বাংলাদেশে অনেক ডাক্তার বাংলা ভাষায় ব্যবস্থাপত্র লেখেন। এতে রোগীরা অনেকটা আত্মবিশ্বাস ও ভরসা লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই বাংলায় ৯০ শতাংশ ডাক্তার এটা মেনে চলেন না। অনেক ক্ষেত্রে রোগী ডাক্তারের কাছ থেকে সব ব্যাখ্যাও পান না। ফলে গোটা ব্যবস্থাতেই একটা অনিশ্চয়তার দোলাচল এসে যায়। এতে করে কিন্তু মুশকিল হয়, সেইসব ডাক্তারবাবুর যাঁরা যথাযথ প্রেসক্রিপশন করার চেষ্টা করে চলেছেন। এমনকী, সেই সব মুষ্টিমেয় ডাক্তারবাবু যাঁরা বাংলায় প্রেসক্রিপশন করেন তাঁদেরও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থা মূলত দু’টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত প্রথমটি অবশ্যই সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা। হাজার হাজার নিরুপায় মানুষ বাধ্য হয়েই সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার সুযোগ নিতে যান। অন্যটি বেসরকারি চিকিৎসার উদ্যোগ। মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা বেসরকারি চিকিৎসার সুবিধা পেয়ে থাকেন। আম-জনতা সরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকলেও অনেককেই নানা কারণে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট চিকিৎসার শরণাপন্ন হতে হয়। তাই মফস্সলেও অনেক রোগীই এখন হাসপাতালে না গিয়ে প্রাইভেট ডাক্তারদের চেম্বারে ভিড় জমায়।
পুরনো দিনের মতো আজকাল আর ডাক্তারদের নিজেদের চেম্বারে কম্পাউন্ডারদের দিয়ে ওষুধ বানিয়ে দিতে দেখা যায় না। ডাক্তারবাবুরা বাজারজাত ওষুধেরই প্রেসক্রিপশন করেন। সরকারি হাসপাতালেও ওষুধ বানিয়ে দেওয়া হয় না আর। সেখানেও ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লেখা হয় এবং হাসপাতালেই বিনা পয়সায় বা সুলভ মূল্যের দোকানগুলো থেকে তা সরবরাহ করা হয়। এই দুই ক্ষেত্রেই চিকিৎসা প্রদানের মূল হাতিয়ার হল প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র। ডাক্তারবাবুদের এই প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে চর্চার অন্ত নেই। মজা, হাসি, ঠাট্টা, গল্প-গাছারও অন্ত নেই।
ডাক্তারবাবুদের হাতে-লেখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে প্রচুর কথা হয়ে থাকে। এর দুর্বোধ্যতা নিয়েও অনেক চর্চা। ডাক্তারবাবুদের একাংশের হাতের লেখা কেউ বুঝতে পারে না এরকম কথা বহুদিন ধরে চলে আসছে। কেবলমাত্র কেমিস্টরাই নাকি সেগুলো উদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু কেন এমন হয়? সে কি শুধু প্রেসক্রিপশনের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য যেমন নাকি আগেকার দিনে করা হত। নাকি প্রচুর রোগী দেখার তাড়ায় সময়ের অভাবে এরকম হয়। সঠিক কারণটা অজানা। তবে রোগীদের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রেসক্রিপশন প্রচুর সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই ধরনের দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন তাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। তাঁরা কেমিস্টের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। এর ফল হিসেবে যেটা হয়, তা হল প্রেসক্রিপশন বুঝে চলতে চেষ্টা করার প্রতি অনীহা এবং ওষুধের দোকানদারদের ওপর নির্ভরতা। স্বাভাবিক কারণেই এতে চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। ডাক্তার ও রোগীর মধ্যেকার সমঝোতার যে বন্ধন তা শিথিল হয়ে আসে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ডাক্তারবাবুদের প্রেসক্রিপশন মূলত ইংরেজিতেই হয়। এবং প্রেসক্রিপশনগুলোতে নানা বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়ে থাকে। এগুলো দ্বারা সাধারণত ক’-বার ওষুধ খেতে হবে ও কখন খেতে হবে সেইসব তথ্য জানানো হয়ে থাকে। এগুলো ল্যাটিন শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ। সেসব চিহ্ন রোগীদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই ডাক্তারকেই পরিষ্কার করে বিশদে তা লেখা বা জানানো দরকার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ইদানীং অবশ্য কর্পোরেটে বা প্রাইভেটে অনেক ডাক্তারবাবু কম্পিউটারে প্রেসক্রিপশন করছেন। সেই প্রেসক্রিপশনে কিছু সমস্যার সমাধান হচ্ছে বটে। তাছাড়া ইদানীং কিছু ডাক্তারবাবু পরিষ্কার হাতের লেখায় প্রেসক্রিপশন করতেও চেষ্টা করছেন। সরকারি নির্দেশমতো ওষুধের নামগুলো স্পষ্ট করে বড় হাতের ইংরেজি অক্ষরে লিখতে চেষ্টা করছেন। এতে কিছুটা স্বচ্ছতা এসেছে প্রেসক্রিপশন লেখায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপাঠযোগ্য প্রেসক্রিপশন সঠিক চিকিৎসা লাভের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে।
