শিউলী সমাজের অধিকাংশই বংশ পরম্পরায় গাছ কাটা এবং গুড় তৈরির কাজে যুক্ত। এই অন্ত্যজ শিউলীদের এক বিচিত্র পরিযায়ী জীবন। উত্তরের শীতের দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা যেমন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উড়ে আসে আর শীতের শেষে আবার ফিরে যায় তাদের শীতের দেশে, ঠিক তেমনভাবেই বেশিরভাগ শিউলীরা বেরিয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খেজুর গাছের সন্ধানে। এত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুর গাছ। নিতান্ত অনাদরে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছ নলেন গুড়ের আঁতুড়ঘর। নগরায়ন ও উন্নয়নের জোয়ারে কমছে খেজুর গাছ। কখনও রাস্তা তৈরিতে তার ঘাড়ে কোপ পড়ে, কখনও ইটভাটার আঁচ জ্বালতে। রস জোগাবে কে?
শিউলীগন্ধী ভোর। ঘন কুয়াশায় মাখামাখি ফসলের খেত। খেতের আলে, পথের ধারে সারি সারি খেজুর গাছ। সেই খেজুর গাছের গভীরে সঞ্চিত রস সংগ্রহ করেন একদল মানুষ। রোগাভোগা শরীরে খেজুর গাছের অমসৃণ গা বেয়ে উঠে পড়েন একেবারে মাথায়। সেখানে সুনিপুণ দক্ষতায় বেঁধে দিয়ে আসেন কলসি। তার মধ্যেই একটু একটু করে জমা হয় খেজুরের রস। এই রস জ্বাল দিয়েই তৈরি হবে খেজুর গুড়, ঝোলা গুড়, পাটালি। আর ঈশ্বর গুপ্ত বলে উঠবেন, ‘হায়রে শিশির তোর কি লিখিব যশ।/ কাল গুণে অপরূপ কাঠে হয় রস।। পরিপূর্ণ সুধা বিন্দু খেজুরের কাঠে।/ কাঠ কেটে উঠে রস যত কাঠ কাটে।। দেবের দুর্লভ ধন জীবনে ঘড়া।/ এক বিন্দু রস খেলে বেঁচে ওঠে মড়া।।’
কার্তিক থেকে ফাল্গুন− পাঁচ মাস ঘিরে আবর্তিত এই প্রান্তিক মানুষের জীবন। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে, মেজাজি শীতকে অগ্রাহ্য করে স্বল্পবাস পরিহিত এই অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ জীবিকার তাগিদে কঠোর শ্রমে খেজুর গাছকে সযত্নে লালন করেন অমৃত কুম্ভের সন্ধানে। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, আলপথে হেঁটে চলা এই রস সংগ্রাহকরা পরিচিত ‘শিউলী’ নামে। অঞ্চলভেদে এই শিউলীদের ভাষাগত নামও আলাদা আলাদা। কোথাও ‘গাছাল’ বা ‘গাছি’, কোথাও বা ‘শিউলী’। সংস্কৃত ‘শেফালি’ শব্দ থেকে প্রাকৃতে ‘সেহলি’ শব্দটি বাংলায় ‘শিউলী’ হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বঙ্গসমাজের শূদ্র জাতিকে ‘মহাল’ বা ‘শিউলী’ বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘শিউলী’ একটি বিশেষ বৃত্তির নাম। বাগদি সম্প্রদায়ের হাত ধরে শিউলী বৃত্তির সূচনা। বাংলার সুপ্রাচীন ভূখণ্ডের পুণ্ড্রবর্ধন ভূমিভাগে স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছিল শিউলী সম্প্রদায়। দক্ষিণবঙ্গে ও রাঢ়বঙ্গে