হবু কর্মীর হবি কিংবা অবসরযাপনের প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবতেই রাজি নন এ যুগের এইচআর। এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক তো মুখের উপর বলেই দিলেন, ‘অবসর আবার কী? তোমার অবসর, তোমার হেডেক। আমার নয়।’ দিনে দু’ঘণ্টা সেতারের রেওয়াজের জন্য দিতে হয় জানতে পেরে আমার কলেজজীবনের এক বন্ধুকে কর্মহারা করেছিল এই সমাজ, টানা দু’বছর। সুর গিয়েছে ওর বহুকাল। স্যুট এসেছে।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
ভদ্রলোকের ভিজিটিং কার্ডে লেখা ছিল, ‘কেরিয়ার প্রোগ্রেশন কনসালট্যান্ট’। হাল আমল বহু ঝিনচ্যাক ডেজিগনেশনের সন্ধান দিয়েছে আমাদের। ভদ্রলোক কী করেন? সোজা কথায়, বায়োডাটার চিরাচরিত রূপ বদলে দিয়ে এ যুগের মতো করে দেন, মোটা দক্ষিণার বিনিময়ে। আমার তিন পাতার সিভির শেষ অংশে গিয়ে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। মুখের রেখার ত্রিকোণমিতি জটিলতর হল। লাল স্কেচ পেন দিয়ে খস করে সিভির শেষের যে অনুচ্ছেদটি তিনি কেটে দিলেন, তাতে সাকুল্যে তিন-চার লাইন লেখা ছিল। পড়াশোনা, এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায় কাজ করার খতিয়ান, কর্মক্ষেত্রে স্বঘোষিত ‘রিমার্কেবেল অ্যাচিভমেন্ট’-এর পরে শেষ অনুচ্ছেদটির শিরোনাম দিয়েছিলাম– আমার হবি। লিখেছিলাম, ‘অবসর সময়ে বই পড়া আর একটু আধটু লেখালিখি করার সামান্য চেষ্টা করি আমি।’ মনে মনে জানি, বৃথা এ চেষ্টা।
কনসালট্যান্ট মানুষটি কাঁধদুটো শ্রাগ করে, ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘এগুলো জাস্ট রাবিশ। কেন জানেন?’ মরা কাতলার চোখের মতো আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। তির্যক হেসে বললেন, ‘আপনার এই হবি কেরিয়ারের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক। কাজ তো করেন সেলস-এ। অবসরে আপনি কী করেন, তা কেউ জানতে চায় না। কোম্পানি আপনাকে পয়সা দিচ্ছে মুনাফা লোটার জন্য। যা পয়সা দিচ্ছে, আপনাকে কাজের মারফত কোম্পানিকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার বহুগুণ বেশি। এই সহজ সমীকরণে দুনিয়া চলে। আপনি অবসর সময়ে কী করেন, তা নিয়ে লিস্ট বদার্ড আপনার নিয়োগকারী। এসব ফালতু লাইন লিখে সিভি আর নিজের ভবিষ্যৎ বরবাদ করবেন না।’
থামলেন খানিক। দেওয়ালে লাগানো ‘ইওর কেরিয়ার, উইথ গোল্ডেন টাচ’ লেখা বিরাট পোস্টারটির ওপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। আমার দিকে তাকালেন। ফের বললেন, ‘আচ্ছা, একটা সাজেশন দিই? হবির সেকশনটা থাক, আই মিন হেডিংটা। আপনার লেখা বকওয়াস লাইনগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে লিখে দিচ্ছি, স্ট্র্যাটেজিক থিংকিং ইন আউট অফ দ্য বক্স ওয়েজ। মানে হল, অবসর যাপনেও আমি সাবেকি পথের বাইরে গিয়ে স্ট্র্যাটেজিকালি ভাবার চেষ্টা করি। হবিও দেখানো হল। আবার, আপনার ফ্রি টাইমটুকুও কী সুন্দরভাবে সংস্থার স্বার্থে মুনাফাময় হয়ে উঠল।’
কনসালট্যান্টের মুখে এবারে হাসি খেলে গেল হুশ করে। জামার কলারটা ঠিক করে নিলেন। ফের বললেন, ‘আপনি কিন্তু আমার থেকে রেগুলার সার্ভিস নিয়েছিলেন। বাট এই সাজেশনটার জন্য প্রিমিয়াম সার্ভিসের চার্জ পে করতে হবে।’ কিউআর কোড ছাপানো পোস্টকার্ডের মতো কাগজটা আমার সামনে এগিয়ে এসেছিল। শেষ কথাগুলো মনে পড়ে আজও। ‘এ যুগের চাকরিতে আপনার অবসর সময়ও কিন্তু কোম্পানির কেনা। ভুলে গেলে মস্ত বিপদ। মাথার সার্কিট বোর্ডে এটা ড্রিল করে ঢুকিয়ে নিন।’
