সত্তরের মাঝামাঝি লোডশেডিং মানে এপাড়া-ওপাড়ার অহেতুক বোমাবাজি। কাঁচের বোতল রাস্তায় আছড়ে পড়ার আওয়াজ, গুলির শব্দ। পাইপগান। ওই লোডশেডিং– এই ক্রস ফায়ারে পড়ে মামাবাড়িতে বেড়াতে আসা সদ্য যুবকের হাতের তিনটে আঙুল উড়ে যাওয়া। যে তার মাত্র কয়েক মাস আগে, ঊর্ধ্বমুখী বেকারত্বের বাজারে, একটি কারখানায় লেদ চালানোর চাকরি পেয়েছে। সে আর আসে না কোনওদিন আমাদের পাড়ায়। লোডশেডিং কিন্তু থেকে যায়।
লোডশেডিং মানে ‘পাওয়ার কাট’ নয়। লোডশেডিং মানে নয় কোনও কেবল ফল্ট বা গ্রিড ফেলিয়র, যা দিনের পর দিন অন্ধকারে রাখে বড় বড় শহর, দেশে বা বিদেশে। লোডশেডিং মানে, আমার বেড়ে ওঠার মধ্যবিত্ত গ্রীষ্মের সন্ধ্যার এক অলিখিত নিয়ম। এখনও কেন হচ্ছে না? এই আকুতি নিয়ে ভজকট নেসফিলডের গ্রামার অথবা কেশব নাগের সিঁড়ি ভাঙার দিকে তাকিয়ে থাকা। যেই হল অমনি সারা পাড়া জুড়ে ‘আহহহহহহ’, অবরোহণ। অনেকক্ষণ পর আলো এলে আবার ‘আহহহহহহ’। এবার আরোহণ। শহর, শহরতলি, গ্রামাঞ্চলকে একই আসনে বসিয়ে হাতে লণ্ঠন ধরিয়ে দেওয়ার নাম– লোডশেডিং।
সত্তরের মাঝামাঝি লোডশেডিং মানে এপাড়া-ওপাড়ার অহেতুক বোমাবাজি। কাচের বোতল রাস্তায় আছড়ে পড়ার আওয়াজ, গুলির শব্দ। পাইপগান। ওই লোডশেডিং– এই ক্রস ফায়ারে পড়ে মামাবাড়িতে বেড়াতে আসা সদ্য যুবকের হাতের তিনটে আঙুল উড়ে যাওয়া। যে তার মাত্র কয়েক মাস আগে, ঊর্ধ্বমুখী বেকারত্বের বাজারে, একটি কারখানায় লেদ চালানোর চাকরি পেয়েছে। সে আর আসে না কোনও দিন আমাদের পাড়ায়। লোডশেডিং কিন্তু থেকে যায়। তার রং বদলায়। পাল্টায় অবরোহণ ও আরোহণের শব্দবন্ধ। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলে পাড়া তখন চেঁচিয়ে বলে, ‘জ্যোতিবাবু গেলেন’। আলো ফিরলে সে গলা ফাটিয়ে জানান দেয়, ‘জ্যোতিবাবু এলেন’। এসবই সন্ধেবেলার মজা, কারণ দিনের বেলা দেওয়ালে ,পাঁচিলে লেখা স্লোগান সূর্যের আলোয় ঝকমক করে।
লোডশেডিং-কে আমরা ভালোবেসে ডাকি ‘লোডশেড’। যেমন বুবাই, মিঠু, বাবুন, টুনি ইত্যাদি। আরেকটু বড় হলে পাঠ্যবই যখন আরও কঠিন মনে হয়, সন্ধেবেলা বাধ্যতামূলক ইতিহাস-ভূগোলের নজর এড়িয়ে ষাট ওয়াটের বাল্বের দিকে তাকাই মাঝে মাঝে। সে যদি দপদপিয়ে ওঠে, তাহলে হবে, নিশ্চিত হবে। আর হলেই বই বন্ধ। কারণ মোমবাতির কম্পমান শিখা আমার চোখে সয় না, মাথা ঘুরে যায়। হ্যারিকেনের ধোঁয়ায় কাশি আসে, অ্যাজমার ভ্রূকুটি। কিন্তু কোনও কোনও সন্ধ্যায় আশা জাগিয়েও ঠিক সময়ে লোডশেড হয় না। মনে হয় স্কুলের শিক্ষককুল এবং আমার মাতা-পিতা এক গভীর ষড়যন্ত্র করেছেন যাতে আমার পড়ায় ব্যাঘাত না ঘটে। তখন ঘটনাটি ঘটে রাতে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি কুলকুলিয়ে ঘাম, সিলিং ফ্যান নিথর। আমার ছটফটানিতে মা হাতপাখা পরিষেবা চালু করেন। মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে পড়ছেন, হাতপাখা লেগে যাচ্ছে আমার গায়ে। তখন দেওয়ালে ঠেকিয়ে নিচ্ছেন পাখা, তারপর আবার তিনি পাংখাপুলার। কখন যে ফ্যান ঘুরতে শুরু করেছে ঠাহর হয় না, কিন্তু ঘাম শুকনোর সময় ঠান্ডায় শরীর অবশ হয়ে ঘুম নেমে আসে।
আমার কৈশোরের সন্ধের লোডশেডিং মানে মা-মাসিদের ব্লাউজবিহীন শাড়ি পরার অধিকার। পুরুষদের খালি গা, হাঁটুর ওপর ধুতি। অর্থাৎ দলমত নির্বিশেষে ওই কয়েক ঘণ্টা তাঁরা গান্ধীজির ফলোয়ার। ওই অন্ধকার মানে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সাম্যবাদও বটে। মোমবাতির আলোয়, আরশোলা তাড়াতে তাড়াতে তড়িঘড়ি রাতের খাওয়া। তারপর ফোলডিং খাট নিয়ে যেই উঠোনে, দেখি বাড়িওয়ালার মেয়ে ঝুলবারান্দায়। এক দৌড়ে উল্টোদিকের বাড়ি গিয়ে বন্ধুকে খবর দিই। সে দোতলায় ওঠে। আমি ফিরে আসি উঠোনে। ফোল্ডিং খাটে শুয়ে একফালি আকাশের দিকে তাকাই। কী আশ্চর্য, সেখানে স্পষ্ট কালপুরুষ, কোমরে বেল্ট, তরোয়াল। তার কুকুর লুব্ধককে বোধহয় পাড়ার নেড়িরাও চিনতে পারে। না হলে তারা খামোকা ডেকে উঠবে কেন? ডাকতেই থাকে। নিশিকুটুম্ব আসেনি তো? এসেছে এবং বাড়ির পিছন দিকে উঁচু পাঁচিলের ওপর বসে আছে। না পারছে এদিকে নামতে না পারছে ওদিকে। তাকে সময় দেওয়া হয়। সে বসে থাকে আলো আসার অপেক্ষায়, তারপর ধুপ করে আওয়াজ আর গলি দিয়ে ছুটে যাওয়া পায়ের শব্দে আমরা নিশ্চিন্ত হই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমার কাছে লোডশেডিং-এর অর্থ উনিশশো তিরাশির ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ সেমিফাইনাল। ‘কারেন্ট’ চলে যাওয়ায় পাড়ার দু-তিনটি টিভি তখন আক্ষরিক অর্থে বোকা বাক্স। উঠোনে, রেডিও ঘিরে, টেনশনমাখা একপাল মুখ– যশপাল, মহিন্দর, সন্দীপ পাটিল যাদের যত্ন করে নিয়ে যাবেন লর্ডসে। অথবা লোডশেডিং মানে বাচ্চাদের খুঁজে না পেয়ে সারারাত মা বেড়ালের কান্না। যে বা যারা সেই বিকেলে বাচ্চাগুলোকে বস্তাবন্দি করে ছেড়ে এসেছিল বড় রাস্তার ওপারে, তাদের দু’চোখ এক করতে না পারার শাস্তি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বয়স বাড়লে লোডশেডের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। সে মনপড়া জানে। সবাইকে উঠোনে পাঠিয়ে সে আমায় বাথরুমে নিয়ে আসে। উলঙ্গ করে। অন্ধকারে সে আমার হাত ধরে আমারই শরীরে বোলায়। যে মুহূর্তে বুঝি এই হলাম আমি, অদ্ভুত মায়া হয় নিজের ওপর। টিনের চালের ভাঙা অংশে গুঁজে রাখা চটের টুকরো সরিয়ে দেখি, চাঁদ। প্রতিপদ। নিজেকে দেখি। পর মুহূর্তে ঢেকে দিই ওই অসহ্য আলো। বুঝি, অন্ধকার আসলে আমার সাহসী সত্তা। যে সাহস ভবিষ্যতে প্রেমিকার হাত ধরতে শেখাবে। এক গলি থেকে অন্য গলি। সেদিনও লোডশেডিং উত্তর কলকাতা জুড়ে। আরও ঘন হব কি হব না– এই দোটানায় নষ্ট হয় মহার্ঘ কয়েক মিনিট, সেই ফাঁকে কোনও এক বাড়ির জনলা দিয়ে গলে আসে ‘ইমারজেন্সি লাইট’-এর আলো। আমাদের গায়ে পড়ে। হাত ছেড়ে দিই, কিন্তু দেখি ছায়াদের আলাদা করা যাচ্ছে না। নতুন প্রেম আসে যখন, তখনও লোডশেডই পরিত্রাতা। ফাঁকা বাড়ি আদরের পীঠস্থান। কিন্তু প্রেম ঘড়ি দেখার ধার ধারে না। এদিকে প্রেমিকাকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া যেকোনও প্রেমিকের কর্তব্য। অথচ তখন পাড়ার রকে সান্ধ্য-মজলিশ শুরু হয়ে গিয়েছে। লোডশেড অভয় দেয়। ঝুপ করে চরাচর মিশকালো। সেই ফাঁকে দু’জনের মধ্যে সামান্য দূরত্ব রেখে হেঁটে চলে যাই বড় রাস্তার দিকে, যেন অচেনা এক নারী ও এক পুরুষ। কোন পোড় খাওয়া গোয়েন্দা চোখেও সেই প্রেমের গ্রেফতার হওয়ার সুযোগ করে দেয়নি বন্ধু লোডশেডিং।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: গ্রামীণ মেয়েদের গ্রীষ্মদুপুরের আড্ডা কি চিরতরে হারিয়েছে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমার কাছে লোডশেডিং-এর অর্থ উনিশশো তিরাশির ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ সেমিফাইনাল। ‘কারেন্ট’ চলে যাওয়ায় পাড়ার দু’-তিনটি টিভি তখন আক্ষরিক অর্থে বোকা বাক্স। উঠোনে, রেডিও ঘিরে, টেনশনমাখা একপাল মুখ– যশপাল, মহিন্দর, সন্দীপ পাটিল যাদের যত্ন করে নিয়ে যাবেন লর্ডসে। অথবা লোডশেডিং মানে বাচ্চাদের খুঁজে না পেয়ে সারারাত মা বেড়ালের কান্না। যে বা যারা সেই বিকেলে বাচ্চাগুলোকে বস্তাবন্দি করে ছেড়ে এসেছিল বড় রাস্তার ওপারে, তাদের দু’চোখ এক করতে না পারার শাস্তি। লোডশেডিং মানে একবুক কিশোর প্রার্থনাও, পাড়ার নতুন বউদি যেন ‘জন অরণ্য’-এর লিলি চক্রবর্তী হন। লোডশেডিং মানে, কানাগলির স্টেজে নাটকীয় সংলাপ– ‘আহ, ছাড়ো না, কী হচ্ছেটা কী? কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হবে।’ ‘এই অন্ধকারে দেখবে কোন…?’। একটা অদ্ভুত শব্দ– ‘চকাস’। তারপর আর একটা।
উইংস থেকে এক দলছুট জোনাকি ঢুকে পড়ে আমার ঘরে। অন্ধকারে সেও পালানোর পথ পায় না।