বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ যারা কুকুর ভালবাসেন, তাঁরা একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সমীক্ষা বলছে, ৭০% নারী মনে করেন, যে পুরুষ কুকুর ভালোবাসেন, তিনি খুব সহজ মানুষ। ৭৬% নারী মনে করেন, কুকুর পোষা পুরুষরা অন্যদের থেকে অনেক বেশি যত্নশীল ও দায়িত্ববান। ৬৪% নারী বলেছেন, কুকুর থাকলে একজন পুরুষকে ডেট করার জন্য উপযুক্ত মনে হয়। বড় জাতের কুকুর (যেমন ল্যাবরাডর বা গোল্ডেন রিট্রিভার) পোষা পুরুষদের আরও রক্ষাকারী ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করা হয় এবং ৫৯% নারী এটিকে আকর্ষণীয় মনে করেন। তবে শুধু কুকুর নয়, বিড়াল, পাখি, মাছ এই পোষ্যদের তালিকায় বহাল তবিয়তে আছে।
‘আপনার বাড়িতে কি কুকুর আছে?’ এই একটা প্রশ্ন এখন রমরমিয়ে চলছে ডেটিং সাইটে। কী করেন, কত টাকা উপার্জন করেন, কোথায় থাকেন এই বিষয়গুলো এখন গৌণ। বসন্তের ঝরা পাতার মরমর শব্দ পাল্টে নিয়েছে ভালোবাসার, ভালো থাকার হিসেবনিকেশ। দু’জনে একসঙ্গে হাঁটার আগে, জেনে নেওয়া হচ্ছে পোষ্যের খবরাখবর। আর যদি দু’জনের প্রিয় পোষ্য একই হয়, তাহলে তো কেল্লাফতে। সমীক্ষা বলছে, এই ধরনের যুগল চুটিয়ে কাটাচ্ছে জীবনের আনন্দ। লুটে নিচ্ছে সর্বসুখ। প্রথা ভেঙে তাঁদের পোষ্যকেই ছেলেমেয়ের মতো রেখে কাটিয়ে দিচ্ছে একটা জীবন। যে জীবনে লেখা হচ্ছে অন্য একটা গল্প, যে গল্পে একটা পোষ্য হয়ে উঠছে বন্ধু, ছেলে, মেয়ে কিংবা প্রিয়জন।
কুকুর চিরকালই মানুষের দোসর ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে এই সিচুয়েশনশিপের যুগে শুধুমাত্র একটাই আশার আলো যে এখনকার যুগলরা পোষ্যের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। সমীক্ষা বলছে, একজন যুবককে কেমন দেখতে, কী চাকরি করে, পরিবার কেমন, অথবা তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা কী– সেটা নিয়ে মেয়েরা এখন অতটা ভাবিত নয়। উপরন্তু সেই ছেলেটি যদি কোনও কুকুরের সঙ্গে ছবি দেয় সেটা তাঁদের কাছে আকর্ষণের হয়ে উঠছে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই। পোষ্যের সূত্র ধরেই দু’জনের কথা শুরু হচ্ছে। তারপরে সেই সম্পর্ক পরিণতি পাচ্ছে। জানুয়ারি ২০২৪ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সাল পর্যন্ত টিন্ডারে একটি প্রশ্ন লাফিয়ে বেড়েছে। ‘আপনি কি পোষ্য ভালোবাসেন?’ গ্রাফ বলছে প্রায় ৮% মানুষ এই প্রশ্নটি একে অপরকে করেছেন। এই পরিসংখ্যান যদিও ভারতের মধ্যে।
আবার বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ যারা কুকুর ভালোবাসেন, তাঁরা একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সমীক্ষা বলছে– ৭০% নারী মনে করেন, যে পুরুষ কুকুর ভালোবাসেন, তিনি খুব সহজ মানুষ। ৭৬% নারী মনে করেন, কুকুর-পোষা পুরুষরা অন্যদের থেকে অনেক বেশি যত্নশীল ও দায়িত্ববান। ৬৪% নারী বলেছেন, কুকুর থাকলে একজন পুরুষকে ডেট করার জন্য উপযুক্ত মনে হয়। বড় জাতের কুকুর (যেমন ল্যাব্রাডর বা গোল্ডেন রিট্রিভার) পোষা পুরুষদের আরও রক্ষাকারী ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করা হয় এবং ৫৯% নারী এটিকে আকর্ষণীয় মনে করেন।
তবে শুধু কুকুর নয়, বিড়াল, পাখি, মাছ এই পোষ্যদের তালিকায় বহাল তবিয়তে আছে। বিড়ালপ্রেমীরা সাধারণত সংবেদনশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং ধৈর্যশীল বলে বিবেচিত হন। যে সমস্ত যুগল শান্ত এবং ঘরোয়া পোষ্য খোঁজেন, তাঁদের মধ্যে বিড়াল বেশ জনপ্রিয়। মনোবিদদের মতে জলজ পোষ্য মানসিক চাপ কমায় এবং দাম্পত্য জীবনে শান্তি নিয়ে আসে। তাই অনেক যুগলের মতে অ্যাকোয়ারিয়াম সাজানো ও রক্ষণাবেক্ষণ একসঙ্গে করলে সম্পর্ক মজবুত হয়। ভারতীয় বাড়িতে প্রচলিত পোষ্য হল পাখি, বিশেষ করে যে সমস্ত প্রেমিক যুগল একসঙ্গে খাঁচা সাজাতে ভালোবাসেন, তাঁদের কাছাকাছি আনে বিশেষ কোনও পাখি।
তুমি তখন সদ্য ফিরেছ বিদেশ থেকে। তোমার সঙ্গে তোমার বিদেশি পোষ্য। উঁহু, তুমি বলতে ‘তোমার ছেলে’। সেই প্রথম বুঝেছিলাম, একটা কুকুর কতটা আপন হতে পারে। আমাদের মধ্যে যখন ঝগড়া হয়ে কথা বন্ধ থেকেছে দিনের পর দিন, তখন তোমার পোষ্যই হয়ে উঠেছে আমার রাগ ভাঙানোর উপায়। ওর জন্য কোনও বিশেষ বার্তা কিংবা উপহার এক নিমেষে তোমার পাহাড়প্রমাণ রাগ ভাঙিয়ে দিয়েছে।
কুকুরকে আদর করলে বা তার চোখের দিকে তাকালে শরীরে অক্সিটোসিন (ভালোবাসার হরমোন) নিঃসৃত হয়। এটি কর্টিসল (দুঃশ্চিন্তার হরমোন) কমিয়ে মানসিক স্বস্তি আনে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১০ মিনিট কুকুরকে আদর করলে কর্টিসলের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ৭৪% পোষ্য মালিক জানিয়েছেন, কুকুর নেওয়ার পর তাদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়েছে। বিখ্যাত এক হিন্দি ওয়েব সিরিজ ‘পাতাললোক’-এর প্রথম সিজনে এক দৃশ্য ছিল– যেখানে একটি চরিত্র অন্য একটি চরিত্রকে খুন করার উদ্দেশ্যে গন্তব্যে এসে পৌঁছয়, কিন্তু সে দেখে যাকে খুন করতে এসেছে সে একটি কুকুরকে আদর করছে। সে তখন একটি কথা বলে। যে ব্যক্তি কুকুর ভালোবাসে, সে ভালো মানুষ। তাই সে আর ওই ব্যক্তিকে খুন করতে পারে না।
হিউস্টনের এক শান্ত পাড়া। সেই পাড়ায় একটি বাড়িতে সেদিন ছিল খুশির দিন। দু’টি লেজযুক্ত পোষ্য উল্লাসে আত্মহারা। আজকের দিনটা ছিল বিশেষ, কারণ আজ দীর্ঘ নয় মাস পর কমান্ডার সুনীতা উইলিয়ামস মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসছেন। তাঁর স্বামী মাইকেল, একজন স্থির স্বভাবের মার্কিন মার্শাল, প্রতিদিন তাদের মন ভালো রাখতে চেষ্টা করতেন। প্রতি রাতে তিনি সুনীতার রেকর্ড করা কণ্ঠ বাজাতেন। গানার কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে শুনত, মাথা কাত করে যেন প্রতিটি শব্দ বুঝে নিচ্ছে। ‘তোমাদের মা এখন তারা ছুঁতে গেছে’, মাইকেল বলতেন, রোটরের মাথায় হাত বুলিয়ে। ‘কিন্তু তার মনটা তো এখানেই পড়ে আছে, তোমাদের সঙ্গে।’ অন্যদিকে, ২৫০ মাইল ওপরে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভেসে থাকা সুনীতা প্রায়ই তার কুকুরদের ছবি দেখতেন। মাঝে মাঝে ভিডিও কলে হেসে বলতেন, ‘গানারকে বলো যেন আর সোফার উপর অত্যাচার না করে!’ সেই মুহূর্তটা ভাইরাল হয়ে যায়। অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন এল। যখন সুনীতা গাড়ি থেকে নামলেন, মাটিতে পা রাখতেই একটি কাঁপুনি বয়ে গেল তার শরীর জুড়ে। ঠিক তখনই দরজা খুলে যেন একরাশ উল্লাস ছুটে এল। বসন্তের হাওয়া বয়ে আনল অদ্ভুত এক উত্তেজনা। মাইকেল খানিক দূরে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন, চোখে প্রশান্তির ছায়া। ‘বলেছিলাম না, ওরা তোমাকে ভোলেনি’, তিনি বললেন। সুনীতা হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন, চারদিকে পা, লেজ আর চুম্বনে মোড়া ভালোবাসার মাঝে। তিনি হাসলেন– এক হৃদয়জয়ী হাসি, যা পৃথিবীর সব সুখকে হার মানায়। ‘আমি মহাকাশে হেঁটেছি, কিন্তু এই দরজার ভিতর পা রাখার অনুভূতিটাই আসল অভিযান।’ সুনীতা কাঁপা গলায় বললেন। সুনীতা এবং মাইকেলের কোনও সন্তান নেই। তবে এই পোষ্যদের তাঁরা সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। এই যুগল সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য এদিক-ওদিক থেকে পাওয়া যায়, সেই থেকে জানা গিয়েছে এই যুগলের ভালোবাসার অন্যতম ভিত্তি হল কুকুর। যা তাঁদের ভালোবাসাকে আরও দৃঢ় করেছে। শোনা যায় এই যুগলও একে অন্যের প্রেমে পড়েছিল যে-যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে তার মধ্যে অন্যতম ছিল কুকুর। সুনীতার ডান হাতের উল্কিতেও রয়েছে তাদেরই পায়ের ছাপ।
ভারতে আধুনিক যুগলের মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, অনেকেই এখন সন্তান নেওয়ার পরিবর্তে পোষ্য, বিশেষ করে কুকুরকে নিজেদের জীবনের সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করছেন। এই ধারা বিশেষভাবে মিলেনিয়াল ও জেনারেশন জেড (জেন জি)-এর মধ্যে বেশি চোখে পড়ছে। সমীক্ষা বলছে এর প্রধান কারণ হল আর্থিক চাপ, স্বাধীন জীবনযাপন এবং কম দায়বদ্ধতার সঙ্গে ভালোবাসা ও সঙ্গের খোঁজ।
‘সুপারটেইলস’ নামের একটি পোষ্য যত্ন প্রদানকারী সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতে প্রথমবার পোষ্য গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৫০% ছিলেন জেন জেড এবং ৪৪% ছিলেন মিলেনিয়াল। এই তথ্য স্পষ্ট করে দেয় যে, নতুন প্রজন্মের মধ্যে সন্তান নেওয়ার চেয়ে পোষ্য গ্রহণের প্রবণতা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্স পেটকেয়ার এর একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ভারতে জেন জেড ও মিলেনিয়ালদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই প্রথমবার পোষ্য গ্রহণ করছেন। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, ৬৪% তরুণ কুকুর-মালিক এবং ৬০% তরুণ বিড়াল-মালিক জানিয়েছেন, তাঁদের পোষ্য মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। আরও একটি রিপোর্ট বলছে, ভারতের ৭০% যুব সম্প্রদায় সন্তান নেওয়ার পরিবর্তে পোষ্য পছন্দ করছেন। এই পরিবর্তন একটি সাংস্কৃতিক রূপান্তর নির্দেশ করে, যেখানে ঐতিহ্যগত ধারণাগুলি যেমন সন্তান নেওয়া, আধুনিক জীবনের চাহিদা ও মানসিক আরামের কাছে গৌণ হয়ে উঠছে। অনেক তরুণ ভারতীয় যুগলের মতে, পোষ্যরা একইসঙ্গে সঙ্গ, ভালোবাসা ও মানসিক সমর্থনের উৎস হয়ে উঠেছে; তাও আবার তুলনামূলকভাবে কম সময়, অর্থ ও দায়িত্বে।
বসন্ত ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে শহর থেকে। তুমিও পাড়ি দিয়েছ অন্য এক দেশে। যে দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কুকুরকে পোষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে মানুষ। শুধু তাই নয় সে দেশের মানুষরা সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পোষ্যকে নিজেদের ছেলেমেয়ের মতো মানুষ করে বড় করে। সমীক্ষা বলছে প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ আমেরিকায় পোষ্যকে নিজেদের সন্তানের মতো ভালোবাসে।
যে দেশ থেকে অনেক ভারতীয়রা রাম রাম বলে দেশে পাড়ি দিচ্ছেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তুমি ঠিক তখনই গিয়ে বাসা বাঁধলে সেই দেশে। আসলে বরাবরই তুমি অকুতোভয়। নয়তো আজ থেকে বহু বছর আগেই ঠিক করে ফেলেছিলে সন্তান নয়, উপরন্তু পোষ্যকেই নিজের সন্তান ভেবে মানুষ করবে। তুমি ওদের বোঝো, ওরাও বোঝে তোমাকে। তোমাকে বোঝার আগে, ওদেরকে বুঝতে হয়েছিল। ওটাই ছিল আমাদের বাঁক। তারপরেই জীবন বেঁকে গিয়েছিল অন্য এক গল্পে। যে গল্পে একটা পোষ্য হয়ে উঠছে বন্ধু, ছেলে, মেয়ে কিংবা প্রিয়জন।