মুণ্ডা, মাল, বাউরি, হাঁড়ি, নমঃশূদ্র, মাহিষ্য, পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয় প্রভৃতি তফসিলি জাতি ও উপজাতির মধ্যে এই পেশা প্রসারিত হয়। ধীরে ধীরে জীবিকার তাগিদে অন্যান্য অন্ত্যজ হিন্দু ও মুসলমান মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়। নিম্ন গাঙ্গেয় ভূখণ্ডের দারিদ্রসীমা চিহ্নিত প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাগুলি এই সম্প্রদায়ের শিকড়ভূমি। সমাজ ও সময়ের পরিবর্তিত প্রবহমানতায় এক বৃহত্তর শিউলী সম্প্রদায় গড়ে ওঠে সামগ্রিক বঙ্গের গ্রামীণ লোক-সমাজ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে।
শিউলী সমাজের অধিকাংশই বংশ পরম্পরায় গাছ কাটা এবং গুড় তৈরির কাজে যুক্ত। এই অন্ত্যজ শিউলীদের এক বিচিত্র পরিযায়ী জীবন। উত্তরের শীতের দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা যেমন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উড়ে আসে আর শীতের শেষে আবার ফিরে যায় তাদের শীতের দেশে, ঠিক তেমনভাবেই বেশিরভাগ শিউলীরা বেরিয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খেজুর গাছের সন্ধানে। নিজস্ব গাছ নয়, অপরের গাছ কেটে তাদের চিরায়ত পেশাকে আঁকড়ে ধরে থাকে জীবিকার তাগিদে। নদীয়ার দেবগ্রাম, কালীগঞ্জ, ধুবুলিয়া, তেহট্ট থেকে গুড় প্রস্তুতকারী বিভিন্ন মানুষ নভেম্বর মাসে শীতের শুরুতেই ঘাঁটি গাড়েন কেতুগ্রাম ও গঙ্গাটিকুরির আশপাশের গ্রামে। প্রথমেই তারা খেজুর গাছ সমৃদ্ধ কোনও জায়গা বেছে নেয়। তারপর নির্দিষ্ট জমির ওপর খেজুর গাছের মালিকদের কাছ থেকে ইজারা নেয় নির্দিষ্ট অনুপাতে গুড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আবার অনেক জায়গায় প্রতি গাছ পিছু ১০০ টাকা করে দিতে হয় মালিকপক্ষকে।
শিউলীরা তাঁদের মেধাজাত দক্ষতায় অনায়াস ভঙ্গিতে সূর্যাস্তের সময় বা আলোআঁধারি ভোরে গাছে ওঠেন। গাছে ওঠার সময় পরনে মালকোঁচা ছোট লুঙ্গি বা গামছা, তার ওপরে দড়ি দিয়ে বাঁধেন পাটের ছোট বস্তা ‘জোত’– যা তাদের কোমরে ব্যথা লাগা থেকে রক্ষা করে। মাথায় বাঁধেন গামছা। কোমরে বাঁধা বাঁশের হুকে ‘গলাস’-সহ ‘ডাবরি’ বা ভাঁড় ঝুলিয়ে দেন। দু’পায়ে ‘পাউটা’ দড়িসড়পা লাগান– যা গাছে দ্রুত উঠতে সাহায্য করে। কোমরবন্ধ তলপিতে ‘ঝড়োদা’ বা লম্বা অস্ত্র থাকে দু’টি-একটি গাছ ছাড়াতে, স্তর বানাতে এবং অন্যটি চাঁচ দেওয়া বা কাট দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ কাজে লাগে বেশনি বাঁশের কঞ্চির অর্ধাংশ মসৃণ ছোটনালি, যেটি গাছ থেকে রস নির্গমনের প্রধান ও অন্যতম পথ। আর থাকে একটি বেশ শক্ত মোটা দীর্ঘ ‘পাটের কাছি’, যা সমস্ত শরীরের ভার বহন করে গাছের নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছতে সাহায্য করে।
