এই প্রশ্ন করতে করতে ভেবেছি, মেয়েদেরও নাকি কম ঝামেলা! ‘দ্য অন্টলজি অফ পারফরম্যান্স’-এ আমেরিকান নারীবাদী তাত্ত্বিক পেগি ফেলান বলছেন, একজন নারী যখন ‘পারফর্মার’, পারফরম্যান্সে তাঁর উপস্থিতি ক্ষমতার কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ কাঠামো কার? এ কাঠামো পুরুষতন্ত্রের। এই ‘দৃশ্যমানতার অর্থনীতি’ রুখে দিতে উপস্থিতি ব্যতিরেকেও, নারী শিল্পীর প্রয়োজন ‘পরিকল্পিত’ অনুপস্থিতির। গিরিজা দেবীর সমগ্র জীবনকে, তাঁর জীবনধারাকেও যদি একটি পারফরম্যান্স হিসেবে গণ্য করা হয় (তত্ত্বমতে তো তাও হওয়ার কথা), তবে জনতার শ্রবণ এবং দৃষ্টি থেকে তিনি মধ্যে মধ্যে অব্যাহতিও নিয়েছেন। ধারাবাহিক ভাবেই নিয়েছেন। এই অব্যাহতির কতখানি সচেতনভাবে পরিকল্পিত, তার আন্দাজ আমি না করতে পারলেও, এই ‘ধারাবাহিক’ অব্যাহতিকে কাঠামোর বাইরে অন্য একটি কাঠামো নির্মাণের প্রতীক হিসেবে দেখি, সংগ্রামের মন্ত্র হিসেবে দেখি।
আজকে ‘চারকলি’ শেষ হয়ে যাবে। কালানুক্রমিক বিন্যাসেই এই সিরিজে গিরিজা দেবীর নাম এল সবচেয়ে শেষে। গওহর জান, সিদ্বেশ্বরী দেবী, বেগম আখতার– সকলেরই তিনি কনিষ্ঠ। কারও কারও তো বন্ধুও, সহোদরা সমান। ঠুমরি-সম্রাজ্ঞী গিরিজা দেবী গাইতে এসেছিলেন তখন, যখন মহিলা শিল্পীরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে থাকতে কিছুটা মাটি নিজেদের নামে লিখিয়েই নিয়েছিলেন একপ্রকার। কিছুটাই যদিও। অর্থাৎ, ততদিনে এ কথা বুঝতে জনতার আর বাকি নেই যে, মেয়েরাও গাইবে, সর্বসমক্ষে গাইবে, গাইবে উস্তাদেরই মেজাজে, ঠাঁটে, সম্মানেও। তৈরি খেলায় খেলতে নামা যেমন সহজ, কঠিনও তো ততখানিই। তৈরি খেলায় জেতানোর দায় থাকে বেশি– শিল্পীর নিজেরই কথা শুনে-শুনে, পড়ে-পড়ে জেনেছি। গিরিজা দেবী বলেছেন, গাইতে আসার ঝক্কি তাঁর তুলনায় ছিল কম। কেশর বাই, রসুলন বাই, আখতারি বাইয়ের মতো শিল্পীদের লড়াই দেখে নতুন করে তাঁকে স্পর্ধার খোঁজ করতে হয়নি। কেবলই ভেবেছেন, নতুন যে ধারাটি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সংগীত জগতে প্রতিষ্ঠিত হল, তার যেন তিনি সুযোগ্য মর্যাদা রাখতে পারেন। পেরেছিলেন যে, সে কথা আমার বলার অপেক্ষা রাখে কী?
গিরিজা দেবীর জন্ম ১৯২৯ সালে, বারাণসীর গ্রীষ্মে। প্রথম গুরু তাঁর বাবা, রামদেও রাই। সংগীত-পাগল সেই স্বর-সম্রাট-জমিদারের তেমন পরিচিতি জোটেনি শিল্পী হিসেবে। মেয়েকে শিখিয়েছেন প্রাণ ঢেলে। যেন, তাঁর অপূর্ণ স্বপ্নের সবটা পূরণ হবে মেয়ের হাত ধরেই। হয়েছেও তাই। শিখতে শিখতে স্বরস্থানে খানিক সড়গড় হলেন যখন, গিরিজা দেবী বাবার হাত দু’খানি ছেড়ে গেলেন বৃহত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পথে। শিক্ষা সম্পন্ন হতে, গাইতে-দিতে-নারাজ মা-কে রাজি করিয়ে পেশাগত সংগীত জগতে প্রথম পা রাখলেন সযত্নেই। রেডিও হয়ে সরাসরিই এলেন পাবলিক কনসার্টে। শুরু থেকেই সকলে তাঁর গান শোনে, আর ধন্য ধন্য করে। ফিরে তাকাননি। তাকাতে হয়নি।
……………………………………..
গোড়াতেই একবার বললাম, গিরিজা দেবীর নাম হয়েছিল– ‘ঠুমরি সম্রাজ্ঞী’। আগে দু’জনের কথা বলেছি ঠুমরি প্রসঙ্গে– রসুলন বাই আর সিদ্ধেশ্বরী দেবী। দু’জনেই ঠুমরির দিকপাল। ধারা অনুপাতে সুবিস্তৃত পরিচিতি লাভ করলেও, হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে ‘উপশাস্ত্রীয় সংগীত’ হওয়ার ‘মান্যতা’ই পেয়েছে ঠুমরি বরাবর। তার চেয়ে অধিক কিছু নয়। ঠুমরি– সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস মতে ‘তোওয়াইফ ঘরানার গান’। পড়ে পাওয়া, পড়ে থাকা মানটুকুও হারাতে বসল সেই ইতিহাস নির্মাণের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। পুনরায় সেই ঠুমরিকে প্রতিষ্ঠিত করার এক অঘোষিত অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিলেন উল্লেখিত তিন শিল্পীই।
……………………………………..
কৈশোরে তাঁর বিচরণক্ষেত্রের কেন্দ্রে ছিল ধ্রুপদ-ধামার। একটু একটু করে ‘উপশাস্ত্রীয় সংগীতে’ দক্ষতা অর্জন করেন শুরু করেন। তখনও গিরিজা দেবী মোটে জানতেন না, এই ‘উপশাস্ত্রীয় সংগীতই’ তাঁকে একদিন পৌঁছে দেবে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে। চাই কী, বিশ্বের দরবারেও। প্রতাপশালী এত যে শিল্পী গিরিজা দেবীর পূর্বে গাইলেন, তাঁদের থেকে গিরিজা দেবীর গায়নশৈলীকে কী পৃথক করল? গিরিজা দেবীর সংগীত পরিবেশনার অন্যতম আকর্ষণই ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর দক্ষতার সমান্তরালে বিহার এবং পূর্ব উত্তরপ্রদেশের আঞ্চলিক সংস্কৃতির সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলির অকৃত্রিম প্রকাশটি। ঠুমরি শুধু না, আবেগে-দরদে গিরিজা দেবী দাদরা, কাজরি, চৈতি, টপ্পা-সহ নানা ধারাকেও শ্রোতাদের মনে জায়গা করে দেন।
গোড়াতেই একবার বললাম, গিরিজা দেবীর নাম হয়েছিল– ‘ঠুমরি সম্রাজ্ঞী’। আগে দু’জনের কথা বলেছি ঠুমরি প্রসঙ্গে– রসুলন বাই আর সিদ্ধেশ্বরী দেবী। দু’জনেই ঠুমরির দিকপাল। ধারা অনুপাতে সুবিস্তৃত পরিচিতি লাভ করলেও, হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে ‘উপশাস্ত্রীয় সংগীত’ হওয়ার ‘মান্যতা’ই পেয়েছে ঠুমরি বরাবর। তার চেয়ে অধিক কিছু নয়। ঠুমরি– সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস মতে ‘তোওয়াইফ ঘরানার গান’। পড়ে পাওয়া, পড়ে থাকা মানটুকুও হারাতে বসল সেই ইতিহাস নির্মাণের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। পুনরায় সেই ঠুমরিকে প্রতিষ্ঠিত করার এক অঘোষিত অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিলেন উল্লেখিত তিন শিল্পীই। যে ঠুমরি গাইতে গাইতে রসুলন শেষটায় হারিয়েই গিয়েছিলেন, সিদ্বেশ্বরী সেই ঠুমরি গেয়েই কেন তুলনায় কম অপমান, লাঞ্ছনার ভাগী হলেন? গিরিজা দেবী কেমন করে সেই ঠুমরিকেই সমাজের সামনে মেলে ধরলেন এমন করে, যেন ঠুমরি মূল শাস্ত্রীয় সংগীতেরই অঙ্গ?
