Robbar

ধর্ষণ আর যৌনকামনাকে এক আসনে বসানো এক ঘৃণ্য প্রবণতার অতিসরলীকরণ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 25, 2024 5:46 pm
  • Updated:August 25, 2024 5:51 pm  

ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতা বা কামনার কোনও সম্পর্ক নেই। কারণটা অত্যন্ত প্রাথমিক। যৌনকামনা ও যৌন কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পারস্পরিক সম্মতি এবং সম্মানের প্রশ্নটি। কিছু ক্ষেত্রে রোমান্স এবং ভালবাসাও। অন্যদিকে ধর্ষণ হল মানবাধিকারের এক চরম লঙ্ঘন। এই কারণেই ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই কদর্য প্রবৃত্তিকে স্বাভাবিক যৌনকামনার সমান্তরালে রাখার অর্থ তাকে একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে দেওয়া, অবচেতনে তাকে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধ বলে গণ্য করা।

রত্নাবলী রায়

সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ভিডিও ক্লিপ। এক মহিলা স্পষ্টভাষায় জানাচ্ছেন, যৌনতাড়না মেটাতে কোনও অনিচ্ছুক মেয়েকে ধর্ষণ না করে বরং সামান্য টাকা খরচ করে যৌনপল্লির মেয়েদের কাছে যেতে। ধর্ষণ বন্ধের নিদান হিসেবে তিনি এই কথাগুলো বলেছেন। তাঁর এই বার্তাকে স্বাগত এবং সাধুবাদ জানিয়েছেন নেট নাগরিকদের এক বড় অংশ। আর সকলের মতো আমিও ভিডিওটা দেখেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম মহিলা নিজে যৌনকর্মী। পরে জানলাম, তা নয়, তিনি যৌনপল্লির টিআই প্রজেক্টের কাউন্সেলিং-এ সাহায্য করেন। তৎসত্ত্বেও ভিডিও-তে মেয়েটির বক্তব্য শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে। প্রশ্নগুলো খুব স্বস্তির নয়। কেন?

ভাবতে গিয়ে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় আসছে, তা হল এক ঘৃণ্য প্রবণতার অতিসরলীকরণ। ওই মহিলা বুঝেই হোক বা না বুঝে, যে কথাটা বলেছেন, তাতে ধর্ষণ আর যৌনকামনাকে এক আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রবণতা মারাত্মক এবং বিভ্রান্তিকর। ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতা বা কামনার কোনও সম্পর্ক নেই। কারণটা অত্যন্ত প্রাথমিক। যৌনকামনা ও যৌন কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পারস্পরিক সম্মতি এবং সম্মানের প্রশ্নটি। কিছু ক্ষেত্রে রোমান্স এবং ভালবাসাও। অন্যদিকে ধর্ষণ হল মানবাধিকারের এক চরম লঙ্ঘন। এই কারণেই ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই কদর্য প্রবৃত্তিকে স্বাভাবিক যৌনকামনার সমান্তরালে রাখার অর্থ তাকে একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে দেওয়া, অবচেতনে তাকে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধ বলে গণ্য করা। যৌনকর্মীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হলে দ্বিতীয়টির সঙ্গে ভিকটিমের যে অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক আঘাত জড়িয়ে থাকে, তাও খানিকটা হালকা হয়ে যায়। একজন যৌনকর্মী অর্থের বিনিময়ে পরিষেবা দিলেও তিনি ‘রেপ ফ্যান্টাসি’ চরিতার্থ করার মাধ্যম হতে পারেন কি? তাঁরও না বলার অধিকার আছে, এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর ওপর জোর খাটালে সেটিও ধর্ষণ বলেই গণ্য হবে।

Anger and protests intensify over gruesome incident of miscreants vandalising RG Kar Medical College - The Hindu BusinessLine
আর জি কর ধর্ষণকাণ্ডে প্রতিবাদে শামিল জনসাধারণ

দ্বিতীয়ত, এই যে ভিডিওটির ভদ্রমহিলা পুরুষদের ধর্ষণের বদলে যৌনকর্মীদের পরিষেবা নেওয়ার পরামর্শ দিলেন, এখানেই একটা বিরাট ফাঁক তৈরি হল। ফাঁকটা অপরায়ন, ইংরেজিতে ‘আদারাইজেশন’-এর, আরও সহজ ভাষায় বললে ‘আমরা-ওরা’-র বিভেদ। যৌনকর্মীদের পেশাকে আর পাঁচটা পেশার মতো করে ভাবার
এবং যৌনকর্মীদের ও যৌন সুরক্ষা পাওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে। তাদের নিপীড়ন করার অধিকার কোনও নির্যাতকের নেই। যৌনকর্মীদের এই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তুলে ধরার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, সেই উদ্যোগটাই ধাক্কা খেল এই ভিডিওটির বক্তব্যের মাধ্যমে। যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন এমন কেউ যদি নিজেই এই মেয়েদের সমাজ থেকে আলাদা করে দেখান, তা হলে দীর্ঘকালের এক লড়াই ব্যর্থ হয়ে যায়, এবং ধর্ষণ বন্ধের কোনও কার্যকরী সূত্রও এখান থেকে পাওয়া যায় না, কারণ আগেই বলেছি, স্বাভাবিক যৌন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ধর্ষণের দূরদূরান্তেও কোনও যোগসূত্র নেই।

……………………………………………………….

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যেকোনও যুদ্ধে বিজয়ী শক্তিগুলো নিজেদের পরাক্রম প্রতিষ্ঠা করতে দখল করেছে পরাজিত বাহিনীর নারীদের। আবার ধর্ষণের মাধ্যমে মেয়েদের একটা শিক্ষা দেওয়ার, অপমান করার মনোভাবও রয়েছে। উন্নাও থেকে হাথরস হয়ে মণিপুরে যে সমস্ত ঘৃণ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটির পেছনে রয়েছে দমন করার বা সবক শেখানোর মানসিকতা। মেয়েদের বুঝিয়ে দেওয়ার মনোভাব যে তুমি পুরুষের সমকক্ষ নও।

……………………………………………………….

ধর্ষণ তা হলে কী? সহজ কথায়, ধর্ষণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে রয়েছে ক্ষমতা প্রদর্শনের কুৎসিত তাড়না। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আমরা জন্মাই, বড় হয়ে উঠি, সেখানে ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় পুরুষের আধিপত্য। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা অনুসারে পুরুষই শ্রেষ্ঠ, তার হাতেই যাবতীয় ক্ষমতার চাবিকাঠি। সেই পুরুষ যখন জোর করে কোনও অনিচ্ছুক মহিলার সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয়, সেখানে শারীরিক আনন্দের বদলে মুখ্য হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রকাশ, যা আসলে সন্ত্রাসেরই নামান্তর। মেয়েদের ভয় দেখানো, দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া, জোর করে দমিয়ে রাখা, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন, সব কিছুতেই ধর্ষণ হল একটা অস্ত্র।

Junior doctors hang a giant poster from the roof of the R G Kar College and Hospital during their protest against alleged rape and murder of a woman trainee doctor of the hospital, in Kolkata.
আর জি কর হাসপাতালে প্রতিবাদ

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যেকোনও যুদ্ধে বিজয়ী শক্তিগুলো নিজেদের পরাক্রম প্রতিষ্ঠা করতে দখল করেছে পরাজিত বাহিনীর নারীদের। আবার ধর্ষণের মাধ্যমে মেয়েদের একটা শিক্ষা দেওয়ার, অপমান করার মনোভাবও রয়েছে। উন্নাও থেকে হাথরস হয়ে মণিপুরে যে সমস্ত ঘৃণ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটির পেছনে রয়েছে দমন করার বা সবক শেখানোর মানসিকতা। মেয়েদের বুঝিয়ে দেওয়ার মনোভাব যে তুমি পুরুষের সমকক্ষ নও। মেয়েদের শরীর ঢাকা পোশাক পরার নিদান থেকে শুরু করে রাতে বাইরে না থাকা, একা ঘুরে না বেড়ানোর মতো যে সব পরামর্শ দেওয়া হয়, তার সবক’টির মূলেই রয়েছে সেই আদি অকৃত্রিম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, যা একটি মেয়েকে মানুষ হিসেবে না দেখে যৌনবস্তু বা ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখতে শেখায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, পুরুষদের আড্ডায় মেয়েদের সম্পর্কে যে সব শব্দ উচ্চারিত হয়, তাকে আর যাই হোক, মেয়েদের পক্ষে সম্মানজনক বলা যায় না।

ধর্ষণকে যদি মানবমনের অবদমিত বিদ্বেষ, ক্ষমতার আস্ফালন, যৌন বিকৃতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরি, তা হলে তার খুব কাছেই থাকবে ট্রোলিং। নানা সময়ে, পথেঘাটে বা সোশাল মিডিয়ায় সামান্য মতের অমিল হলেই যে ধরনের যৌন সন্ত্রাসমূলক মন্তব্য পুরুষদের ছুড়ে দিতে দেখি, তাতে মনে হয় ধর্ষণের এই সংস্কৃতি আসলে সমাজের অনেক গভীরে প্রোথিত। এমনকী, সাম্প্রতিক আর জি কর কাণ্ডের পর রাত দখলের আন্দোলনে গিয়েও পুরুষদের দ্বারা শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ শোনা গেছে অনেক মেয়ের মুখে। মনে হয়, এই ব্যক্তিরা উপযুক্ত সুযোগ পাচ্ছেন না বলেই হয়তো ধর্ষণটা করে উঠতে পারছেন না! আসলে লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং নারীকে অবমানব বা সম্পত্তি ভাবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সম্ভাব্য ধর্ষক হয়ে ওঠার রসদ। সেই সঙ্গে যোগ হবে পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, যথাযথ মূল্যবোধের অভাব, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা এবং অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া।

…………………………………………………..

আরও পড়ুন প্রহেলী ধর চৌধুরী-র লেখা: অন্তরের এই অসুরকে রুখবে কে, যদি অন্তরাত্মা না-জাগে প্রাণে?

…………………………………………………..

সোশাল মিডিয়ার প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় মনে হচ্ছে। সেটি হল ভুয়ো খবরের রমরমা। যে ভিডিওটির কারণে এই লেখার অবতারণা, সেই মহিলা যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে আমি শুরুতে তাঁকে যৌনকর্মীই ভেবেছিলাম। পরে জানলাম তিনি আদৌ তা নন। কিন্তু এই যে নানা ভুল ধারণা, অসংখ্য ভুয়ো খবর সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয়। এতে ধর্ষণ সংস্কৃতি বাধাপ্রাপ্ত হয় না মোটেই, কিন্তু মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তি বিঘ্নিত হয়, বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, এবং আখেরে নির্যাতিত মেয়েটিই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

আসলে ধর্ষণ একটা সামাজিক ব্যাধি। একদিকে মানসিকতার আমূল পরিবর্তন, অন্যদিকে কঠোর ও দ্রুততম শাস্তির বিধান না থাকলে এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। সেই পথে কতটা এগোতে পারবে সমাজ? সেই উত্তর দেবে সময়। আপাতত আশাটুকুই থাক।

……………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন

……………………………………………