কার্তিক মাস পড়তেই শুরু হয়ে যায় ‘ছাড়ান পর্ব’ অর্থাৎ, গাছের পাতা কেটে পরিষ্কার করা। তারপর ‘চাঁচা’– যেখান দিয়ে রস নির্গত হবে সে জায়গাটার ছাল তোলা এবং ‘ঘাটিমারা’– চাঁচা জায়গাটার মাঝখানে একটা গর্ত করে খেজুর পাতার জিভ তৈরি করা হয়। এরপর শুরু হয় ‘লাগান’ পর্ব, অর্থাৎ রস ঝরতে লাগলে একটা আংটা করে ঠিলি ঝোলানোর কাজ। ‘লাগান’ শুরু হলেই শিউলীদের চোখ-মুখে ফুটে ওঠে আনন্দধারা। তারপর মাঝে মাঝে চলে ‘শুকান’ পর্ব। ‘শুকান’ পর্বের পর যে রস বের হয়, তার চাহিদা খুব। সাধারণত গাছ মালিকরা এই রস দাবি করে থাকেন। একে বলা হয় ‘শুকান কাঠের রস’। কেতাবি ঢঙে নয়, নিজস্ব অভিজ্ঞতায় গাছ মুড়া দিয়ে, চাঁচ দিয়ে, নলি দিয়ে, গোঁজ পুঁতে, ভাঁড় পেতে ঠিলি বোঝাই রস বাঙ্গিতে ঝুলিয়ে শিউলীরা বয়ে নিয়ে আসে বাড়িতে।
এ তো গেল রস সংগ্রহের পদ্ধতির কথা। আসল বিষয় হল, শিউলীদের শুধু গাছে উঠতে-নামতে জানলেই হয় না, গুণ থাকা চাই হাতের। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ‘রস’ গল্পে লিখছেন, ‘যে ধারালো ছ্যান একটু চামড়ায় লাগলেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে মানুষের গা থেকে, হাতের গুণে সেই ছ্যানের ছোঁয়ায় খেজুর গাছের ভেতর থেকে মিষ্টি রস চুইয়ে পড়ে। এ তো আর ধান কাটা নয়, পাট কাটা নয় যে কাঁচির পোঁচে গোড়াসুদ্ধ কেটে নিলেই হল। এর নাম খেজুর গাছ কাটা। কাটতেও হবে, আবার হাত বুলোতেও হবে। খেয়াল রাখতে হবে, গাছ যেন ব্যথা না পায়, যেন কোনো ক্ষতি না হয় গাছের। একটু এদিক-ওদিক হলে বছর ঘুরতে না ঘুরতে গাছের দফা রফা হয়ে যাবে, মরা মুখ দেখতে হবে গাছের। সে গাছের গুঁড়িতে ঘাটের পৈঠা হবে, ঘরের পৈঠা হবে, কিন্তু ফোঁটায় ফোঁটায় সে গাছ থেকে হাঁড়ির মধ্যে রস ঝরবে না রাত ভরে।’
…………………………………………………..
পড়তে পারেন অন্য লেখাও: বাংলার প্রাচীন শ্মশানবন্ধুদের বিয়োগব্যথার গান
………………………………………………….
কিন্তু কেবল গাছ কেটে, বাঁশের বাখারির ভারায় ঝুলিয়ে রসের হাঁড়ি বয়ে আনলেই তো হবে না, রস জ্বাল দিয়ে গুড় করার মতো মানুষ চাই। চাই অভিজ্ঞ পাকা হাত। পুরুষরা গাছ থেকে কেবল রসই পেড়ে আনতে পারে, কিন্তু উনোন কেটে, জ্বালানি জোগাড় করে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে বসে সেই তরল রস জ্বাল দিয়ে তাকে ঘন পাটালি গুড়ে পরিণত করার ভার ঘরের মেয়েদের ওপর। রসকে জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর কাজও শুরু করতে হয় ঊষালগ্নে। তা না হলেই এর স্বাদ নষ্ট হতে শুরু করে। কড়াইয়ে গাছারস ঢেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে জ্বাল দেওয়ার পর্ব। গুড় জ্বাল দেওয়ার কাজটাই সবচেয়ে কঠিন। বেশি জ্বালে অনেক সময়ে গুড় কালচে ও তিতকুটে হয়ে যায়। তাই রস থেকে গুড় তৈরির জন্য জ্বাল দেওয়ার মাঝে মাঝে লোহার মস্ত ছাঁকনি দিয়ে ‘গাদ’ তুলে ফেলতে হয়। কড়াইয়ে সাদা ফেনার মতো ‘গাদ’ জমতে শুরু করলেই শিউলী বউদের মুখ আনন্দে হেসে ওঠে। ‘গাদ’ তুলে ফেলতেই চোখে পড়ে পোড়া বাদামি লালচে রঙের পাকানো গুড়। কড়াই থেকে নতুন গুড়ের মিষ্টি গন্ধে মাতোয়ারা হয় বাতাস। তখন শিউলীদের চোখে-মুখে তৃপ্তি। সারা শরীরে জাগে খুশির ঢেউ। এক কড়াই রস থেকে দশ কেজি মতো গুড় তৈরি হয়। তবে অমৃতস্য গুড়ের আসল চাবিকাঠি হল নিম কাঠ, বেল কাঠ ও আম কাঠ– যা দিয়ে রস জ্বাল দিলে গুড় অত্যন্ত মিষ্টি ও সুবাসিত হয়। তারপর ‘ওরাং’ বা উড়কিমালার সাহায্যে সেই গুড় রাখা হয় আলাদা আলাদা মাটির হাঁড়ি বা বড় বড় ভাঁড়ে। এরপর ‘ভাদালি’ বা সাদা কাপড়ের ওপর নির্দিষ্ট মাপে গুড় জমিয়ে ঠান্ডা করে পাটালি তৈরি করা হয়। বাণিজ্যকরণ শুরু হয় এরপর। শুধু গুড় নয়, গুড় দিয়ে বানানো সন্দেশ, মুড়কি আর নাড়ুরও ব্যাপক চাহিদা থাকে। তখন শিউলীদের সংসারে ভরা সুখ আসে। বয়ে যায় আনন্দের হিল্লোল।
শিউলীরা প্রথমেই চেষ্টা করেন, যার হাতে যতগুলো গাছ আছে, সেগুলোকে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা। এজন্য আশ্বিন-কার্তিকেই গাছের একেবারে ওপরের অংশ চেঁছে ফেলা হয়। একটা খেজুর গাছ তিনবার কাটার পর তাতে নলি লাগিয়ে রসের জন্য হাঁড়ি পাতা হয়। অনেকেই বলেন, এই নল থেকেই নলেন গুড়ের নামকরণ। আবার অনেক গুড় সংগ্রাহকদের মতে, প্রথম রাতে যে রস পাওয়া যায়, তার মান সবচেয়ে ভালো, তাই একে বলে ‘নলিয়ান’ বা ‘নলেন’। অনেকে মনে করেন ব্রজবুলিতে ‘নওল’ বা নতুন থেকে নলেন শব্দটি এসেছে। রঙের জন্য একে আবার ‘লালি গুড়’ও বলেন অনেকে। নলেনের আগেও নাকি শ্রেষ্ঠতম ‘পয়ার গুড়’ পাওয়া যায়। তবে তার মানে শ্রেষ্ঠ হলেও পরিমাণে কম উৎপন্ন হয়। নলেনের পরের কাট থেকে আসে ‘পরনলিয়ান’। এরপরেও একবার রস পাওয়া যায়, তাকে বলে ‘ঝরা রস’। এই রস জোলো। একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দু’বার রস মেলে। ভোরের রসকে ‘জিরেন’ এবং বিকেলের রসকে ‘ওলা’ বলে। একবার কাটার পর পরপর তিনদিন রস পাওয়া যায়। দ্বিতীয় দিনেরটাকে ‘দোকাট’ এবং তৃতীয় দিনেরটাকে বলা হয় ‘তেকাট’। তিনদিন রস সংগ্রহের পর চার-পাঁচদিনের বিরতি দিতে হয়। পৌষ মাসে পুরোদমে রস পাওয়ার পর মাঘ থেকে রস কমতে শুরু করে। ওই সময়ে রসের ঘনত্ব বাড়ে। তবে গাছকাটার পর প্রথম দিকের রসে গুড় ভালো হয়।
…………………………………………………
পড়তে পারেন অন্য লেখাও: গ্রামীণ মেয়েদের গ্রীষ্মদুপুরের আড্ডা কি চিরতরে হারিয়েছে?
…………………………………………………
শিউলীরা অনেকেই বলছেন, ‘ওই সময়ে খেজুর গাছের ধারে দাঁড়ালে সুস্বাদু গন্ধে চারধার ম ম করে।’ এবার সংগৃহীত রস ছেঁকে বড় পাত্রে রাখা হয়। রসের অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে শুদ্ধিকরণ করে তৈরি হয় তরল সোনা। তা জমিয়ে আবার পাটালি। এই কাজের জন্য ফাঁকা খেতেই খেজুর পাতা দিয়ে একটা অস্থায়ী আস্তানা বানায় শিউলীরা। বহু আগে রাতে অবসর বিনোদনের জন্য শিউলীরা ওই চালার পাশেই আগুন জ্বালিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় কবিগান, সুখদুঃখের গল্প করতেন।
বাংলার শিউলী সমাজে বিশেষ সংস্কার ও লোকাচার পরিলক্ষিত। তাঁদের কাছে খেজুর গাছের দেবতা হিসেবে পূজিত হয় শনিদেব এবং ফরিদ সাহেব। শীতের মরসুমে নতুন গাছ ধরা বা মুড়া দেওয়ার আগে প্রত্যেক শিউলী লৌকিক দেবতার আশীর্বাদ পেতে বিশেষ পুজো ও মানত করে থাকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্য। নতুন উনান বা বানশাল তৈরির সময় বাস্তুদেবতার পুজো দেয়। তারপর শুরু হয় মাটি খোঁড়া। এরপর গাছের প্রথম রস থেকে সৃষ্ট অমৃতস্য গুড় বানশালে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয় এবং নতুন মেটে ভাঁড়ে গুড় তুলে তারপর পাটালি তৈরি হয়। এই প্রথম পাটালি স্থানীয় দেবদেবীর থানে হাজত হিসেবে পূজিত হয়।
শুধু গুড় তৈরি নয়, গ্রামের অভাবী মেয়েরা উপার্জনের জন্যে খেজুর পাতা শুকিয়ে খেজুর পাটি তৈরি করে। সেই খেজুর পাটি বিক্রি করে সংসারের জন্য কিছুটা অর্থ সংকুলান হয়। নানা রঙে রঞ্জিত খেজুর পাটির উপর চলে রস খাওয়ার আসর। খেজুর রস গেঁজিয়ে তৈরি ‘তাড়ি’ প্রান্তিক সমাজে সমাদৃত। তা উৎবৃত্ত হলে যে নিম্নমানের গুড় পাওয়া যায়, তা ‘নিকম গুড়’ নামে পরিচিত। নিম্নশ্রেণির আর্থিক অনটনে ‘সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য’ হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। খেজুর পাতা দিয়ে তৈরি হয় এক ধরনের সাহেবি টুপিও। খেজুরের পাতা, ডাল এবং গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। মানুষের জীবন থেকে মৃত্যু– জড়িয়ে থাকে খেজুর গাছ।
বাংলায় পাল ও সেন শাসনকালে খেজুর গুড়ের বিশেষ কদর ছিল। ‘হেমন্তের নূতন গুড়ের গন্ধে আমোদিত বাংলার গ্রামের বন্দনা’র উল্লেখ পাওয়া যায় লক্ষ্মণ সেনের অন্যতম সামন্ত অধিপতি বটুদাসের ছেলে শ্রীধর দাস কর্তৃক সঙ্কলিত ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ নামক সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থে। নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব’-এ উল্লেখ করেছেন সেকথা। এছাড়াও শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে, কৃত্তিবাসের রামায়ণে, বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসামঙ্গলে, বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যচরিতামৃতে খেজুর গুড়, গুড়জাত মিষ্টান্ন, পিঠেপুলি, পায়েস প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম, খেজুরি, বর্ধমান কাটোয়ার খাজুরডিহি গ্রাম, নদীয়ার কল্যাণী, মুর্শিদাবাদের পলাশি, জয়নগর, মগরাহাট, ক্যানিং প্রভৃতি এলাকার গুড় একসময় তমলুক বন্দরের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হত।
এত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুর গাছ। নিতান্ত অনাদরে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছ নলেন গুড়ের আঁতুড়ঘর। নগরায়ন ও উন্নয়নের জোয়ারে কমছে খেজুর গাছ। কখনও রাস্তা তৈরিতে তার ঘাড়ে কোপ পড়ে, কখনও ইটভাটার আঁচ জ্বালতে। রস জোগাবে কে? আগে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ থেকেই বাজার ভরে যেত গুড়ে। ইতুলক্ষ্মীর ঘট বিসর্জনের আগে নতুন গুড়, চাল গুঁড়ি দিয়ে পিঠে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে। নতুন গুড়ের গন্ধে সুবাসিত হত চারদিক। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে শীতের আয়ু হয়েছে ক্ষীণ। অথচ যত শীত পড়বে, রসের স্বাদ হবে তত ভালো। আবার সঙ্গতও চাই পশমি রোদের। মেঘলা হলে রসে টক ভাব চলে আসে। তাই আকাশে মেঘ জমলেও মুশকিল, ভালো গুড় মিলবে না। আর ভালো রস চেনা, তা থেকে গুড় তৈরির মতো অভিজ্ঞ মানুষও কমে আসছে ধীরে ধীরে।
শিউলীদের রোজগার বলতে বছরের পাঁচ মাস। বাকি সময়ে কেউ কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। আবার অনেকে বর্ষাকালে চাষের সময় খেতমজুরেরও কাজ করেন। তাছাড়াও এক কলসি গুড় তৈরি করতে একটি শিউলী পরিবারের যে সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়, তার ন্যূনতম মূল্য তাদের হাতে আসে না। কারণ মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণির কৌশল ও মুনাফা লাভের চতুরতার কাছে শিউলীরা হার মানতে বাধ্য। সস্তার চিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেতে বসেছে গুড়শিল্প। টিকে থাকার লড়াইয়ে খাঁটি গুড়ে মিশেছে ভেজাল সংস্কৃতি। এছাড়াও খেজুর রস ফোটাতে প্রচুর জ্বালানি লাগে। আগে আশপাশের জঙ্গল, ঝোপঝাড় কেটে সংগ্রহ করা হত জ্বালানি, এখন সেই জঙ্গলও নেই। জ্বালানির এত খরচ করে তৈরি গুড় বিক্রিতে আর লাভ হচ্ছে না। যার জন্য খেজুর গাছ থাকলেও রস সংগ্রহের শিউলী মিলছে না। যারা আগে দাপিয়ে বেড়াতেন খেজুর গাছ, নিয়ে আসতেন হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি খেজুর রস, তাঁরা এখন বৃদ্ধ, শিরওঠা হাত কেঁপে ওঠে। এক শিউলীর কথায়, ‘শীত এলে একরকম মনের টানেই গাছ জুড়ে গুড় তৈরির কাজে লেগে পড়ি। কিন্তু বয়স এখন আর সঙ্গ দিতে চায় না। নতুন করে এই কষ্টসাধ্য কাজ কেউ শিখতেও চায় না।’ শিউলীদের মতে, খেজুর গুড় শিল্প ক্রমশ অনিশ্চয়তার আবর্তে এগিয়ে চলেছে।
বাংলার আবহমান ধারায় শরতের শিউলীর সঙ্গে হাজির হয় শীতের শিউলীরা। তাদের ধৈর্য, অধ্যবসায় ও শৈল্পিক দক্ষতায় খেজুর রস থেকে গুড় তৈরি হয়। এ এক লোকশিল্প কর্ম। আজ বিলুপ্তির পথে এই শিল্প। কিন্তু যদি ফিরিয়ে দেওয়া যায় শিউলীদের স্বপ্ন, যদি তাঁরাও দেখেন যে এই পেশায় থেকেও স্বচ্ছলভাবে সংসার চালানো যায়, তবেই তো সাহস করে পরবর্তী প্রজন্ম হাঁড়ি বাঁধতে গাছে উঠবে। এই দায়টাই তো আসল। শিউলীদের পরিশ্রম চেনানোর দায়। গ্রামীণ অর্থনীতির বুকে প্রান্তিক শিউলী বৃত্তিকে একটা স্থায়ী জায়গা করে দেওয়ার দায়। শিউলীদের সন্তানদের হাতে একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে দেওয়ার সফরেই ফিরবে বাংলার হারিয়ে যাওয়া শিউলীদের সংস্কৃতি।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যে মন্ত্রিত্বই তাঁর হাতে থাক, বুদ্ধদেব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে অতি নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতির মতো। ‘আপনারা বুদ্ধর কাছে যান, বুদ্ধ ওসব কালচার-ফালচার বোঝে’– জ্যোতিবাবুর এই উক্তি যথার্থ কি না জানি না, কিন্তু কথাটা মিথ্যে ছিল না।