ঠুমরি ধারার যেন বা ‘নবজাগরণ’-এর অন্য নাম গিরিজা দেবী। এই নবজাগরণের প্রয়োজন পড়ল কেন? ঠুমরি ধারাকে ‘ডি-স্টিগমাটাইজ’ করতে গিরিজা দেবী সফল হয়েছিলেন কিছুদুর (বহুদূর), এমনটাই মত একাংশের সংগীতজ্ঞদের। তা যদি হয়েই থাকেন, তবে কেন হয়েছিলেন, সে কথা আমরা ভাবব কি? না এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে কেবলই শ্রবণে মন দেব? শ্রবণের কাজ কেবল সুর গ্রহণ করা তো নয়, সুর কোথায় কোথায় কেটেছে, তার হিসেব রাখাও। বহিরাঙ্গে গিরিজা দেবী ‘মাপের’ জীবনে থেকেছেন চিরকাল। যে মাপ করে দিয়েছে সমাজ। ‘ভালো ঘরে’ জন্ম, ‘ভালো ঘরে’ বিবাহ। ‘বেচাল’ তো তিনি হননি। কণ্ঠের জাদুর পাশাপাশি সেই কারণেও কি সমাজে তাঁর যোগ্য জায়গা, শিল্পের যোগ্য জায়গা মিলল মাত্রায় কম ঝামেলায়?
ইতিহাস নির্মাণের রাজনীতি কেমন, কীভাবে সেই রাজনীতিকে প্রশ্ন করব, সেই প্রসঙ্গে ‘‘সাবা দেওয়ানের ‘দ্য আদার সং’ (২০০৯)– ইতিহাস আর শিল্পের সংঘাত-সীমান্তে নারী’’ শীর্ষক নিবন্ধে তাত্ত্বিক-অধ্যাপিকা তৃণা নিলীনা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন– ‘‘চিরাচরিত আর্কাইভ বা মহাফেজখানায় রক্ষিত তথ্যের আকরগুলি অনেক সময়েই সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকেই প্রতিফলিত করে এ কথা আমাদের অজানা নয়। প্রকাশ্যে বা সর্বসাধারণের সামনে ঘটে চলে যেসব মান্য ঐতিহাসিক ঘটনা তার নথিভুক্তি অনেক সময়েই মেয়েদের অন্তরঙ্গ এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা জটিল প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে চলে যায়। এই তথাকথিত ‘বৃহৎ’ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীগুলি মেয়েদের জীবনে কি প্রভাব ফেলে তাও আমাদের অজানা থেকে যায়। অতএব পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রভাব অন্দরমহল এবং বহির্জগতে কি তা শুধুমাত্র সরকারী মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজ দেখে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। মেয়েদের জীবনের অন্তরঙ্গ সত্য বুঝে উঠতে তাই নারীবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচলিত আর্কাইভ-এর বাইরে যেতে হয়েছে– ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের পরিসরে আনতে হয়েছে চিঠি-চাপাঠি, ডাইরি, আত্মজীবনীমূলক লেখা, মৌখিক ইতিহাস, রান্নার বই, হিসেবের খাতা, গান, কবিতা, স্মৃতিচারণা এবং ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার।’’ ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আসল চিত্রটিকে চেনার, সাংস্কৃতিক বৃত্তে থাকা মেয়েদের আসল সংগ্রামকে বোঝার এই একটিমাত্র পদ্ধতি। এই অভ্যেস থেকে বিরতি নিলেই পুরুষপ্রধান ইতিহাস আমদের একইভাবে হেনস্তা করবে আবারও।
