যাকে নিয়ে এত হইচই, সেই ইমরান হাশমি কি সচেতনভাবেই এই চুম্বন বিপ্লবের অবিসংবাদী রাজপুত্র হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন? ২০০০ সালের পরপর, ভারত নামের দেশটায় তখনও এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না কেউ। শুধু ‘মার্ডার’, ‘জহর’, ‘অকসর’, ‘আওয়ারাপন’, ‘গ্যাংস্টার’– একের পর এক স্ক্রিন তোলপাড় করা চুমুতে মজে থাকে একটা প্রজন্ম। ইমরানের ওটাই ট্রেডমার্ক। আর তারই সঙ্গে মাথাখারাপ করা গান। আর সে চুমুও কি একরকম? কখনও সংশয়ে, কখনও ভয়ে, কখনও রাগে, আবার কখনও নিখাদ ভালোবাসায়– কিন্তু না, কখনওই লজ্জায় নয়, লুকিয়ে নয়!
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
ধরা যাক, সে মেয়ের নাম আভারানি অথবা নীপবীথি (কিংবা ব্রজদুলালী হতেও বা আটকাচ্ছে কোথায়?)। ধরা যাক, সময়টা দু’হাজার সালের পরপর, আর দেশটার নাম ভারত। আরও ধরা যাক, এই আভারানি অথবা নীপবীথি সদ্য ষোড়শী এবং সে আখেরে মেয়ে ভালো। তাহলে এরপর নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যাবে; সে বড় সুখের সময় নয়। কেননা আভারানি অথবা নীপবীথি অঙ্কে প্রচুর নম্বর পায় আর রাত জেগে হ্যারি পটার পড়ে। হয়তো মাত্র কয়েক বছর আগেই বাড়িতে প্রকাশ্যে হিন্দি গান শোনার ঘোরতর নিষেধাজ্ঞাটা অলিখিতভাবে খানিক লঘু হয়েছে। দেওয়াল পত্রিকায় ব্যর্থ প্রেম নিয়ে প্যাথোজ উপচানো কবিতা লিখলেও স্যর বা ম্যাডামরা রে রে করে তেড়ে আসছেন না। এমনকী, একটু সাহস করে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে ক্লাসের কে কাকে প্রপোজ করলো মা-কে সেটুকুও বলে ফেলা যাচ্ছে। কিন্তু আভারানি অথবা নীপবীথি আখেরে মেয়ে ভালো, তাই সে কিছুতেই মুখ ফুটে বলে উঠতে পারছে না– আয়োজন যথেষ্ট নয়!
এমনিতেই ‘শরীর’ বুঝে ওঠার আগেই সে ‘শরীর শরীর তোমার মন নাই কুসুম’ জেনে ফেলেছে আর এটুকু বুঝে ফেলেছে ‘শরীর’ জায়গাটা খুবই নিষিদ্ধ, অন্ধকার আর শ্বাপদসঙ্কুল একটা এলাকা। তার ‘মন’-এর মালিক যে সে নিজেই– সবেমাত্র এই বোধটুকুই তার রপ্ত হয়েছে। এর মাঝে আবার শরীর! সারাদিন সারারাত টনটনে ব্রনর মতো অস্বস্তি নিয়ে জেগে থাকা একটা বোধ নিয়ে সে মেয়ে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস করে। প্রিটেস্টের আগের ছুটিতে লুকিয়ে পুরনো শারদীয়ায় ‘বড়’দের লেখা খুঁজতে গিয়ে, ভুল করে জীবনে প্রথমবার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পড়ে ফেলে ব্যাপক বোর হয়। দুপুরে কেউ বাড়ি না থাকলে ল্যান্ডলাইন ব্লক করা মোডেমের ক্রিং ক্রিং ধ্বনি সহ ইয়াহু অথবা নেটস্কেপের দরজা খুলে শামুকের গতিতে লোড হওয়া ইন্টারনেটে ‘বড়’দের ওয়েবসাইট খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়।
অথচ ভেবে দেখলে, ‘খারাপ ছেলে’দের এসব সমস্যা নেই! ব্যাকবেঞ্চের অন্ধকার দিকটায় ব্যাপক ফিসফাস-সহ তখন নিষিদ্ধ ইশতেহারের মতো জ্যালজ্যালে সব সিডি পাচার হয়ে যাচ্ছে হাতে হাতে। সন্দেহজনক কীসব ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে দু’-চারটে ছেলে টিফিন পিরিয়ডে গোল হয়ে আলাদা বসে, চোখে-মুখে থ্রিলারের উত্তেজনা– হায়, আভারানি অথবা নীপবীথির সে জগতে প্রবেশাধিকার নেই! সে ফার্স্ট বেঞ্চে বসে মুখ চুন করে কুনোব্যাঙের জননপ্রক্রিয়া পড়তে পড়তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর ভাবে; জীবন এমনই!