অবসর কারে কয়? শব্দকোষে পাওয়া অর্থগুলো সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রার মতো লাগে। ফুরসত, ছুটি, কর্ম হইতে বিদায়, সুযোগ, ফাঁক, সুসময়। শেষ শব্দটার গায়ে সারাদিনের ক্লান্তির শেষে স্বপ্ন মিশে থাকে। ‘অবসর’ মানে তো নিজের জন্য সময়। একান্ত। কিংবা, অবসর মানে একটা সুইচ অফ করা চার্জে বসানো মোবাইল। ওই ফোনটাই আমি। অন্ধকার স্ক্রিনে আঙুল ছুঁইয়ে দিলে চুঁইয়ে পড়ে হালকা এক আলো। ফুটে ওঠে ব্যাটারি। শূন্য থেকে তা পূর্ণ হচ্ছে ক্রমশ। বাড়ছে পার্সেন্টেজ। পরের দিনের সংগ্রাম তো ওর কাছেও অজানা। আন্তর্জালের একটি উইন্ডো বলল, ‘অবসর শুধু বিশ্রাম নয়, নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করার সময়’।
এইটুকু বলে যদি হীরক রাজার মতো ‘ঠিক কিনা?’ বলে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া যেত, তাহলে বোঝা যেত, এর উত্তরে সমস্বরে ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক’ বলার লোকের সংখ্যা কমে আসছে ক্রমশ। বদলে যাচ্ছে অবসরের সংজ্ঞাও। বদলে যাচ্ছে না বলে বদলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বললে আরও খোলতাই হয়। ‘অবসর’ শব্দটি আজকাল মুখ খুলে রাখা পারফিউমের বোতলের মতো। উদ্বায়ী। প্রতি মুহূর্তে এই শব্দের গায়ে পড়ছে কর্পূরের ডিওডোরেন্ট।
এক বিখ্যাত সংস্থার প্রখ্যাত সিইও দিনকয়েক আগে সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা করে কাজ করার নিদান দিয়েছেন। শনিবার কেন কর্মীদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, এমন একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় হয়তো মনের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন সিইও সাহেব। ওঁর মুখ থেকে যা ধ্বনিত হয়েছিল, তা মোটামুটি এরকম। ‘রবিবারও যে আমি আপনাদের দিয়ে কাজ করাতে পারছি না, তা ভেবে আমার অনুশোচনা হচ্ছে। ওইদিনও (রবিবার) কাজ করিয়ে নিতে পারলে আমি খুশি হতাম। কারণ, আমি নিজে রবিবার কাজ করি। বাড়িতে বসে থেকে করবেনটা কী? কতক্ষণ বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবেন? আর স্ত্রীও কতক্ষণ তাঁর স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন?’
এর পরেই বিতর্কের ঝড় ওঠে দেশজুড়ে। সামাজিক মাধ্যমের দেওয়াল উপচে পড়ে তির্যক মন্তব্যে। তবে এ সংক্রান্ত নানা খবর ঘেঁটে, বিভিন্ন হাইপারলিঙ্ক ও ব্লগের ডাকে সাড়া দিয়ে যা জানতে পেরেছি, তাতে দেখেছি নিজেদের যুক্তি নিয়ে যুযুধান দুপক্ষই। সংস্থাকর্তার পক্ষ নিয়ে একদল বলছেন, ‘দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে, তার চেয়েও বড় কথা, কাজের জগতে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুর্বার ইচ্ছে থাকলে ঘড়ি দেখে কাজ করলে চলবে না আর।’ মাসের শেষে ভাত যোগাচ্ছে যে, ২৪ ঘণ্টাই তাকে উৎসর্গ করার হাঁক দিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, টিকে থাকতে গেলে হতে হবে নিবেদিতপ্রাণ।
……………………………………..
সিইও সাহেবের বক্তব্যের পরে অবশ্য সাফাই গাওয়া হয়েছে ওই সংস্থার পক্ষ থেকে। মাঠে নেমে পড়েছিলেন মানবসম্পদ বিভাগের শীর্ষ আধিকারিক। লিখেছিলেন, সিইও-র কথার ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। একটি ইনফর্মাল আলোচনায় এমন কথা বলা হয়েছিল। কর্মীদের ৯০ ঘণ্টা কাজ করতে বলার কথাটা কখনওই তাঁর ‘অর্ডার’ নয়। এ কথায় অবশ্য চিঁড়ে ভেজেনি। ঘোলা জলে ঢেউ উঠেছে ফের। সিইও-র বেতন উল্লেখ করে অনেকে লিখেছেন, উচ্চ‘কোটি’র লোকেদের রবিবারও উচ্চকোটিতে থাকে। আপনি কাজ চালিয়ে যান, স্যর।
……………………………………..
মজার বিষয় হল, এমন কথা শুনে চমকে উঠেছে আমূল গার্লও। এই ঘটনার পরে সিরিজে এসে গিয়েছে একটি নয়া কার্টুন। দেখা যাচ্ছে, স্যুট পরা এক ব্যক্তি দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের রবিবারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে রয়েছেন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, হাঁ করে পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমূল বালিকা। সেই মেয়েটির মতো ঘাবড়ে যাওয়া এবং বিস্মিত অন্য পক্ষের মানুষরা বলছেন, ‘মাইনে পাওয়া কাজের বাইরেও এক মস্ত জীবন পড়ে থাকে।’ আরও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে হার্ড ওয়ার্ক ও স্মার্ট ওয়ার্কের কথা। তাঁদের বক্তব্য, কর্মজগতে আমার যে কর্তব্যগুলো পালনীয় সেটুকু দিনের শেষে করে দিতে পারলেই সংস্থার আর কিছু বলার এক্তিয়ার থাকে না। ৯০ ঘণ্টা কাজ করে দেশোদ্ধার হয় না! আর বেশি করে কাজ করলেই প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে না। এক অর্থনীতিবিদ ভুলে যাওয়া ব্যাকরণ পড়ে নিতে বলেছেন ফের। মনে করিয়ে দিয়েছেন, সংস্থার মুনাফা মূলত কর্মীদের প্রোডাক্টিভিটি অর্থাৎ, উৎপাদনশীলতার উপরে নির্ভর করে। কাজের ঘণ্টার ওপরে নয়।
সিইও সাহেবের এমন বক্তব্যের পরে অবশ্য সাফাই গাওয়া হয়েছে ওই সংস্থার পক্ষ থেকে। মাঠে নেমে পড়েছিলেন মানবসম্পদ বিভাগের শীর্ষ আধিকারিক। লিখেছিলেন, সিইও-র কথার ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। একটি ইনফর্মাল আলোচনায় এমন কথা বলা হয়েছিল। কর্মীদের ৯০ ঘণ্টা কাজ করতে বলার কথাটা কখনওই তাঁর ‘অর্ডার’ নয়। এ কথায় অবশ্য চিঁড়ে ভেজেনি। ঘোলা জলে ঢেউ উঠেছে ফের। সিইও-র বেতন উল্লেখ করে অনেকে লিখেছেন, উচ্চ‘কোটি’র লোকেদের রবিবারও উচ্চকোটিতে থাকে। আপনি কাজ চালিয়ে যান, স্যর। প্রবল ব্যস্ত সংস্থাকর্তা হয়তো জানেন না, তাঁর এই বক্তব্যের পরে সামাজিক মাধ্যমে চালু হয়ে গিয়েছে বউ কিংবা বরের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা। তৈরি হয়েছে অজস্র মিম ও রিল।
তবে উক্তি-বক্রোক্তি, ধ্বনি-প্রতিধ্বনির মধ্যেই কোথাও ক্রমশ লেন বদল করছে মানবসম্পদ নিয়োগের ধারা। আমার কেরিয়ার প্রোগ্রেশন কনসালট্যান্ট ভুল কিছু বলেননি। আরও বেশ কয়েকজন মানবসম্পদ আধিকারিকের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, হবু কর্মীর হবি কিংবা অবসরযাপনের প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবতেই রাজি নন এ যুগের এইচআর। এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক তো মুখের ওপর বলেই দিলেন, ‘অবসর আবার কী? তোমার অবসর, তোমার হেডেক। আমার নয়।’ এআই প্ল্যাটফর্মে বায়োডাটা আপলোড করে সংশোধনের নির্দেশ দেওয়ার পরে যে ফাইলটি ডাউনলোড করেছি, অবাক হয়ে দেখেছি, সেখান থেকেও গায়েব হয়ে গিয়েছে হবি।
দিনে দু’ঘণ্টা সেতারের রেওয়াজের জন্য দিতে হয় জানতে পেরে আমার কলেজজীবনের এক বন্ধুকে কর্মহারা করেছিল এই সমাজ, টানা দু’বছর। সুর গিয়েছে ওর বহুকাল। স্যুট এসেছে!
আন্তর্জালে সদ্য পড়া তিনটে লাইন দিয়ে শেষ করি।
প্রশ্নকর্তা: তুমি কি রবিবার বউয়ের দিকে তাকাও?
হবু কর্মী: একদম না, স্যর।
প্রশ্নকর্তা: স্যালারি কত নেবে আলোচনা করে নিই? এখনই?
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….