এই যে নিজেকে (পাঠককেও) প্রশ্ন করেছি একটু আগে, মাত্রায় কম ঝামেলা কেন পোহাতে হল গিরিজা দেবীকে– সে প্রশ্ন করতে করতে নিজেই ভেবেছি, মেয়েদেরও নাকি কম ঝামেলা! ‘দ্য অন্টলজি অফ পারফরম্যান্স’-এ আমেরিকান নারীবাদী তাত্ত্বিক পেগি ফেলান বলছেন, একজন নারী যখন ‘পারফর্মার’, পারফরম্যান্সে তাঁর উপস্থিতি ক্ষমতার কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ কাঠামো কার? এ কাঠামো পুরুষতন্ত্রের। এই ‘দৃশ্যমানতার অর্থনীতি’ রুখে দিতে উপস্থিতি ব্যতিরেকেও, নারী শিল্পীর প্রয়োজন ‘পরিকল্পিত’ অনুপস্থিতির। গিরিজা দেবীর সমগ্র জীবনকে, তাঁর জীবনধারাকেও যদি একটি পারফরম্যান্স হিসেবে গণ্য করা হয় (তত্ত্বমতে তো তাও হওয়ার কথা), তবে জনতার শ্রবণ এবং দৃষ্টি থেকে তিনি মধ্যে মধ্যে অব্যাহতিও নিয়েছেন। ধারাবাহিক ভাবেই নিয়েছেন। এই অব্যাহতির কতখানি সচেতনভাবে পরিকল্পিত, তার আন্দাজ আমি না করতে পারলেও, এই ‘ধারাবাহিক’ অব্যাহতিকে কাঠামোর বাইরে অন্য একটি কাঠামো নির্মাণের প্রতীক হিসেবে দেখি, সংগ্রামের মন্ত্র হিসেবে দেখি। একটি পারফরম্যান্স বিদ্যমান ততক্ষণ, যতক্ষণ তা বর্তমান। সে কথা জানতেন বলেই হয়তো গিরিজা দেবী নিরালায় বসে দেখে নিতেন, এরপর আবার যখন মাঠে নামবেন, সেই মাঠে নামার প্রস্তুতি কেমন হবে। নিরালাটি যে তাঁর নিরালা ছিল, সে কথা জোর গলায় বলতে পারি, এত জোর গলায় থাকার কারণ আছে কি? যে ‘ভালো ঘরে’ তিনি গেলেন, সেই ঘর তিনি নিজে বেছে নেননি। সংগীতে তাঁর যাতে বিঘ্ন না ঘটে, ঘরটি তাঁকে বেছে দেওয়া হয়েছিল। সে ঘরে তাঁর অধিকারের নম্বর ছিল দ্বিতীয়– সে ঘরে তিনি গিয়েছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী হয়েই। সেও হয়তো অন্য এক সংগ্রাম– কে বলতে পারে। অন্তঃপুরে কখনও স্থান দেননি শ্রোতাদের, ভক্তদের। তাঁদের স্থান দিয়েছেন নিজের হৃদয়েই।
ঠুমরিকে নাকি ‘নিছকই’ প্রেমের গান হিসেবে কখনও দেখেননি গিরিজা দেবী। দেখবেনই বা কেন? নিছকই প্রেম বলেই বা কাকে? আগেরদিন রাসসুন্দরী দেবীর অন্তঃপুর থেকে বাহিরে যাত্রার কথা বলছিলাম বেগম আখতারের কথা বলতে বলতেই। স্নাতকোত্তরের ক্লাসে ঈপ্সিতাদি (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপিকা ঈপ্সিতা হালদার) আমাদের ‘আমার জীবন’ পড়াতেন। এমনিতে অমনোযোগী হলেও, মন দিয়ে শুনতাম ঈপ্সিতাদির সমস্ত কথা। সেই ক্লাসের পড়াই তো এখনও কানে বাজে– ‘অন্তঃপুর থেকে বাহিরে চলতেও আশ্রয় সমর্পণই। নিজেকে খুঁজে পেতে নিজেকেই সঁপে দিতে হয়েছে প্রিয়ের কাছে, প্রিয়ের নিবেদনে, প্রিয়ের প্রেমে। তবেই মিলেছে মুক্তির পথ।’ এই সর্ব-সমর্পণকে যদি ‘নিছক প্রেম’ বলতে হত, তবে সেই প্রেম লঘু হত না কি? ঠুমরিও ঠিক তাই। ঠুমরির শ্রোতা জনতা নিশ্চয়ই, ঠুমরির ‘আসলি’ শ্রোতা ‘প্রিয়ে’ই।
আমার শাস্ত্রীয় সংগীতের মাস্টারমশাই, সোমালি মুখোপাধ্যায় একবার একটা ঠুমরি শেখাতে বসেছেন আমাদের। ‘বাসুরিয়া ক্যাইসে বাজায়ে শ্যাম’। ভৈরবী, যৎ। একটু করে শিখছি, আর মনে ভাবছি, ঠিকই তো তুলে নিচ্ছি সুরের চলন। গান থামিয়ে বললেন– ‘এই গান যদি তোমায় গাইতেই হয়ে, তবে কেবল কণ্ঠ নয়, অন্তর দিয়ে গাও। বুকের গভীর থেকে। আরও গভীর থেকে। আরও, আরও। এই কথা আমাকে বলেছিলেন আমার গুরু, আপ্পাজি।’ তিনি নাকি আরও বলেছিলেন, তালে আর ভাবে সমতা এলে, তবেই ঠুমরি হবে। সেদিন আমি অন্তর দিয়ে গাইতে পারিনি বলেই বোধহয় রাত পর্যন্ত বসিয়ে রেখেছিলেন আমাকে আমার মাস্টারমশাই। এখনও তো পারি না। রাত পর্যন্ত বসে থাকি। ওনারই মুখে শুনেছি, গুরু হিসেবে গিরিজা দেবী ছিলেন বেজায় কড়া। তাই কি বেনারস ঘরানার ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের সংগীত শিল্পীদের অন্তরে বাঁচিয়ে রাখতে সফল হয়েছিলেন? শেষের দিকে গিরিজা দেবীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার কালে এক সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত যে তাঁর পুরস্কার, এত এত সম্মাননা, সেই সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি কী। সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ গিরিজা বলেছিলেন, এসবই বড় মূল্যবান। তবে বেনারস ঘরানার প্রতি তাঁর শিষ্যদের যে নিষ্ঠা, সেই নিষ্ঠাই তাঁর অমূল্য সম্পদ।
গিরিজা দেবী, ওরফে ‘আপ্পাজি’ অধ্যাপনাও করেছেন দীর্ঘদিন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংগীত রিসার্চ আকাডেমিতেও। ছাত্রদের সঙ্গে সহজেই তৈরি হয়েছে মন-খোলা, মুক্তিপথের সংলাপই। যে গান যে ছাত্রের গলায় শুনতে পছন্দ করতেন, সেই গানেরই একটি শব্দ তুলে নিয়ে প্রায়শই নামকরণ করে বসতেন ছাত্রদের। ধ্রুপদী সংগীতে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে অকারণ আরষ্টতাকে স্থান দেননি। এক্সপেরিমেন্টেশনের প্রতি তিনি বিরূপ ছিলেন, এমন দাবি কেউ করতে পারবে না। তবে যে এক্সপেরিমেন্টেশন অতিরিক্ত পরিবর্তনের মাধ্যমে গানের মূল ভাবে আঘাত করে বলে মনে করেছেন, সে এক্সপেরিমেন্টেশনকে আশকারাও দেননি মোটে। তা নিয়ে কোনও রাখঢাকের ধার ধরেননি।
দেশে-বিদেশে কত হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী গিরিজা দেবী। তাঁকে কেবল ‘গায়িকা’, বা ‘শিল্পী’ বললে ভুল হয়। শ্রোতারা তাঁকে বলবে সংগীত-সাধিকাও। সংগীত সাধিকাই। যেন সংগীতই তাঁর প্রিয়ে, সংগীতই ঈশ্বর। ২০১৭ সালে অসুস্থতায় ভুগে পৃথিবী ছেড়ে যান, রেখে যান ঘরানা– ঘরানার সারল্য, ঘরানারই অহংকার। ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে গিরিজা দেবীর নাম ঠিক ততখানিই উজ্জ্বল, যতখানি উজ্জ্বল বিশ্বাসী বাঙালির মনে সরস্বতীর ছবিটি। যেমন উজ্জ্বল নাস্তিকের মনে সেই সরস্বতীর প্রতিই উদাসীন থাকতে পারার গরিমাও।
এইবার শেষে এসেছি। সত্যিই এসেছি। গিরিজা দেবী সম্পর্কিত এই নিবন্ধেরও শেষ, ‘চারকলি’রও শেষ। চারকলিতে এই এই চারজনের কথা, তারও আগে রসুলনের কথা লিখতে লিখতেই দেখছিলাম– জহুরির চোখ কাকে বলে? মেহেফিল দরবারেই কি জহুরির চোখ? না, মেহেফিলে দরবারে প্রকৃত জহুরি কই! মেয়েদের চিনে নিলেন মেয়েরাই। গওহর জান ছোট্ট বিব্বিকে চিনে নিলেন ইসকুলে ত্রাণের কাজে এসে। আশীর্বাদের হাতখানি মাথায় রেখে, আদরে আঙুল বুলিয়ে, বলেই গেলেন, এই মেয়ে একদিন খুব গাইবে, খুব নাম কামাবে। রসুলনও কত বলেছেন সিদ্ধেশ্বরীর কথা। যত্নে, ভক্তিতে, ভালোবাসায়। স্নেহেই করেছেন গিরিজা দেবীর উল্লেখ– গিরিজা দেবীর ঠুমরি যেন পালে হাওয়া লাগিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নৌকাকে, জলে ঢেউ লাগাচ্ছে ভাঁটাতেও। পাঁচজন মেয়ে-শিল্পী ধরে আছেন পাঁচজনের হাত। শক্ত করে। ঝড়-প্লাবনেও ছাড়বেন না। কিছুতেই না। একে কী বলব, শিল্পীদের ব্যারিকেড, নাকি মেয়েদের ব্যারিকেড?