শীতের বাড়ি হিমালয়ে। সারা বছর সে থাকে ভোলানাথের সঙ্গে। নন্দীর মাথা তো খুব গরম। তাই শীতের দরকার হয় নন্দীর মাথা ঠান্ডা করার জন্য। ‘দুগ্গা ঠাকুর’-এর সঙ্গে শীত আসে মর্ত্যে। তারপর পুরো বাংলা জুড়ে শীত ছড়িয়ে পরে। শীতের বন্ধু সাগর। একবার কুস্তি খেলায় সাগরের কাছে শীত হার মেনেছিল। তাই বরুণ ঠাকুর দুজনের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দিয়ে বলেছিল প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিন শীতকে আসতেই হবে সাগরের বাড়িতে।
বঙ্গদেশ রঙ্গে ভরা। হোক না তা কোথাও শহর, আবার কোথাও গ্রাম দিয়ে গড়া। শহর কলকাতা আর এই বঙ্গদেশের গ্রামের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। শীতের কথাই ধরুন। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপে কল্যাণী স্টেশন পেরোলেই বোঝা যায়, ঠান্ডা কেমন জাঁকিয়ে পড়ে শহরতলির বাইরে। কলকাতাতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা নেই। কিন্তু কলকাতা শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে ছুটে গেলে ঠান্ডা জমিয়ে বসে থাকে। যেমন ভাবে বসে থাকে– বুড়ো দাদু চাদর মুড়ি দিয়ে। চাদর বলতেই মনে পড়ল, একটা ‘চাদর চুরি’-র গল্প। এটা আসলে ঠিক গল্প নয়। এটা আসলে একটা লোকবিশ্বাস। অনেকে আবার এটাকে বলে ‘চাদর চুরি ব্রত’। খেজুর গাছ যাদের বাড়িতে বা বাগানে আছে, গ্রামের সেই সব বাড়ির মানুষেরা এই ব্রতটি করত। মূলত মেয়েরায় এই ব্রততে অংশীদার হয়ে উঠত। এমন এক মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল নদীয়ার এক গ্রামে। গ্রামের নাম– আসাননগর।
তোমার নাম কি গো?
কাঁপা আর ভাঙা গলায় উত্তর ‘মাখনবালা’।
ভারী মিষ্টি নাম তো তোমার। তোমার বয়স কত হল ?
টোল-পরা চোয়াল ঢোকা গালে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে ওঠে– ‘এই হল গিয়ে চার কুড়ি’। ৪-এর সঙ্গে ২০ গুণ করলে হয় ৮০ বছর।
মাখনবালা বলতে শুরু করল এই ব্রত নিয়ে। মেয়েরা এই ব্রত পালন করত, তার একটা কারণ রয়েছে। ভালোভাবে শীত না পড়লে খেজুরগাছে ভালো রস হয় না। আর ভালো রস না হলে ভালো গুড় হবে কোথা থেকে! মাখনবালার স্বামী ছিল ‘শিউলে’। খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে, তা জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা ছিল তাঁর কাজ। কাজেই ভালো খেজুরের রস পেতে গেলে প্রয়োজন হয় বেশ হাড়-হিম করা ঠান্ডা। তা যেন বেশ কিছুদিন ধরে স্থায়ী হয়। বেশি ঠান্ডাকে দীর্ঘদিন রাখতেই পালন করা হত ‘চাদর চুরি ব্রত’। এখানে পরিবারের সব থেকে বড় মহিলা সদস্য যিনি, তাঁর চাদর তাঁকে না বলে চুরি করতে হত। যে-কোনও চাদর চুরি করলেই হবে না, সেই চাদরটাই চুরি করতে হবে, যা বাড়ির সব থেকে বয়স্ক সদস্য ব্যবহার করেন প্রতিদিন।
চুরির পর চাদরটি বাড়ির বড় মানুষটি না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেন। আর সেই সময় বাড়ির ছোটরা ছড়া কেটে বুঝিয়ে দিত চাদর চুরি হয়েছে। কী সেই ছড়া? মাখনবালা অনেক ক্ষণ চুপ থাকার পর মনে করে বললেন–
‘চাদর চাদর চাঁদের বুড়ি/চাদর গেছে শ্বউড়(শ্বশুর) বাড়ি। চারে চাদর চাঁদের কণা/ চাদর চুরি করতে মানা। এক চাদরে চাঁদনী/ দুই চাদরে পাদনী।/চাদর ছাড়া লাগে ঠান্ডা,/ চাদর যেন পায় না/ ঠান্ডা যেন যায় না।।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পিঠে নিয়ে কত ভালোলাগা। মেয়েবেলা থেকে মেয়েদের শেখানো হয় স্বামীর মন পেতে গেলে স্বামীর পেটে ভালো খাবার দিতে হয়। মন পাওয়ার রাস্তাটা শুরু হয় স্বামীর পেট থেকে। ছোটবেলায় বিয়ে হওয়া মেয়েটার শুধু চাওয়া-পাওয়া থেকে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির ভালোবাসা। পিঠে বানানোর সঙ্গে নিজের জীবনের সব চাওয়া পাওয়াগুলোকেই জুড়ে দিতে চায় সেই মেয়ে। সরা পিঠে বা আকসি পিঠে, ভাপা পিঠে, গোকুল পিঠে, রস চিতোই, মুগ সামালি, চুসি পিঠে, চন্দনকাষ্ঠ পিঠে, মন্ডামতী পিঠে এমন কতসব পিঠে, যা বানানো হত পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে। আর এই পিঠে খেতে লাগত নতুন খেজুর গুড়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই ছড়াটা শুনলেই বাড়ির বড় সদস্য বুঝতে পারতেন তাঁর চাদর চুরি হয়েছে। পরিবারের সেই সদস্যটি তখন খুব ধীরে-সুস্থে তাঁর চুরি যাওয়া চাদরের খোঁজ শুরু করতেন। চাদর খুঁজে পাওয়ার পর বাড়ির বড় সদস্যটি ছড়া কেটে উত্তর দিত–
‘চাদর চাদর নক্সী কাঁথা/ চাদর যাবে হেথা হোথা।/ চাদরের কি চার পা আছে?/ চাদর যাবে শীতের কাছে।/ চাঁদ বদনী চাদরটা/ চাদর লোকাবি তো শ্বউর(শ্বশুর) ঘরে যা।’
গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে শীত নিয়ে এক বিশ্বাসের খোঁজ পাওয়া যায়। ডায়মন্ড হারবারের ৬২-র নমিতা হালদার বলেছিলেন সেই বিশ্বাসের গল্পটা। শীতের বাড়ি হিমালয়ে। সারা বছর সে থাকে ভোলানাথের সঙ্গে। নন্দীর মাথা তো খুব গরম। তাই শীতের দরকার হয় নন্দীর মাথা ঠান্ডা করার জন্য। ‘দুগ্গা ঠাকুর’-এর সঙ্গে শীত আসে মর্ত্যে। তারপর পুরো বাংলা জুড়ে শীত ছড়িয়ে পরে। শীতের বন্ধু সাগর। একবার কুস্তি খেলায় সাগরের কাছে শীত হার মেনেছিল। তাই বরুণ ঠাকুর দু’জনের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দিয়ে বলেছিল প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিন শীতকে আসতেই হবে সাগরের বাড়িতে। তাই পৌষসংক্রান্তির ভোরবেলার আগে সব শীত গিয়ে হাজির হয় সাগর-মেলায়। সেখানে কাজ শেষ হলে শীত বাড়ি-বাড়ি পিঠে-পুলি খেয়ে বেশ কিছুদিন মর্ত্যে কাটায়। মর্ত্যে সরস্বতী ঠাকুর পুজো নিতে আসলে সরস্বতীর বাহন রাজহাঁসের পিঠে চেপে শীত আবার চলে যায় হিমালয়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাওয়া শহরটাকে, আবার খুঁজে পেতে খুব ইচ্ছে করে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শীত মানেই পিঠে-পুলি। ‘পৌষ পাব্বন’-এর দিন বাড়ির নিকোনো উঠোনে দেওয়া হয় বড় বড় সব পিটুলিগোলা আলপনা। তারপর শুরু হয় চাল কোটা। আর পিঠে তৈরির পালা। হামন-দিস্তা দিয়ে চাল কোটা হয়। আর তার সঙ্গে গাওয়া হয় চালকোটা গান। সেই গানে মেয়েদের জীবন আর মেয়েদের সুর মিশে থাকে। এমন এক চালকোটার গান শুনেছিলাম রায়গঞ্জের নিশারানির কাছে। ৮০ পেরোনো এই বৃদ্ধা ভাঙা গলায় শুরু করলেন গান–
‘চাউল কুটি শরীল কুটি/ স্বামী সোহাগী হয় যদি/ পিঠে পুলি ভইরবে ধামা/ স্বামীর মন পাব, শউর ঘরে ভালোবাসা পাবো রে…’
পিঠে নিয়ে কত ভালোলাগা। মেয়েবেলা থেকে মেয়েদের শেখানো হয় স্বামীর মন পেতে গেলে স্বামীর পেটে ভালো খাবার দিতে হয়। মন পাওয়ার রাস্তাটা শুরু হয় স্বামীর পেট থেকে। ছোটবেলায় বিয়ে হওয়া মেয়েটার শুধু চাওয়া-পাওয়া থেকে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির ভালোবাসা। পিঠে বানানোর সঙ্গে নিজের জীবনের সব চাওয়া পাওয়াগুলোকেই জুড়ে দিতে চায় সেই মেয়ে। সরা পিঠে বা আকসি পিঠে, ভাপা পিঠে, গোকুল পিঠে, রস চিতোই, মুগ সামালি, চুসি পিঠে, চন্দনকাষ্ঠ পিঠে, মন্ডামতী পিঠে এমন কতসব পিঠে, যা বানানো হত পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে। আর এই পিঠে খেতে লাগত নতুন খেজুর গুড়।
শীত-চাদর চুরি ব্রত-শিউলি-খেজুর গুড়-পৌষসংক্রান্তি-সরস্বতী পুজো– সব বিষয় একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকে। সবগুলোকে আমরা আলাদাভাবে দেখি ঠিকই, তবে কোনওটাই একে অন্যের থেকে আলাদা নয়। এত দূর লেখার পর মা ডেকে বলল, ‘আরে শুনছিস, সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ আনতে হবে তো। মাছ বাজারের সুরেনকাকাকে আগে থেকে বলে রাখিস। না হলে তো পেটে ডিমের ছাঁচওয়ালা ইলিশটা পাওয়া যাবে না। ছাইপাশ লেখা বন্ধ কর। আগের কাজটা আগে সেরে আয়।’