেন? সেতুগুলোর দিকে তাকালে আমার যে বড় চিন্তা হয়। উন্নয়ন কি দেশলাই কাঠি দিয়ে তৈরি?’

উন্নয়ন ভেঙে পড়ছে

আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী নিদান দিলি তুই?”

ও বলেছিল, ‘কয়েকটা থেরাপি আর কাউন্সিলিংয়ের কথা তো বলেছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, ওই রোগীর সঙ্গে কথা বলার পরে আমারও ব্রিজ পেরতে কেমন যেন ভয় হয়। মনে হয়, ভেঙে পড়বে না তো! খবরের কাগজ পড়লে এই ভয়ের ওপরে অ্যামপ্লিফায়ার যোগ হয়। আমারও যে কী হল ভাই!’

চুপি চুপি বলি, ভয় হচ্ছে আমারও!

খবর বলছে, গত ১৭ দিনে অন্তত ১২টি সেতু ভাঙার ঘটনা ঘটেছে শুধুমাত্র বিহারে। শীর্ষস্থানে রয়েছে সারন জেলা। ভেঙেছে ৩টি সেতু। ছাপড়া, পূর্ব চম্পারণ, মধুবনী, কিষাণগঞ্জ– ভেঙে পড়া সেতুর ঘটনার তালিকায় নাম লেখাতে শুরু করে দিয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যটির একের পর এক জেলা। মাত্র দেড় দশক আগে গন্ডকী নদীর ওপরে গড়ে তোলা সেতু ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো। এর মাত্র কয়েক দিন আগে আরও দু’টি সেতু ভেঙে পড়েছিল কারও কোনও তোয়াক্কা না করেই– একটি জনতা বাজার অঞ্চলে এবং অন্যটি লাহলাদপুর বলে আরেকটি গ্রামীণ জায়গায়। হতাহতের কোনও খবর নেই। তবে মনে করা হচ্ছে, অতিবৃষ্টির ধকল সামলাতে পারেনি এই সেতুগুলি। এমন তালিকায় আরও ঘটনার কথা যোগ করতে গেলে তা অন্তহীন হয়। আন্তর্জালে তথ্য মজুত আছে সর্বদাই, ছবি-সহ। আছে সেতু ভেঙে পড়ার ভিডিও। অতএব, এ নিয়ে কথা বাড়ানো বৃথা। শুধু বৃথা হয়ে যায় না ওই ট্যাক্সিচালকের কপালের বলিরেখা।

বিহারে ভেঙে পড়ছে একের পর এক সেতু

শুধু সেতুর কথা বলতে গেলে লেখায় অনেক ফাঁক থেকে যাবে। তাই এই তালিকায় জুড়ে দেওয়া যেতে পারে বিমানবন্দরও। দেশের রাজধানীর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সম্প্রতি ছাদ ধসে পড়েছিল। কেড়েছিল একটি নিরীহ প্রাণ। রাজকোট বিমানবন্দরের নির্মীয়মাণ ছাদের কিছু অংশ ভেঙে পড়ে তার অব্যবহিত পরেই। আবহাওয়াবিদরা কপাল কুঁচকে বলছেন, ‘মৌসুমী বায়ুর তেজ তো বাড়বে ক্রমশ।’ সেই তেজের বলি আর কত ছাদ হবে, তা জানা শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ইয়ারবুক আর প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার পড়া করা, জেনারেল নলেজ আত্মীকৃত করা প্রতিটি মানুষ জানেন, এমন হারে সেতুর সলিলসমাধি হয়নি এর আগে। এক সেতু ভেঙে গেলে অন্য সেতু যেন বলে ওঠে, ‘বয়োঃজ্যেষ্ঠকে ফেলে রেখে এ কেমন চলে যাওয়া!’ প্রশ্ন উঠছে দেশজুড়ে, এমন সেতুর নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রী নিয়ে। জিজ্ঞাসাচিহ্নের ফন্ট বাড়ছে সেতু কিংবা বিমানবন্দরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যে প্রযুক্তিবিদরা ছিলেন, তাঁদের সার্বিক দায়িত্ববোধ নিয়েও। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আধিকারিকরা তাঁদের কথা বলার সিলেবাস মেনে জানিয়েছেন, তদন্ত হবে জোরদার। রেয়াত করা হবে না দোষীদের। কিন্তু, বার্মুডা ত্রিভুজে গায়েব হয়ে বিমানের মতো এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর অধরাই থেকে যায় এ দুনিয়ায়। সময় বড় বলবান। অন্য ঘটনা এসে পুরনো ঘটনাকে চেপে দেয়। আর কী সহজে ভুলে যাই আমরা!

দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো আমরা হাঁ করে বসে থাকি উন্নয়নের। সারা বছর খানাখন্দে ভরা রাস্তা নির্বাচনের ঠিক আগে রাতারাতি সেজে ওঠে। ভোট মিটে যায়। আর কী আশ্চর্য! মাস ছয়েক পর থেকেই সেই সেজে ওঠা রাস্তা ফের ফিরে পেতে শুরু করে পুরনো শ্রীরূপ। শিবরাম চক্রবর্তী হয়তো বলতেন, ‘ইহা শ্রীরূপ নহে। বিশ্রীরূপ।’ বৃষ্টি থেমে যাওয়ার সাত দিন পরেও হাঁটুর উপরে প্যান্ট গুটিয়ে স্কুলে যেতে বাধ্য হয় পড়ুয়ারা। কোনও অজ্ঞাত কারণে জল নামে না অঞ্চলে। আর, এমন অঞ্চল ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে। অথচ ম্যানহোল খুলে, রাস্তার গাড়িঘোড়া সপ্তাহখানেকের জন্য আটকে দিয়ে নিকাশি ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া হয়েছিল মাসখানেক আগেই। ৫০ মাইক্রনের কম পুরু প্লাস্টিক বছর কয়েক আগে বন্ধ করে দেওয়া সত্ত্বেও তা ‘টুকি’ বলে ডেকে ওঠে প্রতিদিন, দেশের আনাচকানাচে, সর্বত্র। বিপজ্জনক বাড়ি শুধু ঠিক সময়ে ভাঙা হয়নি বলে সামান্য ঝড়বৃষ্টিতে ধসে পড়ে দেওয়াল। পরিত্যক্ত পাঁচিলের নিচে জেগে থাকে কারও মৃত হাত, পরের দিনের সংবাদপত্রের প্রথম পাতার ছবি হয়ে। বাদ যান না দেবতারাও। কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে তুমুল শোরগোল তোলা মহার্ঘ্য মন্দিরের উদ্বোধন হওয়ার ছ’ মাসের মধ্যেই তার ছাদ চুঁইয়ে পড়ে জল। মন্দিরগামী রাস্তার গালে বেহায়া ব্রণর মতো জেগে ওঠে খানাখন্দ। উদ্বোধনকালে মন্ত্রীদর্শনের পাট মিটেছে কবেই। তাই পরিচর্যার ইচ্ছেও পাড়ি দিয়েছে দিকশূন্যপুরে।

Burhi Gandak river | Newly constructed bridge collapses in Bihar - Telegraph India
বুড়ি গণ্ডক নদীর ব্রিজ

দেশের মানুষেরা সমস্বরে বলেন, “সরকার বাহাদুর! রাস্তায় হাঁটতে পারছি না মোটে।” পুর অভিযান চালিয়ে পুরো ফুটপাথ হকারমুক্ত করা হয়, আবার ছ’মাস পরে একই অ্যাজেন্ডায় একই রাস্তা হকারবিহীন করার জন্য! বছরে কয়েক কোটি কাজের ঘোষণা হয়। অন্য দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দূরপাল্লার ট্রেনে অসংরক্ষিত কামরায় ওঠার জন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিড়। পাপড়ি মেলে বিকশিত ভারত। মধ্যরাত্রেও নিয়ন আলোয় জ্বলতে থাকে আচ্ছে দিন।

‘আছি কেমন’ জিজ্ঞেস করলে আমারই এক আমি বলে, ‘দিব্যি আছি। নদী ভেদ করে মেট্রো চলছে আজ। শুনছি, কলকাতা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট ফের চালু হবে ডিরেক্ট উড়ান।’ এটা শুনেই অন্য আমি তির্যকভাবে হাসে। খুকখুক করে কাশে। ফিসফিস করে বলে, ‘ওই দ্যাখো! ভেঙে পড়ল বাঁশের সাঁকো। বগির উপরে উঠে গেল বগি।’ দুটো গলাতেই ক্রমশ মিশতে থাকে আরও অনেক গলা। করাতকলের আওয়াজে কান চাপা দিই।

ওই ট্যাক্সিচালক নাকি আমার ডাক্তার বন্ধুকে আরও একটা কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনাদের বাঙ্গালিতে একটা গানা আছে না! সেতু দেখলেই ওই গানের কথা আমার খুব মনে পড়ে। মনে হয়, ব্রিজগুলোই খুদ ওই গানা গাইছে। রেডিওতে খুব বাজে।’ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘কোন গান?’

উত্তর এসেছিল, ‘কবে আছি, কবে নেই।’