ডাক্তারবাবুদের প্রেসক্রিপশন মূলত ইংরেজিতেই হয়। এবং প্রেসক্রিপশনগুলোতে নানা বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়ে থাকে। এগুলো দ্বারা সাধারণত ক’-বার ওষুধ খেতে হবে ও কখন খেতে হবে সেইসব তথ্য জানানো হয়ে থাকে। এগুলো ল্যাটিন শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ। সেসব চিহ্ন রোগীদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই ডাক্তারকেই পরিষ্কার করে বিশদে তা লেখা বা জানানো দরকার। তাছাড়াও গ্রামগঞ্জের ইংরেজি না-জানা মানুষের পক্ষে ইংরেজিতে লেখা প্রেসক্রিপশনের মর্মোদ্ধার করা সম্ভব নয়। সেই জন্য একটি নির্দেশ আছে যে প্রেসক্রিপশন যথাসম্ভব রোগীর মাতৃভাষায় করতে হবে। অর্থাৎ বাঙালির জন্য বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। আর ডাক্তারবাবু যদি রোগীর মাতৃভাষা লিখতে না জানেন, তবে ইংরেজিতে প্রেসক্রিপশন করতে পারেন। সেক্ষেত্রেও রোগীকে পরিষ্কারভাবে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশে অনেক ডাক্তার বাংলা ভাষায় ব্যবস্থাপত্র লেখেন। এতে রোগীরা অনেকটা আত্মবিশ্বাস ও ভরসা লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই বাংলায় ৯০ শতাংশ ডাক্তার এটা মেনে চলেন না। অনেক ক্ষেত্রে রোগী ডাক্তারের কাছ থেকে সব ব্যাখ্যাও পান না। ফলে গোটা ব্যবস্থাতেই একটা অনিশ্চয়তার দোলাচল এসে যায়। এতে করে কিন্তু মুশকিল হয়, সেইসব ডাক্তারবাবুর যাঁরা যথাযথ প্রেসক্রিপশন করার চেষ্টা করে চলেছেন। এমনকী, সেই সব মুষ্টিমেয় ডাক্তারবাবু যাঁরা বাংলায় প্রেস্ক্রিপশন করেন তাঁদেরও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কেন? না অবহেলা পেতে অভ্যস্ত রোগীরা এইসব ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশনও পড়ে দেখেন না ভালো করে। আর এই জন্য পুরো চিকিৎসাই একটা ধোঁয়াশায় পরিণত হয়। এই কমিউনিকেশন গ্যাপের জন্য কখনও কখনও চিকিৎসার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন অরুন্ধতী দাশ-এর লেখা: স্বপ্নের ভোলবদল: মেধাতালিকায় স্থান পেলেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, এই ধারণা বদলাচ্ছে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রোগীকে সঠিক তথ্যগুলো জানানোর দায় খানিকটা ডাক্তারের ওপর বর্তায় বইকি। অনেক ক্ষেত্রে দোকানদাররা যথাসাধ্য চেষ্টা করেন প্রেসক্রিপশন বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেক্ষেত্রেও অসুবিধের সৃষ্টি হতে পারে। ভুল তথ্য চলে যেতে পারে। দোকানদাররা অনেকসময় অনবধানতায় ভুল নির্দেশ দিয়ে দিতে পারেন। বুঝতে না পেরে এক ওষুধের বদলে অন্য ওষুধ দিয়ে দিতে পারেন।
এই সমস্যাগুলোর কথা মাথায় রেখে কলকাতার একটা মেডিকেল কলেজ অতি সম্প্রতি আউটডোর থেকে রোগীদের সঠিক ও নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ খাওয়ার ব্যবস্থা বাংলায় লিখে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ কোন ওষুধ কোন সময়ে ও দিনে কতবার খেতে হবে– সেই নির্দেশ। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ। বেসরকারি ক্ষেত্রেও ডাক্তারবাবুদেরও উচিত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলায় প্রেসক্রিপশন করা এবং বিশদভাবে ওষুধ খাওয়ার নির্দেশ দেওয়া। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ডাক্তারদের সহকারীদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। এতে করে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও সুচারু ও সুষ্ঠু হয়ে উঠবে এই আশা করা যায়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved