কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের কাছে ফুটপাথের ধারের লোহার রেলিং চুরি হয়ে যাচ্ছে, চুরি হয়ে যাচ্ছে কাঠের বেঞ্চির ওপরের তক্তা, ল্যাম্পপোস্টের লাইট- এমনকী, ডালহৌসির সেন্ট জনস চার্চের কাছ থেকে রাজভবন পর্যন্ত অঞ্চলের যে মুচিপাথরের নকশার ফুটপাথ সে ফুটপাথ থেকে পাথর অবধি বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছে! এসব না থাকলে কলকাতা থাকবে?
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
আলাপ-বিলম্বিত-দ্রুত-অলংকার-ঝালা– আরে না, না! রাগ-টাগ নয়, প্রেম। নিখাদ প্রেম মশাই। রাগের মতোই। আস্তে আস্তে, ধীর পায়ে– একটু একটু করে… চুম্বনের আগে যেমন কানের পাশে হাত রাখলে অমোঘ আকর্ষণে কাছাকাছি এসে যায় ওষ্ঠ, তেমনই ঠিকভাবে ছুঁতে পারলে, একেবারে সারা শরীরে লেপে যায় আস্ত একটা শহরের ঘ্রাণ।
আধুনিক নগর সভ্যতার ইতিহাসে রোম, হাভানা, প্যারিস, বুদাপেস্ট, ব্রুসেলস কিংবা বার্লিনের মতো সব শহরের ক্ষেত্রেই এ তত্ত্বটি প্রণিধানযোগ্য। লিভারপুলে যেমন জন লেনন, তেমনই কলকাতায় সুমন– ‘কান্না চেপে ঘুরেছিলাম তোমারই পথ দিয়ে– এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু…’ বলে শহরের সঙ্গে যৌবনের একটা প্রেমের তার বেঁধে দিলেন। অবশ্যি কবি-সাহিত্যিক-পেইন্টার-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদদের বাইরেও এ শহরের হাজার হাজার প্রেমিক; মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবী-পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালা-বিহারি দারোয়ান-ভোরের রাম-সিয়া-রাম, সন্ধের সাদামাটা দুধ চা-আকাশবাণী কলকাতা-ট্রাম-দোতলা বাস- দশটা-পাঁচটার হাজার হাজার প্রেমিক- সব হারিয়ে গেল রাতারাতি! হালের জেন ওয়াই-জেন জেডের মতো প্রেম-ব্রেকাপের ঝিনচ্যাক ফ্রিকোয়েন্সি এসে গেল কেমন শহর আর তার মানুষের নিখাদ প্রেমের সম্পর্কটায়- বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে খবরটার দিকে চোখ রাখুন।
কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারের কাছে ফুটপাথের ধারের লোহার রেলিং চুরি হয়ে যাচ্ছে, চুরি হয়ে যাচ্ছে কাঠের বেঞ্চির ওপরের তক্তা, ল্যাম্পপোস্টের লাইট– এমনকী, ডালহৌসির সেন্ট জনস চার্চের কাছ থেকে রাজভবন পর্যন্ত অঞ্চলের যে মুচিপাথরের নকশার ফুটপাথ, সে ফুটপাথ থেকে পাথর অবধি বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছে!
নিশ্চয়ই ভাবছেন– আরে মশাই, এর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক কী? চোর কি এ যুগে নতুন নাকি? মানুষ আগুন আবিষ্কারের পর থেকেই তো চোরে চকমকি পাথরও চুরি করত– আজ্ঞে না! সে চুরি আর এ চুরির একখান তফাত আছে!
এই লোহার রেলিংগুলো বসানো হয়েছিল ২০০৬ সাল নাগাদ একেবারে ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকে ডালহৌসি স্কোয়ারকে কেমন দেখতে ছিল সেই চিত্রকে মাথায় রেখে, ডালহৌসিকে হেরিটেজ লুকে পুনর্নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে। এই যে মুচিপাথরের ফুটপাথ– কলকাতা কেন, ভূ-ভারতে খুঁজলেও আর দ্বিতীয় পাওয়া দুষ্কর, এই কাঠের বেঞ্চ– ব্রিটিশ আমলের ল্যাম্পপোস্টের কাঠামোর সঙ্গে জুড়ে আছে কলোনিয়াল কলকাতার বিরাট ইতিহাস। এদেশের প্রাক্তন রাজধানী, ব্রিটিশ ভারতের প্রাণকেন্দ্র এই ডালহৌসি স্কোয়ার– স্বাধীনতা পরবর্তী যে সেপিয়াটোনের কলকাতা– যেমন ধরুন, ‘অপরাজিত’ ছবিতে অপুর চোখে যে কলকাতা, কিংবা ‘মহানগর’ ছবিতে আরতির চোখে যে কলকাতা, বা ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকের চোখে যে কলকাতা– সে কলকাতার সাদা-কালো মানুষ আর শহরের মধ্যে এক অদ্ভুত মিথোজীবী সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে উঠত। ব্যক্তির আত্মসর্বস্বতার গ্রাসে কার্যত গোটা শহরটাই গলাধঃকরণ হয়ে গিয়েছে, এমনটা তো ভাবাই যায়নি!
………………………………………………
এই লোহার রেলিংগুলো বসানো হয়েছিল ২০০৬ সাল নাগাদ একেবারে ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকে ডালহৌসি স্কোয়ারকে কেমন দেখতে ছিল সেই চিত্রকে মাথায় রেখে, ডালহৌসিকে হেরিটেজ লুকে পুনর্নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে। এই যে মুচিপাথরের ফুটপাথ– কলকাতা কেন, ভূ-ভারতে খুঁজলেও আর দ্বিতীয় পাওয়া দুষ্কর, এই কাঠের বেঞ্চ– ব্রিটিশ আমলের ল্যাম্পপোস্টের কাঠামোর সঙ্গে জুড়ে আছে কলোনিয়াল কলকাতার বিরাট ইতিহাস।
……………………………………………….
অথচ, ভাবুন, এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে প্রেমিকার গয়না ছিনতাইয়ের মতো নাকি কলকাতার বুক থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বেঞ্চ-রেলিং-পাথর! শুধু কি চুরি? সেদিন হেঁটে যাচ্ছিলাম মহাত্মা গান্ধী রোড ও সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর ক্রসিং দিয়ে। অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন, একটি পাথরের ফলকে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের সম্পূর্ণ পথটি সেখানে খোদাই করা আছে– কারণ, এলগিন রোডের বাড়ি থেকে শিশির বসুর সঙ্গে নেতাজি ওই পথ দিয়েই সোজা চলে গেছিলেন পঞ্জাব হয়ে কাবুলের পথে। আর আজ সে পাথরের ফলকের ওপর গুটখার ছাপ! হায়!
ইতিউতি কান পাতলে দেখবেন লোকের জোর আলোচনা– এ শহরে ট্রাম নাকি রাস্তা জ্যাম করে বিপদ ঘটিয়েছে– অথচ সমীক্ষা বলছে, গত দশ বছরে যত সংকুচিত হয়েছে ট্রামের গতিপথ এ শহরে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জ্যাম, লোকে বলছে ট্রাম নাকি মন্থরযান, অথচ টানেলের ভেতর পাতাল রেলের গতি এবং ট্রামের গতি প্রায় সমান– আজ্ঞে! বিশ্বের তাবড় শহরে ট্রাম চলে দূষণমুক্ত যানবাহনের উদাহরণ হিসেবে, অথচ এ শহর থেকে ট্রাম তুলে দিতে উদ্যত এ শহরের বর্তমান নাগরিকেরাই। একটি শহরের গড় স্থিরচিত্রের কিছু ‘কমন এলিমেন্ট’ থেকেই যায়– যেমন লন্ডনের লন্ডন ব্রিজ-বিগ বেন, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার তেমনই এ শহরের ক্ষেত্রে হাওড়া ব্রিজ-ট্রাম লাইন আর তার গা ঘেঁষে হলুদ ট্যাক্সি– মজার বিষয়, এই তিনটির মধ্যে দু’টিকেই আমরা প্রায় বিলুপ্তির পথে নিয়ে গেছি ধীরে ধীরে!
চুরি নিয়ে প্রশাসন চুপ কেন? খালি চোরের দোষ? দারোগার নেই? এসব তো কা কস্য পরিবেদনা! সরকার থেকে ২০২১ সালে হেরিটেজ বিল্ডিং ও হেরিটেজ সাইটের গায়ে ফলক লাগিয়ে মার্ক করার জন্য বেসরকারি সংস্থাদের কাছে দরপত্র চেয়েছিল। মজার বিষয় হল, সামান্য রাস্তা তৈরির কাজে যেখানে হাজার হাজার টেন্ডার জমা পড়ে সেখানে হেরিটেজ সাইট মার্কিংয়ের জন্য দরপত্র এসেছিল মাত্র একটি!
বিশ্বের যেকোনও শহরকে আগলে রাখার দায়িত্ব প্রশাসনের চেয়ে ঢের বেশি সে শহরের মানুষের।
……………………………………………….
আরও পড়ুন জয়ন্ত সেনগুপ্ত-র লেখা: ট্রামে হারানো ছাতা, ট্রামই ফিরিয়ে দিয়েছিল
……………………………………………….
তবে কোথায় গেল কলকাতা শহরের সেইসব সাদামাটা প্রেমিকরা? একলা-নিঃসঙ্গ কলকাতার বড় একটা অংশ দখল হয়ে গেছে- এ যেন সেই ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’-এর হু হু করে ওঠা আর্তি– কলকাতা শহরের সেই সব প্রেমিকের পরবর্তী জেনারেশনের কাছে শহরটা স্রেফ পিতৃভিটে হয়ে রয়ে গেল? হয়তো তাই। কারণ দেশের আইটি হাব-ইন্ডাস্ট্রি হাব কোনওটাই তো নয় কলকাতা। আর গত বিশ বছরে যেভাবে মানুষ ব্যক্তিস্বার্থের কুয়োয় অবলীলায় ঝাঁপ দিল– রাস্তায় পড়ে লোক ছটফট করলে যেখানে সাহায্যের বদলে রিলস বানানোর হিড়িক পড়ে সেখানে শহরকে ভালবাসা তো অলীক কল্পনা!
বেঞ্চের কাঠ বেচলে মানিটারি বেনেফিট আছে, হেরিটেজ সাইটের পাথর কিংবা ব্রিটিশ আমলের ল্যাম্পপোস্ট বেচলে মাস দুয়েক চালিয়ে নেওয়া যায়, ভালোবাসলে কি আর পেট ভরে? এই যে শীতের সন্ধেয় আছাড়িপিছাড়ি করে একটা শহরকে ভালবাসা– বো ব্যারাক-ফিয়ার্স লেন হয়ে জাকারিয়া স্ট্রিট অবধি আলগা পায়ে হেঁটে যাওয়া, ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে জেমস হিকি সরণি থুড়ি ডেকার্স লেন হয়ে চৌরঙ্গির আলোর দিকে গুটি গুটি পায়ে ঘুরে বেড়ানো– এসব প্রেমে বাজি ধরা নির্বোধরা কেমন একা ফেলে চলে গেল আস্ত শহরটাকে!
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved