ভারতীয় প্রেক্ষিতে বেশিরভাগ বেতনভূক কর্মচারীর কাছে এই শ্রম আইন উলঙ্ঘন করে কাজ করা কোনও গোপন বিষয় নয়। প্রতিদিনই তাঁরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের থেকে উপদেশ শুনে দিন শুরু করেন, কতটা নিয়মানুবর্তী হতে পারেন সে বিষয়ে জ্ঞানলাভ করে থাকেন। কীভাবে এই ধরনের মুখ বুজে কাজ করে গেলে, একজন কর্মচারীর জীবন সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে, তাঁর চরিত্র দৃঢ় হতে পারে এবং তাঁর এই শ্রমদান, কীভাবে দেশ ও দশের কাজে লাগতে পারে, সেই সব শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, সুতরাং এল অ্যান্ড টি, কিংবা এই ধরনের কর্পোরেট সংস্থার মাথাদের থেকে এই ধরনের পরামর্শ নতুন কিছু নয়।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
মানুষ কি যন্ত্র? সে কি যন্ত্রের মতো নিরলস কাজ করে যেতে পারে? যন্ত্রের না হয় মন নেই, মানুষেরও কি মন নেই? তাঁর কি বিশ্রামের প্রয়োজন নেই, তাঁর কি মানসিক বিনোদন লাগে না? সে কি যন্ত্রের মতো আচরণ করে যেতে পারে, না চায়? যদিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে, এই প্রশ্নগুলো করা উচিত নয়, তাও এই সমস্ত প্রশ্ন আবার নতুন করে উঠে আসছে। যতই একজন মানুষকে মাসিক ৬ সংখ্যার বেতন দেওয়া হোক, তাও কি সে যন্ত্র হয়ে উঠতে পারে? তাঁর তো কল্পনাশক্তি আছে, একটা মন আছে, সত্তা আছে। কিন্তু কিছু কিছু বড় সংস্থার মাথাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, একজন মানুষকে নিঙরে, ছিবড়ে করে, তাঁদের মানবিক সত্তাকে শেষ করে, তাঁদের থেকে কাজ ‘করিয়ে নেওয়া’র মধ্যে দিয়েই যেন পরমানন্দ। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে কাজ এবং জীবনের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোর পরিবর্তে শুধু কাজ করিয়ে নিতে পারলেই এই সমস্ত সংস্থার মোক্ষলাভ সম্ভব।
২০২৩ সালে ইনফোসিসের চেয়ারম্যান নারায়ণ মূর্তির সাপ্তাহিক ৭০ ঘণ্টা কাজের নিদানকে টপকে, লারসেন অ্যান্ড টুব্রো সংস্থার চেয়ারম্যান সুব্রহ্মমনিয়ম সাপ্তাহিক ৯০ ঘণ্টা কাজের ফরমান এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাপ্তাহিক ছুটি বিসর্জন দিয়ে কী করে নিজের এবং সংস্থার উন্নতি করা যায়, সেই দিকটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা শুরু করতে বলেছেন তিনি। তাঁর একটি কথা এখন সবার মুখে মুখে ঘুরছে। তিনি বলেছেন, ‘ছুটির দিনে আর কতক্ষণ স্ত্রী’র মুখের দিকে তাকিয়ে, বাড়িতে বসে থাকবেন, তার চেয়ে আরও বেশি বেশি কাজ করুন, যাতে দেশ এবং জাতির উন্নতি সাধন হয়।’ একটি আভ্যন্তরীন ভিডিও বার্তায় শোনা গেছে তিনি বলছেন “Who wouldn’t want to sacrifice their health, relationships, and interests in exchange for more targets?” একটি দেশের শ্রমিকরা যেখানে রোজদিন, নিত্যনতুন চাপ, কম বেতন এবং সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন, সেখানে এই ধরনের বক্তব্য শুধু নিন্দনীয় নয়, লজ্জাজনকও বটে। কিন্তু এই ধরনের কথা কি আমরা এই প্রথম শুনছি? অনেকের হয়তো খেয়াল নেই, শুধু এই দু’জনেই নন, আরও বেশ কিছু সংস্থার মাথারা কিন্তু এই ধরনের কাজ করার প্রস্তাব রেখেছেন। ওলা-র ভবিশ আগরওয়াল এবং বম্বে শেভিং কোম্পানির কর্ণধার শান্তনু দেশপান্ডেও একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যার মধ্যে দিয়ে নাকি চরিত্র গঠন থেকে দেশ গঠন সবই সম্ভব। এঁদের সবার বক্তব্যের কিন্তু একটাই নির্যাস, সংস্থার লাভ এবং আরও বেশি লাভ।
…………………………………………………
অবশ্য ভারতীয় প্রেক্ষিতে বেশিরভাগ বেতনভূক কর্মচারীর কাছে এই শ্রম আইন উলঙ্ঘন করে কাজ করা কোনও গোপন বিষয় নয়। প্রতিদিনই তাঁরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের থেকে উপদেশ শুনে দিন শুরু করেন, কতটা নিয়মানুবর্তী হতে পারেন সে বিষয়ে জ্ঞানলাভ করে থাকেন। কীভাবে এই ধরনের মুখ বুজে কাজ করে গেলে, একজন কর্মচারীর জীবন সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে, তাঁর চরিত্র দৃঢ় হতে পারে এবং তাঁর এই শ্রমদান, কীভাবে দেশ ও দশের কাজে লাগতে পারে, সেই সব শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, সুতরাং এল অ্যান্ড টি, কিংবা এই ধরনের কর্পোরেট সংস্থার মাথাদের থেকে এই ধরনের পরামর্শ নতুন কিছু নয়।
………………………………………………….
আমেরিকায় প্রথম চালু হয়, দৈনিক ৮ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ৫ দিনের কর্মসংস্কৃতি। তার পিছনেও দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। এই প্রথাই, এখনও কমবেশি সারা বিশ্বে স্বীকৃত। তার আগে শিল্প বিপ্লবের সময়ে, সাপ্তাহিক ৮০ থেকে ১০০ ঘণ্টা কাজেরও নজির পাওয়া যায়। ১৯২৬ সালে ফোর্ড সংস্থা, দৈনিক ৮ ঘণ্টা ধরে, সপ্তাহে ৫ দিন হিসেবে কাজের ব্যবস্থা চালু করেন। দেখা যায়, তাতে কর্মীরাও খুশি থাকছেন এবং সংস্থার উৎপাদনও বাড়ছে। পরে অন্যান্য বেশ কিছু সংস্থা, সেই পদ্ধতিই চালু করেন এবং পরবর্তীতে বহু দেশ শ্রম আইন সংশোধন করে এই নিয়মই চালু করেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, সেই শ্রম আইন লঙ্ঘন করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। সংগঠিত শ্রমিক না রেখে অসংগঠিত শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি গিগ শ্রমিকদের কথা যদি তোলা যায়, তাহলে দেখা যাবে সেক্ষেত্রে শ্রম আইন মানার তো কোনও বালাই নেই। বলা হচ্ছে, তাঁরা সবাই নাকি সংস্থার সঙ্গী এবং ওই ব্যবসার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, সুতরাং তাঁদের আবার নিষ্পেষণ কীসের?
অবশ্য ভারতীয় প্রেক্ষিতে বেশিরভাগ বেতনভূক কর্মচারীর কাছে এই শ্রম আইন উলঙ্ঘন করে কাজ করা কোনও গোপন বিষয় নয়। প্রতিদিনই তাঁরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের থেকে উপদেশ শুনে দিন শুরু করেন, কতটা নিয়মানুবর্তী হতে পারেন সে বিষয়ে জ্ঞানলাভ করে থাকেন। কীভাবে এই ধরনের মুখ বুজে কাজ করে গেলে, একজন কর্মচারীর জীবন সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে, তাঁর চরিত্র দৃঢ় হতে পারে এবং তাঁর এই শ্রমদান, কীভাবে দেশ ও দশের কাজে লাগতে পারে, সেই সব শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, সুতরাং এল অ্যান্ড টি, কিংবা এই ধরনের কর্পোরেট সংস্থার মাথাদের থেকে এই ধরনের পরামর্শ নতুন কিছু নয়। উত্তর অমেরিকায় যেখানে ৩৮ ঘণ্টা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে ৩৭ ঘণ্টা কাজ করাটাই দস্তুর, সেখানে তথ্য বলছে, এশীয় মহাদেশের বেশিরভাগ কর্মচারীরাই সাপ্তাহিক প্রায় ৫০ ঘণ্টা কাজ করেন। বেশি ঘণ্টা কাজ করার মানেই কিন্তু বেশি উৎপাদনশীলতা নয়, সেটা কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি সংস্থার মাথারা বুঝতে চান না। একজন কর্মচারীর মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভালো থাকা, তাঁর পারিবারিক চাহিদা, এবং বেশিদিন কাজ করার ইচ্ছে– এই সমস্ত কিছুই কিন্তু একজন ব্যক্তি কর্মচারীর উৎপাদনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। দিনে ২৪ ঘণ্টা কাজ করলে এবং ছুটি না নিলেই কিন্তু সব সমস্যা মিটে যায়– এমনটা নয়।
………………………………………………
পড়ুন অন্য লেখাও: ট্রাফিকে চাকরি রূপান্তরকামীদের, সমাজের পক্ষে তা সবুজ সিগন্যাল?
……………………………………………….
যে দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে, তিনি নিজে দিনে ২২ ঘণ্টা কাজ করেন এবং কোনও ছুটি নেন না, সেই দেশের বড় বেসরকারি সংস্থার মালিকরা এই ধরনের কথা বলবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, একটি বামপন্থী দলের এক সাংসদ ছাড়া, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বেশিরভাগই কিন্তু এই বিষয়ে মুখ খোলেননি। শুধু হাসিঠাট্টা করে, মিম বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তা পোস্ট করে, লাইক কুড়োনোর থেকেও কিন্তু বেশি জরুরি ছিল সেটা। তাঁরা হয়তো ওইটুকু করেই তাঁদের দায়িত্ব সেরেছেন, কিন্তু বিষয়টা হাসি মশকরার নয়, বা মিম শেয়ার করার মতো নয়, এর পিছনেও সূক্ষ্ম রাজনীতি আছে। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভূমিকাতে বলা হয়েছে, ‘শ্রম নিজে কখনও পণ্য নয়’, সেটা হয়তো আজকের আমাদের দেশের বেসরকারি সংস্থার মাথারা এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভুলিয়ে দিতে চান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশো বছর আগে তাঁর রক্তকরবী উপন্যাসে দেখিয়েছিলেন, কীভাবে একজন মানুষকে শুধু শ্রমিক নয়, একজন নম্বরযুক্ত দাসে পরিণত করা হচ্ছে, যাঁর কোনও আনন্দ নেই, সুখ নেই, ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই। ধীরে ধীরে আমাদের দেশটাও যেন রবীন্দ্রনাথের যক্ষপুরী হয়ে উঠছে, যেখানে কোনও ছুটি থাকতে নেই। সেই যক্ষপুরীর এক শ্রমিক ফাগুলালের কথা অনুযায়ী ‘বনের মধ্যে পাখি ছুটি পেলে উড়তে পায়, খাঁচার মধ্যে তাকে ছুটি দিলে মাথা ঠুকে মরে। যক্ষপুরে কাজের চেয়ে ছুটি বিষম বালাই।’ অন্যতম চরিত্র বিশুপাগল এবং চন্দ্রার কথার মধ্যেও উঠে আসে সেই কথা, কাজ করতে করতে, সেটাই এমন এক নেশার পর্যায়ে চলে যায় যে ছুটি পেলেও একজন শ্রমিক ফাগুলাল, ‘বারো ঘণ্টার পরে আরও চার ঘণ্টা যোগ করে খেটে মরে, তার কারণটা ফাগুও জানে না, তুমিও জানো না। অন্তর্যামী জানেন। তোমার সোনার স্বপ্ন ভিতরে ভিতরে ওকে চাবুক মারে সে চাবুক সর্দারের চাবুকের চেয়েও কড়া।’
আসলে এইভাবে শ্রমিকদের বুকের ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে, তাঁদের দাস বানিয়ে কাজ করলে, মালিকের মুনাফাই বাড়ে, যার কোনও অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথ একশো বছর আগে, সেই কথাটাও তাঁর উপন্যাসে বলে গিয়েছেন আর আজ তা সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে। সম্পদ আরোহণ করা একটা নেশা, সেই নেশার কোনও শেষ নেই, রক্তকরবীর যক্ষরাজেরও ছিল না, আজকের বহুজাতিক সংস্থার মালিকদেরও নেই।
‘ওদের সোনা তো অনেক জমল, আরো কি দরকার।
বিশু: দরকার বলে পদার্থের শেষ আছে। খাওয়ার দরকার আছে, পেট ভরিয়ে তার শেষ পাওয়া যায়; নেশার দরকার নেই, তার শেষও নেই। ঐ সোনার তালগুলো যে মদ, আমাদের যক্ষরাজের নিরেট মদ। বুঝতে পারলে না?’
তাই প্রশ্নটা করতে হয়, সাপ্তাহিক কত ঘণ্টা কাজ করলে, মালিকের মুনাফা বাড়ে আর শ্রমিকেরা দাসে পরিণত হয়?
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved