Robbar

১১ হাজার কেজি! রোহিতদের সংবর্ধনার ফলশ্রুতি ‘এত্তা জঞ্জাল’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 7, 2024 7:15 pm
  • Updated:July 7, 2024 7:15 pm  

জনশূন্য মেরিন ড্রাইভের ‘শোভা’ বাড়িয়ে সেখানে পড়ে রইল ভিড়ের ঠেলায় বেসামাল মানুষের অজস্র জুতো, চপ্পল, খালি জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট মায় ছেঁড়া কাপড়-জামা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার রাতেই কাজ শুরু করেন বৃহন্মুম্বই পুরসভার কর্মীরা। চলে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত। মেরিন ড্রাইভ থেকে সংগ্রহ করেন ‘মাত্র’ ১১,৫০০ কেজি জঞ্জাল! একটি কমপ্যাক্টর, একটি ডাম্পার এবং পাঁচটি এসসিবিভি রাতভর কাজে লেগেছে। সকাল ৮টায় কাজ শেষ হওয়ার আগে পুরকর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরাও।

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়

গত বছর ঘরের মাঠে ফের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ের সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ফাইনালে উঠেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়। তাই সদ্যসমাপ্ত টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের পর উচ্ছ্বাস মাত্রাছাড়া হবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। হয়েছেও তাই। মুম্বই ফেরার পর খোলা বাসে চাপিয়ে ক্রিকেটারদের কাপ নিয়ে প্রদক্ষিণ। তার সাক্ষী থাকতে কার্যত জনসমুদ্রের চেহারা নিয়েছিল প্রায় ১.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ। যেন পাশাপাশি দু’টি সমুদ্র। তবে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের ‘দর্শন’ শেষ হতেই ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হয়ে যায় সুবিশাল জনতা।

তারপর? জনশূন্য মেরিন ড্রাইভের ‘শোভা’ বাড়িয়ে সেখানে পড়ে রইল ভিড়ের ঠেলায় বেসামাল মানুষের অজস্র জুতো, চপ্পল, খালি জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট মায় ছেঁড়া কাপড়-জামা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার রাতেই কাজ শুরু করেন বৃহন্মুম্বই পুরসভার কর্মীরা। চলে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত। মেরিন ড্রাইভ থেকে সংগ্রহ করেন ‘মাত্র’ ১১,৫০০ কেজি জঞ্জাল! একটি কমপ্যাক্টর, একটি ডাম্পার এবং পাঁচটি এসসিবিভি রাতভর কাজে লেগেছে। সকাল ৮টায় কাজ শেষ হওয়ার আগে পুরকর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরাও।

Several fans injured during Team India's T20 World Cup victory parade in  Mumbai | Mumbai news - Hindustan Times

এটাই কি আমাদের দেশের স্থায়ী দস্তুর? বিভিন্ন অনুষ্ঠান, তা সে বিয়ে-শ্রাদ্ধ-পৈতে হোক বা সামাজিক কোনও জমায়েত, অনুষ্ঠান শেষে বর্জ্যের স্তূপ চোখের পক্ষেও পীড়াদায়ক। পরিবেশ দূষণের জন্য একেবারে আদর্শ। রাস্তার ধারের ভ্যাট উপচে পড়ে। নোংরা নিয়ে টানাটানি করে চতুর্দিক আরও দূষিত করে কুকুর-বেড়াল-পাখি। দীর্ঘদিন ধরে দেখেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনও সুষ্ঠু পরিকল্পনা করি না আয়োজকরা। রাজনৈতিক সভার পরেও একই দৃশ্য। সদ্যসমাপ্ত ভোট মিটতে না মিটতেই রাস্তার ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়েছে ফ্লেক্স, ফেস্টুন-পতাকা। ১৫ আগস্ট, ২৬ জানুয়ারির অনুষ্ঠান শেষের পর রাস্তায় পড়ে থাকে কাগজ-প্লাস্টিকের জাতীয় পতাকা। তা যেমন পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, তেমনই যে জাতীয় পতাকার মর্যাদার পক্ষেও অবমাননার, সে কথা মাথায় রাখি না। শিয়ালদহ মেন লাইনে যাতায়াতের পথে নোয়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পাশে চোখে পড়বে বিরাট ন্যাড়া পাহাড়। এক ঝলক দেখলে অযোধ্যা বা শুশুনিয়ার পাহাড় বলে ভ্রম হতে বাধ্য। অচিরেই অবশ্য ভুল ভাঙবে। কারণ, তার মাথায় দঁাড়িয়ে জেসিবি, পাশ থেকে ধোঁয়া উঠছে। দিন দিন জঞ্জাল জমা হয়ে তৈরি হয়েছে এই পাহাড়। এমন দৃশ্য চোখে পড়বে ধাপার মাঠে, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশেও। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর দিল্লি। প্রথম ৫০টি দূষিত শহরের মধ্যে ৩৯টিই ভারতে। প্রতিদিন যেভাবে সবুজ ধ্বংস করে নগরায়ন হচ্ছে, জলাভূমি চুরি হয়ে যাচ্ছে, অবাধে তোলা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল, পোড়া জ্বালানির ধোঁয়ায় ঝঁাঝরা হচ্ছে ফুসফুস, তখনই বোঝা যায় দূষণ ও পরিবেশ নিয়ে আমরা কতটা সচেতন।

আমরা হিমালয়কেও রেহাই দিইনি। তাই কয়েক দশকের বাণিজ্যিক পর্বতারোহণ মাউন্ট এভারেস্টকে ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ আবর্জনার স্তূপে’ পরিণত করেছে। অভিযাত্রীদের মল থেকে শুরু করে বিয়ারের বোতল, তঁাবু, প্লাস্টিক, খালি অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ছড়িয়ে থাকছে যাত্রাপথের ধারে। রক্ষা পায়নি নদী-সাগর-মহাসাগর। এমনকি, মহাকাশও আর মহাশূন্য নয়। বর্তমানে মহাকাশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে জঞ্জাল–ধ্বংস হয়ে যাওয়া উপগ্রহের টুকরো। পৃথিবীর চারপাশে পঁাচ লক্ষ টুকরো হয়ে এভাবেই ঘুরছে প্রায় আট লক্ষ টনের ধাতব জঞ্জাল বা স্পেস ডেব্রি।

Mumbai Halts To Salute Team India: Rohit Dedicates T20 World Cup Title To  Entire Nation; Men in Blue Get Rs 125 Cr Prize Money

অথচ চেষ্টা করলে এই সমস্ত ছবিই পাল্টানো যায়। আমরা, মানুষই পারি এই দেশ ও পৃথিবীকে সুন্দর করতে। জাপানের পশ্চিমাঞ্চলে শিকোকু দ্বীপের সবচেয়ে ছোট শহর কামিকাতসু। জনসংখ্যা মাত্র ১,৩৭৩। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই ‌‌‘জিরো ওয়েস্ট’ ইসু্যতে বিশ্বের তাবড় মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে। প্রচলিত পদ্ধতিতে আবর্জনা পুড়িয়ে, মাটি চাপা দিয়ে বা জলে না ফেলে জঞ্জাল পুনর্বব্যবহার করার পদ্ধতি ‘জিরো ওয়েস্ট’। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি হাতে নেয় কামিকাতসু। এই শহরে কোথাও নেই ময়লা ফেলার জায়গা বা গাড়ি। কিন্তু পরিচ্ছন্ন শহরে একটুকরো নোংরা চোখে পড়বে না। কারণ, বাসিন্দারা নিজেরাই বর্জ্য পরিষ্কার করে দিয়ে আসেন ‘ওয়েস্ট রিসাইকেলিং সেন্টার’-এ। যেখানে সমস্ত আবর্জনা ৩৪টি আলাদা ভাগে ভাগ করে রিসাইকেলিং করতে পাঠানো হয়। ২০২০ সালে ‘জিরো ওয়েস্ট সিটি’ হওয়ার সম্মান প্রায় হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে তাদের। অথচ এই পদ্ধতি শুরুতে পছন্দ করেননি শহরের চল্লিশ শতাংশ নাগরিক। কিন্তু তাতেও কঠোর আইনে বদল হয়নি। এখন কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় তঁারা অভ্যস্ত, স্বচ্ছন্দ। পাশাপাশি, ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে বর্জ্যের ৮০%, সান ফ্রান্সিকোতে ৭০% বর্জ্য রিসাইকেলিং করা হয়। ২০১৫ সালে স্যান ডিয়েগো তাদের নগর পরিকল্পনায় জিরো ওয়েস্ট সিটি হবার লক্ষ্যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৫ ভাগ ও ২০৪০ সালের মধ্যে শতভাগ সাফল্য অর্জন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। একইভাবে নিউ ইয়র্কও আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ইতালির কয়েকটি শহরেও এ কাজ শুরু হয়েছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলির সিংহভাগই ‘ল্যান্ডফিল’ পদ্ধতিতে কাজ করে। অর্থাৎ বর্জ্য পদার্থ মাটি চাপা দেওয়ার ব্যবস্থাপনা। ব্যবসায়িক কারণেই তারা বিকল্প ব্যবস্থায় আগ্রহী নয়। এছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ। রাজনৈতিক দলগুলির আর্থিক লাভ-ক্ষতির চুলচেরা হিসেব অনেক ক্ষেত্রে বড় হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি সচেতনতার অভাব ও দায় এড়ানোর মানসিকতা বিশ্বকে ধীরে ধীরে ‘জঞ্জালের স্তূপে’ পরিণত করছে। সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি–/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ স্বল্পায়ু জীবনে তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু, আমরা তঁার উত্তরসূরিরাও কি কখনও এ কথা গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছি? কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কতটা সচেতন? আগামী প্রজন্মের জন্য এ কোন পৃথিবী আমরা রেখে যাচ্ছি। এভাবে চললে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিন্তু আমাদের ক্ষমা করবে না।