তখনও হিন্দি সিনেমায় বৃষ্টিস্নাত নায়ক আর নায়িকা ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিলে স্যাক্সোফোন বেজে ওঠে। খড়ের গাদার পাশে বিপজ্জনক ভাবে জ্বলে ওঠা আগুনের ফুলকিতে ক্যামেরা আউট অফ ফোকাস হয়ে যায়। কাট টু সুইজারল্যান্ডের ফ্যাটফ্যাটে সকাল! (শুধু টিভিতে ‘জুলি’ দিলেই বাবা-মা তড়িঘড়ি ‘যা যা পড়তে বস!’ বলে তাকে অন্য ঘরে বিদেয় করে দিয়ে নিজেদের মধ্যে ‘অ্যাই মনে আছে? হিহিহি!’ করে অবিকল লাস্ট বেঞ্চীয় ভঙ্গিতে গুজগুজ করলে বেচারি বোঝে– লাইফ ইজ আনফেয়ার!)। রাতের ওয়াকম্যানে ‘দিল সে’-র ‘জিয়া জ্বলে’ বেজে উঠলে আভারানি অথবা নীপবীথি ভাবে, জ্বলে তো বটেই কিন্তু এমন আকুলিবিকুলি জ্বালা নিয়ে সারাদিন ধিকিধিকির মানে, সে বোধহয় এখন আর ততটাও ‘ভালো মেয়ে’ নেই!
আর এমনই সময়ে বিশুদ্ধ বিস্ফোরণের মতো নায়কের এন্ট্রি! সাদামাটা চেহারা। ঠ্যাং দুলিয়ে নাচতে পারে না। দুটো ঘোড়ায় দুই পা দিয়ে ভিলেন ক্যালাতে পারে না। এমনকী, প্রেম নিবেদনের সময়েও ক্যামন চাঁচাছোলা অভিব্যক্তি! এ ক্যামন নায়ক? ড্যামসেল ইন ডিসট্রেস ষোড়শীর জীবনে কিন্তু অবিকল দেবদূতের মতোই উদয় হলেন ইমরান হাশমি। তিনি এলেন, চুমু খেলেন ও জয় করলেন।
সালটা ২০০৫, সিনেমার নাম ‘আশিক বনায়া আপনে’। অলস দুপুরে ছাদের চালে পিলে চমকানো এক একটা ভূতের ঢিলের মতোই পর্দায় একের পর এক চুমু খাচ্ছেন ইমরান! সঙ্গতে হিমেশ রেশমিয়ার মাদক সংগীত। ক্যামেরার লজ্জা নেই। ইমরানেরও। কোনও জাম্প কাট বা ফেড আউটের আড়াল ছাড়াই, ঝড়ঝাপটের মতো চুমু! বড়রা শিউড়ে ওঠে। ছোটরা উত্তেজনায় লাল হয়ে যায়। খবরের কাগজ লেখে– হিন্দি সিনেমা সাবালক হল। আর আভারানি অথবা নীপবীথি? সে শুধু নিঃশব্দে বলে– থ্যাংক ইউ!
সিনেমায় এমনটাই হয় না? কেননা সে তো ধরেই নিয়েছিল চুমু খেতে চাওয়া, অন্যকে চুমু খেতে দেখতে চাওয়া পাপ! যৌন অবদমনের এই উপমহাদেশে সে বেচারি বোঝেইনি হাসি, কান্না আর হেঁটে চলার মতোই কামও একটা স্বাভাবিকস্য স্বাভাবিক প্রবৃত্তি! সে বেচারি বোঝেইনি তার পৃথিবীতে তারই মতো অজস্র কিশোরীর সদ্য যৌন প্রবৃত্তি বিগত কয়েক শতক ধরে বেঁধে রাখা স্ট্রেট জ্যাকেটে নিষ্ক্রমণের পথটুকুও না পেয়ে নিরন্তর ছটফট করে চলেছে! সে তো বোঝেইনি একে অন্যকে ছুঁতে চাওয়ার ইচ্ছে ঠিক আঠেরো বছর বয়েসে দুনিয়া পাল্টে দেওয়ার ইচ্ছের মতোই বিশ্বজনীন! নইলে কেনই বা ‘বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি’ খাওয়া হয়! আর কেনই বা দেওয়ালের অমোঘ গ্রাফিত্তিতে লেখা হয়– ‘দ্য মোর আই ওয়ান্ট টু মেক রেভোলিউশন, দ্য মোর আই মেক লাভ’! সে তো বোঝেইনি, ‘ভালো মেয়ে’ হয়ে বেঁচে থাকার চাপে কত অসংখ্য মেয়ে নিজেকেই নিজে অস্বীকার করে বেঁচে থাকে, এই আজও!
……………………………………………
সালটা ২০০৫, সিনেমার নাম ‘আশিক বনায়া আপনে’। অলস দুপুরে ছাদের চালে পিলে চমকানো এক একটা ভূতের ঢিলের মতোই পর্দায় একের পর এক চুমু খাচ্ছেন ইমরান! সঙ্গতে হিমেশ রেশমিয়ার মাদক সংগীত। ক্যামেরার লজ্জা নেই। ইমরানেরও। কোনও জাম্প কাট বা ফেড আউটের আড়াল ছাড়াই, ঝড়ঝাপটের মতো চুমু! বড়রা শিউড়ে ওঠে। ছোটরা উত্তেজনায় লাল হয়ে যায়। খবরের কাগজ লেখে হিন্দি সিনেমা সাবালক হল।
……………………………………………
আর যাকে নিয়ে এত হইচই? সেই ইমরান হাশমি কি সচেতনভাবেই এই চুম্বন বিপ্লবের অবিসংবাদী রাজপুত্র হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন? ২০০০ সালের পরপর, ভারত নামের দেশটায় তখনও এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে না কেউ। শুধু ‘মার্ডার’, ‘জহর’, ‘অকসর’, ‘আওয়ারাপন’, ‘গ্যাংস্টার’– একের পর এক স্ক্রিন তোলপাড় করা চুমুতে মজে থাকে একটা প্রজন্ম। ইমরানের ওটাই ট্রেডমার্ক। আর তারই সঙ্গে মাথাখারাপ করা গান। আর সে চুমুও কি একরকম? কখনও সংশয়ে, কখনও ভয়ে, কখনও রাগে, আবার কখনও নিখাদ ভালোবাসায়– কিন্তু না, কখনওই লজ্জায় নয়, লুকিয়ে নয়! ইমরান শিখিয়েছেন চুমু সাবলীল। চুমু স্বাভাবিক। আর সর্বোপরি, চুমু সর্বজনীন। ‘ভালো/খারাপ’-এর প্রান্তিকতার বাইরে; যে মেয়ের নাম আভারানি অথবা নীপবীথি অথবা ‘কুইন’ সিনেমার অবিন্যস্ত রানি মেহরা– তাদের সক্কলের এক-একটা নিখাদ চুমুতে হক আছে! আলবাত আছে! তাই সে শুধু দু’-চোখ ভরে স্ক্রিন জুড়ে মানব ও মানবীকে চুমু খেতে দেখে আর নিঃশব্দে বারবার বলে চলে ‘থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!’
আমরা ধরে নিতে পারি, আভারানি অথবা নীপবীথি একদিন কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে উঠবে। বড় হয়ে হয়তো চুমুর বাইরের তুখোড় অভিনেতা ইমরানকে একদিন আলাদা ভাবে আবিষ্কার করবে। এফএমে হিমেশ রেশমিয়ার পুরনো গান আপনা থেকেই বেজে উঠলে নিজের মনেই আলতো হাসবে খানিক। আমরা ধরে নিতে পারি, এরপর একদিন সে সত্যি সত্যি চুমু খাবে। ভালোবেসে। নিঃসংকোচে। বিনা অপরাধবোধে। আর তারও বেশ বেশ কিছুদিন পর আভারানি অথবা নীপবীথি নামের মেয়েটি যখন জীবনের মধ্যাহ্ন ছুঁয়ে ফেলবে আর হয়তো তারও ঘরে একটি ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ তখন বয়ঃসন্ধির সর্বগ্রাসী আলোড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে… হয়তো সেদিনও আজকেরই মতো মনকেমন এক সন্ধে আর টিভিতে বুক টনটন করে ফের বেজে উঠছে ‘ভিগে হোঁঠ তেরে’– তখন আর যাই হোক; আভারানি অথবা নীপবীথি কিছুতেই নিজের মেয়েকে পড়াশোনার অছিলায় পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেবে না।
হাজার হোক, ইমরানে তো তারও হক আছে!
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..