Robbar

ক্রীড়াকর্তারা দেদার খরচ করবেন আর খেলোয়াড়রা মানরক্ষা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 29, 2024 9:20 pm
  • Updated:June 29, 2024 9:25 pm  

ক্রীড়া কর্তারা ফ্রান্সের রাজধানীতে থাকাকালীন দৈনিক ২৫ হাজার টাকারও বেশি ‘ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স’ পাবেন! সঙ্গে মাথাপিছু দিনে আরও হাজার টাকা। ১২ জনের জন্য প্রায় ২০ লক্ষ! কার্যকরী সমিতির সদস্যদের পাঁচদিন প্যারিসে থাকার জন্য দেওয়া হবে ৯০ হাজার টাকা করে। শুধু জাতীয় অলিম্পিক সংস্থার প্রধান হিসেবে পি টি ঊষার যাবতীয় খরচ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক সংস্থার। তিনি ‘অতিথি’। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই টাকা তহবিলে নেই বলে অলিম্পিক দলের সঙ্গে কোনও দক্ষ অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেতে পারছেন না। কোনও জরুরি ক্রীড়া সরঞ্জাম না পেয়ে প্রস্তুতি ঠিকমতো হয়নি ক্রীড়াবিদদের।

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়

‘খোকা যাবে শ্বশুর বাড়ি/ সঙ্গে যাবে কে? ঘরে আছে হুলো বেড়াল/ কোমর বেঁধেছে।’ ছোটবেলায় ছেলে-ভুলোনো এই ছড়া সকলেই পড়েছি। সেই ছড়া এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। যদি শুধু ‘অর্থহীন ছড়া’ বলে কেউ মনে করেন, সে কথা আলাদা। কিন্তু যদি রূপক অর্থে ধরা যায়, তাহলে এর নির্যাস স্পষ্ট– খোকা শ্বশুর বাড়ি যাবে বলে তার বাপ-মা-ভাই-বোনদের চেয়েও বেশি উৎসাহ ঘরের হুলো বেড়ালের। কারণ, সেখানে গিয়ে ফোকটে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় গলাধঃকরণ করার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি! সেই ট্র্যাডিশন কিন্তু এখনও চলছে।

চলতি বছর প্যারিসে বসছে অলিম্পিকের আসর। প্রতিবারের মতো এবারও অংশ নেবে ভারত। তার জন্য সাজ সাজ রব। যে সমস্ত প্রতিযোগী যোগ্যতামান অতিক্রম করেছেন, তাঁরা জোরকদমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সঙ্গে আছে কোচ, ফিজিও, ম্যাসিওর, ডাক্তারের বিরাট দল। রাজসূয় যজ্ঞের মতো। নেতৃত্বে থাকেন একজন ‘শেফ দ্য মিশন’। এই গোটা দলের খরচের অনেকটাই বহন করবে ভারত সরকার। দেশের মানসম্মান রক্ষার দায়িত্ব থাকবে অংশ নেওয়া ক্রীড়াবিদদের ওপর।

In a first, Paris Olympics 2024 gold medalists to get $50,000 prize money | Personal Finance - Business Standard

তাহলে প্যারিস অলিম্পিকের সময় পাঁচদিন ধরে সেখানে থাকা ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্গত বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার কর্তাদের কাজ কী? কার্যত কিছুই নয়। ‘হয়তো নাম কা ওয়াস্তে’ কিছু গালভরা দায়িত্ব কাগজে-কলমে দেখানো হবে (প্লাসে মাইনাসে মাইনাসের মতো তাতে প্রাপ্তির ঝুলি ফাঁকা থাকার সম্ভাবনা)। কিন্তু আদতে কমিটির টাকায় প্যারিস ঘোরা, শপিং মলে কেনাকাটা ও মোচ্ছব ছাড়া তেমন কোনও কাজ এই কর্তাদের থাকে না। থাকার কথাও নয়।

কিমাশ্চর্যম! এই ‘গুড ফর নাথিং’ কর্তারা ফ্রান্সের রাজধানীতে থাকাকালীন দৈনিক ৩০০ ডলার করে ‘ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স’ বা ভাতাও পাবেন! যা ভারতীয় মুদ্রায় ২৫ হাজার টাকার সামান্য বেশি। সঙ্গে মাথাপিছু দিনে আরও হাজার টাকা। সহজ অঙ্কে একেক জনের জন্য সওয়া লক্ষ টাকা! ১২ জনের জন্য প্রায় ২০ লক্ষ! গতবার টোকিও অলিম্পিকে এই ভাতা ছিল দৈনিক ১৫০ ডলার। আহা, কী মুশকিল। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তো। তাই এবার সরাসরি ভাতা বেড়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতেই শেষ নয়, কার্যকরী সমিতির সদস্যদের পাঁচদিন প্যারিসে থাকার জন্য দেওয়া হবে ৯০ হাজার টাকা করে। শুধু জাতীয় অলিম্পিক সংস্থার প্রধান হিসেবে পি টি ঊষার যাবতীয় খরচ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক সংস্থার। তিনি ‘অতিথি’। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই টাকা তহবিলে নেই বলে অলিম্পিক দলের সঙ্গে কোনও দক্ষ অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেতে পারছেন না। কোনও জরুরি ক্রীড়া সরঞ্জাম না পেয়ে প্রস্তুতি ঠিকমতো হয়নি ক্রীড়াবিদদের।

……………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: আমের ‘কোহিনুর’ কোহিতুরও এখন বিপন্ন, বঞ্চিত ‘আম’জনতা

……………………………………………………………………………………………

এহ বাহ্য। আসল কথা তো বলাই হয়নি! অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ক্রীড়াবিদরাও তো ‘ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স’ বা ভাতা পাবেন। তবে সেটা দৈনিক ৫০ ডলার! অর্থাৎ, দিনে চার হাজার টাকার একটু বেশি। কিন্তু তাঁদের ভাতায় মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব মোটে পড়েনি। তাই চার বছর আগে যা ভাতা ছিল, এবারও তাই। সেই ৫০ ডলার। সমালোচনা অনিবার্য বুঝে কিছুটা মলম লাগানোর চেষ্টা যে হয়নি, তা নয়। অ্যাথলিটদের জন্য ‘পার্টিসিপেশন অ্যালাউন্স’ বরাদ্দ করেছে আইওএ। ক্রীড়াবিদরা পাবেন ২ লক্ষ, কোচ-সাপোর্ট স্টাফদের জন্য ১ লক্ষ। আর যাঁরা ‘ক্রীড়া পর্যটক’, তাঁদের ঝুলিতে কিছু না করেও সওয়া লক্ষ! যে সমস্ত খেলোয়াড়, কোচ, দিনরাত এক করে, মুখে রক্ত তুলে চার বছর ধরে এই মঞ্চটার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, তাঁদের কি এই ব্যবহার প্রাপ্য? গেমস ভিলেজে থাকলেও প্যারিসের মতো ব্যয়বহুল শহরে ৫০ ডলার বা চার হাজার টাকায় তাঁদের আদৌ চলবে তো? কর্তারাও তো গেমস ভিলেজেই থাকেন। তাহলে তাঁদের পকেট উপচে ছ’গুণ টাকা দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? ওই বাড়তি টাকা তাঁদের কী কাজে লাগবে? ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটা ছাড়া? মনে রাখতে হবে, প্যারিস অলিম্পিক প্রথম বা শেষ নয়। এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস-সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এমনটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর। রাজ্য সংস্থার ভোট পেতে তাদের প্রতিনিধি ও বশংবদ কর্তাদের মধ্যে এই আনুকূল্য বিতরণ করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। এবারের ঘটনাও ব্যতিক্রম নয়।

Paris 2024: How is France preparing for the Olympics and Paralympics? - BBC News

১৯৮৬-’৮৭ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধীর আমলে যাত্রা শুরু করে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা সাই। লক্ষ্য, দেশ জুড়ে অলিম্পিক স্পোর্টস ইভেন্টগুলোতে দেশজুড়ে বিজ্ঞানস্মত প্রশিক্ষণ চালু করা এবং দ্রুত ভারতকে পদক তালিকায় সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়া। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়নি। ইন্ডিয়ান ওলিম্পিক সংস্থার সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্য সংস্থা ও সাইয়ের সমন্বয়ের অভাব, সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীবাজি ও দুর্নীতি সেই লক্ষ্য পূরণের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বত্রই রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ধনী ব্যবসায়ীদের আধিপত্য। কখনও বকলমে তাঁদের চাটুকাররা ছড়ি ঘোরান। অনেক ক্ষেত্রেই ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ হয়। কর্তারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। ক্ষমতায় থাকলে সরকারি অনুদান নয়ছয়, জনগণের করের টাকায় বিদেশ ভ্রমণের এমন সুবর্ণ সুযোগ অন্য কোথায় মিলবে? তার ওপর রয়েছে ‘কাঠিবাজি’ করার পুরনো অভ্যাসও। নিজেরা তো ভালো কিছু করবেই না, উল্টে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাঁরা পদক জয়ের সম্ভাব্য দাবিদার, ‘কর্তা-ভজা’ না হলে পদে পদে তাঁদেরও কাজে বাগড়া দেবেন এই সমস্ত ‘গুণধর’ কর্তা।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই হুলো বেড়াল থুড়ি ক্রীড়া কর্তাদের জন্য যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সেটা চেয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছেন অলিম্পিক সংস্থার সর্বময় কর্ত্রী পি টি ঊষা। মানে, তাঁরা যাবেন সাধারণ মানুষের করের টাকায়। ঊষা নিজেও তো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অ্যাথলিট ছিলেন। কর্তাদের এই বৈষম্যের তিনিও সাক্ষী। তিনি কেন প্রতিবাদ করলেন না? একই জুতোয় পা গলালেন! ক্ষমতার মোহ কি এভাবেই সবাইকে অন্ধ করে দেয়? অথচ ক্রীড়া সংস্থার শীর্ষ পদে বহুদিন ধরে খেলোয়াড়দের চেয়ে কম আন্দোলন-প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা দেখিয়ে দিল, ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’।

……………………………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………………………..