২৫ জুলাই, কর্ণাটকে দিনে ১৪ ঘণ্টা কাজের প্রস্তাব উঠতেই, সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেখানকার বহু মেয়েই জানাচ্ছেন যে, তারা হয়তো চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পথেই হাঁটবেন। না-হলে, দীর্ঘকর্মদিবসের চাপ সামলে সংসারের কাজের দায়িত্ব নেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে! তাছাড়া, এই দীর্ঘ কর্মদিবসের শেষে, রাত করে নিরাপদে বাড়ি ফেরা কিংবা ঋতুস্রাবের দিনগুলিতে এই দীর্ঘসময় অফিস করার মতো সমস্যাগুলি নিয়েও তারা চিন্তিত।ো
‘প্রায় দেড়শো বছর আগে শিল্পবিপ্লবের সময়, হেনরি ফোর্ড কর্মক্ষেত্রের খোলনলচে পাল্টে ফেলেন। বাকিরা যখন ব্যবসা থেকে কেবল লাভের কথা ভাবছে, দূরদর্শী ফোর্ড তখন কর্মীদের কাজের সময় কমিয়ে আনছেন আট ঘণ্টায়, কমিয়ে আনছেন কর্মদিবসের সংখ্যা আর বাড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের বেতন। এর ফলে, কয়েকদিনের মধ্যেই কর্মীদের উৎপাদনহার বাড়ল, কোম্পানির লভ্যাংশও। এভাবেই ফোর্ড একটি উন্নততর দেশ গড়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, তার এত বছর পর, পৃথিবীতে যখন কাজের ধরন ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে, পেশিশক্তির জায়গা নিচ্ছে বুদ্ধিমত্তা, তখনও আমরা সেই আটঘণ্টার জাঁতাকলই পিষে চলেছি।’
২০১৬ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য ফাইভ আওয়ার ওয়ার্ক ডে– লিভ ডিফারেন্টলি, আনলক প্রোডাক্টিভিটি অ্যান্ড ফাইন্ড হ্যাপিনেস’। বইটির ব্যাক-কভারে এই কথাগুলোই লিখেছেন স্টিফেন আরস্টল। সেই আরস্টল, যিনি ব্যবসা শুরুর বছর সাতেকের মধ্যেই কোটি কোটি টাকার লগ্নি পেতে শুরু করেন। পান আমেরিকার জনপ্রিয় ‘সার্ক ট্যাঙ্ক’ পুরস্কার; ‘পিপল্’ ম্যাগাজিনের পাতা ভরে ওঠে তার ব্যবসায়িক বুদ্ধির অসাধারণত্ব বর্ণনায়, বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর ওপর ‘কেস স্টাডি’-ও করে। আর আরস্টল তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের মূলমন্ত্রগুলি লেখেন এইভাবে– দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে কর্মীদের কর্মক্ষমতা কমে। কমে কাজের প্রতি উৎসাহ এবং কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতির হার। ক্ষতি হয় তাদের ব্যক্তিজীবনেরও। শেষ পর্যন্ত, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স না-করতে পেরে, চাকরি ছেড়ে দেন বহু সুদক্ষ কর্মী। বুঝতে হবে, আদতে কিন্তু তা কোম্পানিরই ক্ষতি।
ভারতে বসে এসব শুনলে, কোনও এক সমান্তরাল ইউটোপিক পৃথিবীর কথা মনে হয়। এসব যে আদপেও বাস্তব এবং প্রমাণিত সত্য, কিছুতেই তা বিশ্বাস হতে চায় না, বিশেষত যখন শুনি যে কর্ণাটক সরকার তার তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির কর্মীদের কাজের সময় আরও বাড়িয়ে দিনে ১৪ ঘণ্টা করার পরিকল্পনা করছে। ২৪ জুলাই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে, স্বাভাবিকভাবেই কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু ব্যক্তি আই.টি. কর্মী বা কর্ণাটক রাজ্য তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী সংগঠনই নয়, প্রস্তাবটির তীব্র সমালোচনা করছেন অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত কর্মী ও তাঁদের সমিতিগুলিও। কারণ তাঁরা জানেন যে, একবার এই ব্যবস্থা চালু হলে, ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়বে সব পেশাতেই।
এখানে বলে রাখি যে, ভারতে কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় নির্ধারিত হয় তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের সম্মেলনপ্রাপ্ত নির্দেশিকা, ফ্যাক্টরি আইন ১৯৪৮ এবং শপ অ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্ট আইন-এর রাজ্যভিত্তিক নিয়মাবলি অনুযায়ী। এদেশের ফ্যাক্টরি আইনমাফিক, এদেশের কর্মীদের দিনে সাধারণভাবে ৮ ঘণ্টা ও সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা বেশি কাজ করার কথা নয়। কিন্তু রাজ্যভিত্তিক শপ অ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্ট আইন এক রাজ্যের থেকে আরেক রাজ্যের কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় পৃথক করে দেয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার প্রতিবেদন দিয়ে বলা যায় যে, এদেশের মুম্বই-এর কর্মীরা যেখানে বছরে গড়পড়তা ৩৩১৫ ঘণ্টা কাজ করে, সেখানে দিল্লির কর্মীরা করে ২৫১১ ঘণ্টা।
আর কাজের সময়ের এই তুলনামূলক হিসেব যদি গোটা বিশ্বের সাপেক্ষে ভারতের করি, তাহলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে গড়ে ২১১৫ ঘণ্টা কাজ করে দীর্ঘতম কাজের সময়ের তালিকায় ভারত বিশ্বে ১৫তম স্থানে। ভারতের থেকেও খারাপ অবস্থা মূলত আফ্রিকা, চিন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলির। আর এই তালিকার উল্টো প্রান্তে রয়েছে নেদারল্যান্ড, জার্মানি, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইরাক কিংবা ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলি; যেখানে সাপ্তাহিক কাজের সর্বোচ্চ সময় মাত্র ২৭ থেকে ৩৪ ঘণ্টার মধ্যে।
…………………………………………………………………………..
মেয়েরা রোজগার করুক বা না-করুক, সংসারের বেতনহীন কাজগুলি; যেমন বাচ্চা সামলানো, ঘর গোছানো, পরিবারের বয়স্ক মানুষদের দেখাশুনা থেকে শুরু করে গৃহসহায়িকা না-এলে (হয়তো এলেও), রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করার মতো কাজগুলো এখনও এদেশের মেয়েদের ওপরেই বর্তায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবেদন বলছে, ভারতে বেতনহীন কাজের গড়পড়তা ৯১ শতাংশ করেন মেয়েরা। আর প্রায় পাঁচ লক্ষ ভারতীয়র ওপর করা সাম্প্রতিক একটি জাতীয় সমীক্ষা বলছে, এদেশের প্রতি দশ জনে মাত্র এক জন পুরুষ ঘরের কাজে হাত লাগান। এই সিংহভাগ ঘরের কাজ সামলে বহির্বিশ্বের কাজে যোগ দিতে হয় বলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় বাড়লে মেয়েদের সমস্যা বাড়ে অনেকটা বেশি।
…………………………………………………………………………..
অর্থাৎ মোটের ওপর দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় তুলনামূলক কম। কিন্তু এর কারণ কী?
আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন, বিশ্বব্যাঙ্ক এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার প্রতিবেদন ও কিছু গবেষণাপত্র ঘেঁটে মোটের ওপর কারণ হিসেবে যা উঠে আসছে, তার সাথে হেনরি ফোর্ড বা আরস্টলের নীতির মিল বিস্তর। অর্থাৎ এই দেশগুলির মানুষ বিশ্বাস করেন যে, কাজের সময় বা কর্মদিবস বাড়ালেই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, এমনটা মোটেই নয়, বরং এতে কর্মীদের উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি বা কাজের ইচ্ছ কমে যেতে পারে, খারাপ হতে পারে কাজের মান, বাড়তে পারে ছুটি নেওয়ার বা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতাও। তবে লিঙ্গনির্বিশেষে সকলেই এর ভুক্তভোগী হলেও, এতে মহিলাদের ভোগান্তি হয় অনেকটা বেশ। বিশেষত, ভারতের মতো অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা দেশে।
কারণ মেয়েরা রোজগার করুক বা না-করুক, সংসারের বেতনহীন কাজগুলি; যেমন বাচ্চা সামলানো, ঘর গোছানো, পরিবারের বয়স্ক মানুষদের দেখাশুনা থেকে শুরু করে গৃহসহায়িকা না-এলে (হয়তো এলেও), রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করার মতো কাজগুলো এখনও এদেশের মেয়েদের ওপরেই বর্তায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবেদন বলছে, ভারতে বেতনহীন কাজের গড়পড়তা ৯১ শতাংশ করেন মেয়েরা। আর প্রায় পাঁচ লক্ষ ভারতীয়র ওপর করা সাম্প্রতিক একটি জাতীয় সমীক্ষা বলছে, এদেশের প্রতি দশ জনে মাত্র এক জন পুরুষ ঘরের কাজে হাত লাগান। এই সিংহভাগ ঘরের কাজ সামলে বহির্বিশ্বের কাজে যোগ দিতে হয় বলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় বাড়লে মেয়েদের সমস্যা বাড়ে অনেকটা বেশি।
তাই ২৫ জুলাই, কর্ণাটকে দিনে ১৪ ঘণ্টা কাজের প্রস্তাব উঠতেই, সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেখানকার বহু মেয়েই জানাচ্ছেন যে, তারা হয়তো চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পথেই হাঁটবেন। না-হলে, দীর্ঘকর্মদিবসের চাপ সামলে সংসারের কাজের দায়িত্ব নেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে! তাছাড়া, এই দীর্ঘ কর্মদিবসের শেষে, রাত করে নিরাপদে বাড়ি ফেরা কিংবা ঋতুস্রাবের দিনগুলিতে এই দীর্ঘসময় অফিস করার মতো সমস্যাগুলি নিয়েও তারা চিন্তিত।
তবু কর্ণাটক মনে করছে যে, কাজের সময় বৃদ্ধির মাধ্যমে শ্রমবাজারের এই পরিবর্তন জিডিপি-র বৃদ্ধি ঘটাবে, দেশের উন্নতি করবে। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ল।
তখন ২০১০। সিঙ্গাপুর গিয়েছি ঘুরতে। নানা বিষয় আলোচনা করতে করতে ট্যুর গাইড বলেছিল, সেখানকার অফিস কর্মীদের নাকি বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসা মানা।
‘এমন অদ্ভুত নিয়ম কেন?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম আমি।
‘অদ্ভুত কেন হবে?’ ট্যুর গাইড বলে, ‘বাড়ি থেকে টিফিন আনা মানে, ঘরে রান্না করা। এতে গৃহশ্রমের পরিমাণ বাড়ে, মেয়েদের কাজের বোঝাও। অবৈতনিক শ্রমের পরিমাণ বাড়লে, তাদের শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়ার সময় ও সম্ভাবনা কমে। আর তাছাড়া, বাইরে থেকে টিফিন কিনে খেলে হোটেল বা ফুডস্টলগুলোর ব্যবসাও বাড়ে, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।’
এ-যে পুরো অর্থনৈতিক দর্শন! লেবার-ইকনোমিক্স আর ম্যাক্রো-ইকনোমিক্স মিলে মিশে একাকার। মুগ্ধতার ঘোর সামলে বলি;
‘তোমরা নিজেদের ভালোর বাইরে বেরিয়ে, মেয়েদের ভালোর জন্য, দেশের ভালোর জন্য, আলাদা করে এত কিছু ভাবো?’
জবাব আসে তক্ষুনি; ‘আলাদা করে ভাবি না-তো, নিজের ভালোই ভাবি। কিন্তু দেশের ভালো বাদ দিয়ে তো নিজের ভালো হয়-না। আবার দেশের মেয়েদের বাদ দিয়ে দেশের ভালোও হয় না। তাই সব ভালো কথা চিন্তা করেই আমরা দেশের নিয়মনীতি এমন করে বানাই, যাতে এত শতকের অবদমন পেরিয়ে মেয়েরা ক্রমশ এগিয়ে আসতে পারে। ব্যক্তি হিসেবে, কর্মী হিসেবে, নাগরিক হিসেবে।’
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।