প্রায় বিনি পয়সার সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনও কনটেন্ট নিয়ে রিল বানিয়ে, ভিডিও পোস্ট করে যেখানে কেউ ‘সিউডো সেলেব’ হয়ে অর্থ উপার্জন শুরু করেছেন, সেখানে শিশুটি যে ছাড় পাবে না– বলাই বাহুল্য। তার আধো আধো বুলি, মিষ্টি কথা ও প্রতিবেশের নকলে খিস্তিখেউড় সহজেই বেচা যায়। পরকীয়া থেকে সংসারের কূটকচালি– সবেতেই তাদের ইঁচড়ে পাকা সংলাপ দর্শক শ্রোতার কান টেনে ধরে রাখে। সব এখন ‘পণ্য’। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে নিজের কন্যাটিকে হ্রস্ব কাপড় পরিয়ে শরীরী ইঙ্গিত মূলক গানের সঙ্গে নাচাচ্ছি। দক্ষ করে তুলছি ভ্রুবিভঙ্গে, লাস্য উল্লাসে।
প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক
খেয়াল করে দেখবেন, সারা পৃথিবীর সেলেবকুল তাঁদের সদ্য-জন্মানো সন্তানদের আগমন বার্তা যতটা আদিখ্যেতার সঙ্গে দিতে থাকেন, বাচ্চা জন্মের পর কিন্তু মুখটি পিছন ফেরানো বা অদৃশ্য। এরপর আমরা তাঁদের বাচ্চাদের বড় হওয়া দেখি। সেখানেও মা বাবা বা ন্যানির কোলে বেশ ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে সরল পোশাকেই বসে থাকে। বড়দের অনুকরণে উদ্ভট নাচগান বা পোশাক পরে না তারা।
কিন্তু আমি, আপনি, আমাদের অপূর্ণ যশাকাঙ্ক্ষায় বা কখনও কখনও অর্থ উপার্জনের কারণেও খুকিটিকে ‘সেলেব’ বানাতে গিয়ে তার জীবন বিপন্ন করে ফেলি। খোকাকে বেচতে গেলে বাজার তেমন খায় না। তাকে একটু বিশেষ পরিশ্রম করে গান-নাচ শিখতে হয় কিন্তু খুকিটিকে ‘পণ্য’ করে তোলা যায় নিমেষে। দুঃখের বিষয়, এতে মায়েদের ভূমিকা থাকে বেশি। অনেক সময় অজান্তে বিখ্যাত হওয়ার ঝোঁক থেকে তাঁরা অভূতপূর্ব সব রিল বানাতে থাকেন!
………………………………………………………..
ইদানীং আমরা দেখেছি, শিম্পাঞ্জি মোবাইল ফোনে খটাস করে ছবি তুলে ফেলছে, গরিলা দিব্যি ট্যাবে ছবি দেখছে! হাতিও ছবি-টবি এঁকে নিলামে টাকা করছে। এই যে তিনটি প্রাণীর কথা বললাম, তারা তো প্রাণী হিসেবে খারাপ নয়, অল্প বুদ্ধিও নয়। দিব্যি ফল শাকসবজি ঘাস খায়-টায়, গোষ্ঠীর মধ্যে প্রেম মারপিট সব করে, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই গ্যাজেটের ব্যবহার জানে না, ওটি মানুষ তাকে শাস্তি দিয়ে বা খাদ্যের প্রলোভন দেখিয়ে শিখিয়েছে।
………………………………………………………..
ইদানীং আমরা দেখেছি, শিম্পাঞ্জি মোবাইল ফোনে খটাস করে ছবি তুলে ফেলছে, গরিলা দিব্যি ট্যাবে ছবি দেখছে! হাতিও ছবি-টবি এঁকে নিলামে টাকা করছে। এই যে তিনটি প্রাণীর কথা বললাম, তারা তো প্রাণী হিসেবে খারাপ নয়, অল্প বুদ্ধিও নয়। দিব্যি ফল শাকসবজি ঘাস খায়-টায়, গোষ্ঠীর মধ্যে প্রেম মারপিট সব করে, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই গ্যাজেটের ব্যবহার জানে না, ওটি মানুষ তাকে শাস্তি দিয়ে বা খাদ্যের প্রলোভন দেখিয়ে শিখিয়েছে। ঠিক এভাবেই প্রায় অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত মানুষেরাও তথাকথিত শিক্ষিতদের বিজ্ঞাপন প্ররোচনায় পা দিয়ে চটজলদি খ্যাতির লোভে নিজের সন্তানের বিনা অনুমতিতে ব্যক্তিগত জীবন উন্মুক্ত করে দিচ্ছে।
রাষ্ট্র শিশুদের পরিণত বয়স্কদের সমান কিছু অধিকার দিয়েছে। শিশুকে শ্রমের মাধ্যমে রোজগার করানো যাবে না। তার নিজস্ব শিক্ষার অধিকার-সহ স্বাস্থ্যকর ও হিংসামুক্ত পরিবেশে থাকা, স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা রক্ষা, সর্বাঙ্গীণ বিকাশ নিশ্চিত করা ছাড়াও তাকে কোনভাবেই ‘অ্যাবিউজ’, ‘এক্সপ্লয়েট’, ‘নেগলেক্ট’ করা যাবে না। এই অধিকারগুলো অবশ্য সোনার পাথরবাটি হয়ে থেকে গেছে। কন্যাভ্রূণ হত্যা বা তাকে জন্মের পর মেরে ফেলে কুয়োয়, ডাস্টবিনে, শ্মশানে ফেলে আসা তো আকছার ঘটছে। আবার বেঁচে থাকা কন্যাটিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা-বাবা নানাভাবে ব্যবহার করে চলেছে। বিকিনি সমুদ্র তটে শোভনীয়, এমনকী, তর্কযোগ্য হলেও পরিণত বয়সিদের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাতেও, কিন্তু কোনওভাবেও সে পোশাক শিশুদের জন্য নয়। শিশু চিরকাল সুন্দর মাতৃক্রোড়ে। একসময় ‘বেবি শো’ নামে এক প্রতিযোগিতা জনপ্রিয় ছিল। বেবি ফুড খাওয়া হৃষ্টপুষ্ট বাচ্চাকে ‘স্বাস্থ্যবান মনে করে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে গর্বিত মায়ের কোলে রাখা হত । স্বাভাবিকভাবে অবোধ বাচ্চাটির অনুমতি নেওয়ার প্রশ্ন ছিল না। সে সময়ের সমাজে এই প্রশ্নটি করার মতো সচেতনতাও ছিল না।
কিন্তু এই সময়, যখন পান থেকে চুন খসলে মানুষ প্রতিবাদ করে, সেখানে শিশুদের ‘পণ্য’ তৈরি করার বিষয় খাপ-সমাজ আশ্চর্য রকম নীরব! ছবি আঁকা, আবৃত্তি, নাচ-গান ঠিক আছে কিন্তু অভিনয়ের জগতে এলেই বিপদের সম্ভাবনা বাড়ে। শিশুশিল্পীরা আগেও সিনেমায় কাজ করেছে। বেশিরভাগ সময় তাদের নায়ক-নায়িকার শৈশবের ভূমিকায় অভিনয় করতে হত। সেক্ষেত্রেও শিশুশিল্পী হিসেবে আসা নীতু সিং, সারিকা বা আরেকটু বেশি বয়সে অভিনয় করতে আসা রেখা– কেউই সেই হারানো শৈশব নিয়ে খুশি থাকেননি। থাকাটা সম্ভব নয়। নষ্ট শৈশবের জন্য প্রকাশ্যে পরিবারের প্রতি বিরক্তি দেখিয়েছেন। এঁদের অল্প বয়সে কাজ করতে আসার নেপথ্যে ছিল তাঁদের মায়েদের উদগ্র ও অপূরণীয় বাসনা পূরণের ইচ্ছা। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু পরিবারে একাধিক সদস্য পালনের জন্য এই বাংলাতেও আমরা অনেক অভিনেত্রীকে খুব অল্প বয়সে অভিনয় জগতে আসতে দেখেছি। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা যে সুখকর ছিল না, পরবর্তীকালে তাঁরা জানিয়েছেন। মোদ্দা কথা, এগুলির নেপথ্যে ছিল পরিবারের তরফে ‘এক্সপ্লয়টেশন’। এক কথায় বলা যায়, পিতা-মাতার ইচ্ছা পূরণের ও অর্থ উপার্জনের জন্য শিশুশ্রম দান। কিন্তু ইদানীং যে প্রবণতাটি তৈরি হয়েছে, সেটি খানিক ভিন্ন। প্রায় বিনি পয়সার সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনও কনটেন্ট নিয়ে রিল বানিয়ে, ভিডিও পোস্ট করে যেখানে কেউ ‘সিউডো সেলেব’ হয়ে অর্থ উপার্জন শুরু করেছেন, সেখানে শিশুটি যে ছাড় পাবে না– বলাই বাহুল্য। তার আধো আধো বুলি, মিষ্টি কথা ও প্রতিবেশের নকলে খিস্তিখেউড় সহজেই বেচা যায়। পরকীয়া থেকে সংসারের কূটকচালি– সবেতেই তাদের ইঁচড়ে পাকা সংলাপ দর্শক শ্রোতার কান টেনে ধরে রাখে। সব এখন ‘পণ্য’। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে নিজের কন্যাটিকে হ্রস্ব কাপড় পরিয়ে শরীরী ইঙ্গিত মূলক গানের সঙ্গে নাচাচ্ছি। দক্ষ করে তুলছি ভ্রুবিভঙ্গে, লাস্য উল্লাসে। গর্বিত হৃদয়ে আসলে জানছিই না, আমার আপনার অজান্তে ডার্ক ওয়েবের অন্ধকার জগতে শিশু কন্যার ফুল্লকুসুমিত ওষ্ঠাধর মিশে যাচ্ছে ভার্চুয়াল নরক দংশনে। যা ছিল স্নেহের ধন আমাদের, তা পরিণত হয়ে গেল অকাল ভোগে। যা ছিল ভোরের শিশির, তা পরিণত হল বিকারের একতাল মাংস পিণ্ডে। আপনি রণে-বনে-জঙ্গলে রিল বানিয়ে কন্যাটিকে মঞ্চে তুলে মার্জার পদক্ষেপে বা ‘কাঁটা লাগা গান’-এর মোচ্ছবে উল্লসিত হলেন, মনে রাখবেন আপনার খুকিটি চিরকাল আধো আধো গলায়, আকর্ষণীয় ‘মানবী রেপ্লিকা’ হয়ে থাকতে পারবে না। তার মতো অজস্র শিশু এই মনোরঞ্জনে নেমে পড়েছে। বয়স বেড়ে গেলে এই মনোযোগ সে আর পাবে না।
তার নিষ্পাপ শৈশব তার উপকার হবে ভেবে কেড়ে নিলেন আপনি। মনে রাখবেন, তার অনুমতি দেওয়ার মতো যুক্তিবোধ বা মানসিক পরিপক্বতা তৈরি হয়নি বলে জন্মদাতা দাত্রী বলেই স্রেফ সুযোগ নিলেন। বাচ্চাটি নাচলো ওই কাচ-বিছানো পথে, ‘যব তক হ্যায় জান’ শুনে আপনি সাফল্যে, আনন্দে, গর্বে ফেটে পড়লেন। খবর নিয়ে দেখলেন না কত রকম মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে বাধ্যতায় ওই দক্ষতা এল তার। সার্কাসের জীবজন্তু মারের চোটে ও অভুক্ত অবস্থায় নিখুঁত খেলা দেখায়। হাতি ছবি আঁকে কঠিন নির্দেশ, মনের আনন্দে নয়। এক সময় যে কোনও শিল্পকলার ক্ষেত্রে প্রস্তুতিকাল বলে একটি সময় থাকত। দীর্ঘ সময় ধরে তালিম নিয়ে পরিণত বয়সে সে স্টেজ পারফর্ম করত।
কিন্তু এখন অনন্ত ও নির্বিচার ভোগবাদ গ্রাস করে নিয়েছে সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনা। চটজলদি চটকদার সাফল্যের লোভে বুঁদ হয়ে গিয়েছি আমরা। অত সময় কোথায় আমাদের পরিণত ও যোগ্য হয়ে ওঠার?
তাই শিশু পর্নোগ্রাফির সার্চ-এ ভরে উঠল আমাদের বিকার উৎসব। দায় যদি ভোক্তার হয়, চাহিদার জোগান দিল কারা? সে তার দায় নেবে না? এখন দেখি সবই বিক্রি হয়, সবই বাজার অর্থনীতি। চাহিদা ও জোগানের কুৎসিত রাজনীতিতে আমার সন্তানটিকে তবে কি আমি ভুলে গেলাম? তবে যে একসময় ভেবেছিলাম, বলার কথা ছিল উল্টোটাই?
‘ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর /আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’
শঙ্খ ঘোষ