ভুয়ো খবর এমন পর্যায়ে গেছে, যে মানুষ সত্যি আর মিথ্যের তফাত করতে পারছে না। আর. জি. করের নৃশংস ও ঘৃণ্য ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরপরেই যেভাবে সমাজমাধ্যমে, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়ল, তা দেখে শুনে মনে হচ্ছে, মানুষজন ওই ঘটনার বিচারের চেয়েও অনেক বেশি উৎসুক ভুয়ো খবরে বিশ্বাস রাখতে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, তিলোত্তমার বিচারের দাবি চলে গিয়েছে পিছনের সারিতে, সামনে চলে এসেছে ডাক্তারদের কাজের জায়গায় নিরাপত্তার দাবি। যদিও সেটাও ন্যায্য দাবি, তা নিয়েও কথা বলা উচিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও যে ঘটনার অভিঘাতে এত বড় আন্দোলন সংগঠিত হল, তার সুবিচার যদি না হয়, তাহলে আর লাভ কী?
সারা দেশে এখন ভুয়ো খবরের ছড়াছড়ি। মানুষ যত আধুনিক হয়েছে, যত প্রযুক্তি-নির্ভর হয়েছে, দেখা যাচ্ছে সে তত বেশি ভুয়ো খবরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, গত ১০ বছরে এই ভুয়ো খবরের রমরমা বেড়েছে। মূলত ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ হয়ে উঠেছে এই ভুয়ো খবর ছড়ানোর সামাজিক মাধ্যম। একটা সময়ে আমরা জানতাম ধর্ম হচ্ছে আফিম। কিন্তু এখন স্মার্টফোন হচ্ছে সেই আফিম, যা দিয়ে আজকের সময়ের সব বয়সি মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখা যাচ্ছে। ফেসবুক বা টুইটারের মতো সমাজমাধ্যমে তাও বোঝা যায়, কে বা কারা এই ভুয়ো তথ্যের উৎস, কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে সেটুকুও বোঝার উপায় নেই।
ভুয়ো খবর এমন পর্যায়ে গেছে, যে মানুষ সত্যি আর মিথ্যের তফাত করতে পারছে না। আর. জি. করের নৃশংস ও ঘৃণ্য ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরপরেই যেভাবে সমাজমাধ্যমে, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়ল, তা দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মানুষজন ওই ঘটনার বিচারের চেয়েও অনেক বেশি উৎসুক ভুয়ো খবরে বিশ্বাস রাখতে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, তিলোত্তমার বিচারের দাবি চলে গিয়েছে পিছনের সারিতে, সামনে চলে এসেছে ডাক্তারদের কাজের জায়গায় নিরাপত্তার দাবি। যদিও সেটাও ন্যায্য দাবি, তা নিয়েও কথা বলা উচিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও যে ঘটনার অভিঘাতে এত বড় আন্দোলন সংগঠিত হল, তার সুবিচার যদি না হয়, তাহলে আর লাভ কী?
এটা বলতে দ্বিধা নেই, এই গুজবের স্রোত এবং এই ভুয়ো খবরের রমরমাকে সচেতনভাবে বন্ধ না করলে সুবিচারের বিশেষ আশা নেই। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেমন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী, তেমনই ভারতের এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা– এটা বিশ্বাস করানো হয়েছে, গত দশ বছরে। তাই সাফল্য না পেলেও, তাদের নিয়ে মানুষের আদিখ্যেতার শেষ নেই। গত দশ বছরে, যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় এই কেন্দ্রীয় সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার একটিতেও কিন্তু চার্জশিট দিয়ে উঠতে পারেনি তারা। তাদের কাজের পদ্ধতি দেখেশুনে এতদিনে এটুকু বোঝা গেছে, এই সংস্থা প্রথমে সন্দেহভাজন কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। তারপর বলে ৯০ দিন বাদে চার্জশিট দেব। ৯০ দিন শেষ হলে আদালতের কাছে আরও ছ’মাস সময় চায়। ছ’মাস শেষ হলে জগাখিচুরি কিছু কাগজপত্র জমা করে বলে সাপ্লিমেন্ট, অর্থাৎ আরও কিছু সংযোজনী দেওয়া হবে আরও কিছুদিন পরে। তারপর কোনও একদিন সেই সংযোজনী দেয় আর বলে, এতে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আরও তথ্য চাই। সব শেষ হলে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, প্রমাণটা কই, তখন তারা বলে, ওটা তো মিডিয়া বা গণমাধ্যম থেকে দেখে লেখা হয়েছিল। ফলে অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।
এবার আসা যাক, ভারতের গণমাধ্যম প্রসঙ্গে। গত দশ বছরে, আমরা যেমন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে পেয়েছি, তেমনই আমরা তাঁর গুণগান গাওয়া এক অসাধারণ গণমাধ্যমও পেয়েছি। কোনও একটা ঘটনা ঘটলে যেন ওই গোদি-মিডিয়াতে উৎসব লেগে যায়! প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, কে কত ব্রেকিং নিউজ করতে পারে, কে কত ‘বিশেষ’ বা ‘স্বতন্ত্র’ খবর করতে পারে। তারা অবশ্য সাংবাদিকতার শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সূত্র মারফত প্রাপ্ত খবর বলে, তারা কোনও দিনই সেই সূত্র প্রকাশ করে না। প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প তৈরি হয়, তার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, মানুষজনের কাছে এমনভাবে তা পরিবেশিত হয় যে, তা বিশ্বাস না করে কোনও উপায় নেই। চারিদিক থেকে বোমাবর্ষণের মতো এমনভাবে খবর আসতে থাকে যে, আমি আপনি তা বিশ্বাস করতে বাধ্য। প্রতিটি গণমাধ্যমের খবরের মধ্যে একটাই সাদৃশ্য, প্রতিটি খবরেই অপরাধীকে চিহ্নিত করে, তারপরে তার ওপরে অপরাধ আরোপ করা হয়। এইসব খবর দেখানো এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অতি সক্রিয়তা মিটে যাওয়ার পর, অভিযুক্ত জামিন পাওয়ার পরে যখন প্রশ্ন করা হয়, এগুলো তো মিলল না, তখন তারা বলে, ওটা তো সিবিআই সূত্র থেকে দেখে পরিবেশিত হয়েছিল।
…………………………………………………
কোভিডের সময়ে বাবা রামদেব পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তাদের ওষুধ খেলে কোভিড সারবে। তারপরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন তাদের সংস্থাকে চেপে ধরে, এবং ক্ষমা চেয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে বলে, তারা কি একই মাপের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল? হ্যাঁ, তারা ক্ষমা চেয়েছিল, তবে তা প্রাথমিকভাবে ছিল আগের বিজ্ঞাপনের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র, যা মানুষের চোখে পড়বেই না।
…………………………………………………
কে যে কার সূত্র থেকে লেখে, তা বলা মুশকিল। তবে গোদি-মিডিয়া আর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, তা এতদিনে জলের মতো পরিষ্কার এবং দু’পক্ষই যে রাজনীতি করছে তা নিশ্চিত আর বলে দিতে হবে না। তাতে আর যাই হোক, কোনও দিনই অপরাধী যে শাস্তি পাবে না, তা বলাই বাহুল্য। আপনি আমি রোজ হাঁ করে এই পরিবেশনা গেলার চেষ্টা করব আর ভাবতে থাকব, একদিন সমস্ত অপরাধ মুক্ত হবে আমাদের পারিপার্শ্বিক। তারপরে একদিন সকাল থেকে আবার অন্য প্রসঙ্গ অন্য গল্প।
এবারের আর. জি. করের ঘটনা নিয়েও সিবিআই যে তদন্ত করছে, তাও মোটামুটি একই গড্ডালিকা প্রবাহে চলছে। আসলে হয়তো নানা কারণে এই সরকারের প্রতি ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল, যা প্রকাশ পাচ্ছিল না, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, হাজারও মিথ্যে বা ভুয়ো খবর। মানুষ যত রাস্তায় বেড়েছে, তত বেড়েছে এই মিথ্যে খবর। এক স্বনামধন্য চিকিৎসক বললেন, উনি নিজে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেছেন এবং তিনি নিশ্চিত করে এটাও বলে দেন, যে মৃতার শরীরে ১৫০ গ্রাম বীর্য পাওয়া গেছে! আমরা যেহেতু ধরেই নিয়েছি, যে ‘তিলোত্তমা’ কোনও একজন মানুষের লালসার শিকার নন, তিনি বেশ কিছু দুর্নীতি জানতে পেরে গিয়েছিলেন, তাই তাঁকে গণধর্ষণ করে মারা হয়েছে, আমরাও দুই আর দুই যোগ করে অঙ্ক মিলিয়ে ফেললাম। তারপরে সেই চিকিৎসক তাঁর নিজের ভুল স্বীকার করেছেন কি না তা জানা নেই, যদি করেও থাকেন, তা কি একই মাত্রায় এই গণমাধ্যমগুলোতে সম্প্রচারিত হয়েছিল? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে কেন দুঃখ প্রকাশ করলেন না তারা?
………………………………………………….
আরও পড়ুন রত্নাবলী রায়-এর লেখা: ধর্ষণ আর যৌনকামনাকে এক আসনে বসানো এক ঘৃণ্য প্রবণতার অতিসরলীকরণ
………………………………………………….
কোভিডের সময়ে বাবা রামদেব পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তাদের ওষুধ খেলে কোভিড সারবে। তারপরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন তাদের সংস্থাকে চেপে ধরে, এবং ক্ষমা চেয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে বলে, তারা কি একই মাপের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল? হ্যাঁ, তারা ক্ষমা চেয়েছিল, তবে তা প্রাথমিকভাবে ছিল আগের বিজ্ঞাপনের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র, যা মানুষের চোখে পড়বেই না। আসলে সবাই মিলে আমাদের বোকা বানিয়েই চলেছে এবং আমরা বোকা বনেই চলেছি।
এসবের মধ্যে সত্যি কিছু থাকতেই পারে, কিন্তু কোনও স্থির মস্তিষ্কের লোকের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না। বোঝা যেত যদি সিবিআই নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলন করে বা অন্য কোনও উপায়ে জানানোর ব্যবস্থা করত। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সিবিআই বা ইডির কাছে এই দাবিটাই জানানোই যায়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, এক অনিবার্য পরিণতির দিকে যাচ্ছে, যেখানে বিচারে সাজা দেওয়া ব্যাপারটাই অর্থহীন হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। ওই জন্যই যে কোনও গুজবের সক্রিয় বিরোধিতা করা উচিত। সুবিচারের স্বার্থেই। এবং আজ অবধি যা হয়েছে সে তো ভালো-মন্দ মিশিয়ে হয়েছে, কিন্তু এবার সিবিআইকে চাপ দেওয়ার দিকে নজর দেওয়া উচিত, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল বা নাগরিকদের পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত কোনও দাবি করা হয়েছে বলে জানা যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ স্মরণ করুন। প্রথম গান।
চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে।
চোর চাই।
যে করেই হোক চোর চাই।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….
আমার বা আপনার আকাঙ্ক্ষা যেন এরকম না হয়ে যায়। আজকের সিবিআই এবং অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার কর্মকাণ্ড এবং গোদি-মিডিয়া দেখে রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো বলা কি অন্যায় হবে? অপরাধী বেছে নিয়ে, তার ওপর অপরাধ চাপিয়ে দেওয়া কি কখনও তদন্তের সঠিক পদ্ধতি হতে পারে?