মানুষ তো কল্পনাহীন নয়! কল্পনা খুলে নিলে, মানুষ আর বাকি জন্তুদের ফারাক কোথায়? এই যে আমি-আপনি প্রতিদিন ধাক্কা খাই দু’মুঠো অন্নের খোঁজে, আমরাও কি চাই না এক-একদিন একটু আড়মোড়া ভেঙে উঠতে? ইচ্ছে হয় না একটু চমকের খুশি দিতে, কাউকে? দিল্লির নজফগড়ের আদিত্যও তা-ই তো চেয়েছেন। চলন্ত গাড়ির বনেটে দাঁড়িয়ে দেখাতে চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রিয় সুপারহিরোর ক্যারদানি ও ক্যারিশমা। আগাপাশতলা সেজেছেন তিনি স্পাইডারম্যান, যদিও পায়ে হাওয়াই চপ্পল। ট্র্যাফিক আইন ভেঙেছেন বলে গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
‘মেঘের আড়ালে কেউ যুদ্ধ করছে না। বাজে কথা।
ইন্দ্রকে জিতছে না কেউ। বাজে, সব বাজে।
সবাই ঘাড় নিচু ক’রে খুঁটে খাচ্ছে এই কলকাতায়
সব রত্নাকর ঘুরছে স্ত্রী পুত্রকে খাওয়ানোর কাজে।’
কয়েক বছর আগে, এক মেঘালো সন্ধ্যায়, এলোমেলো হাঁটছিলাম রাজডাঙার ভেতর দিকের রাস্তায়। নিভু-নিভু ঘরবাড়ি। তারাবাতির আঁধার। খেলার মাঠ, শুয়ে আছে ভিজে। দু’-একটা চকিত কুকুর। কাটা পড়বে জেনেও দাঁড়িয়ে থাকা গাছ। একটা ঝুপ্পুস জায়গা ঘিরে কয়েকটা গাড়ির মৃতদেহ। এইসব পেরোতে পেরোতে, আচমকা দেখি, একটা অ্যাপার্টমেন্টের দু’তলায় ঠাটিয়ে বসে আছে স্পাইডারম্যান! যেন সে ঈশ্বর, যেন নির্নিমেষ দেখছে ঘাড়-নিচু আমাদের রোজকার ঘেশকুটে লড়াই!
পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, ওটা একটা প্লে-স্কুল; কচিকাঁচারা দিনমানে কিলবিল করে। স্পাইডারম্যান কি তাহলে শিশুদের বলে, চোখ তুলে তাকাও? ঘটনার মুখোমুখি হতে শেখায় সে?
গত বছর, এপ্রিলের ঠাঠা রোদে, বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে, কলকাতায় দু’-তিনদিন ছিলেন কেরলের সিনেমাকার ও কবি, সনল শশীধরন। বললেন, শহরটা ঘুরে দেখবেন, হেঁটে। গেলাম এসপ্ল্যানেডে। নিউ মার্কেটের রাস্তায় ঢুকেই, তিনি হাঁ! সামনেই, ভিড়সমগ্রের মাথায়, লাফিয়ে পড়তে উদ্যত স্পাইডারম্যান! জিজ্ঞেস করলেন, এটা কে বানিয়েছে? বলা বাহুল্য, সে উত্তর আমার অজানা। তবে সেদিন মনে হল, যিনিই বানিয়ে থাকুন, তিনি কি চেয়েছিলেন স্পাইডারম্যান হয়ে আমাদের সতর্ক করতে? বলতে চেয়েছিলেন, খেয়াল রেখো, সাবধানে থেকো, এই অগাধ অযুত অহরহ পণ্যপাঁচালি যেন ছোঁ মারতে না পারে তোমাদের?
হ্যাঁ, মানলাম, এসব খেলনা, বানানো, প্রাণহীন! কিন্তু, মানুষ তো কল্পনাহীন নয়! কল্পনা খুলে নিলে, মানুষ আর বাকি জন্তুদের ফারাক কোথায়? এই যে আমি-আপনি প্রতিদিন ধাক্কা খাই দু’মুঠো অন্নের খোঁজে, আমরাও কি চাই না এক-একদিন একটু আড়মোড়া ভেঙে উঠতে? ইচ্ছে হয় না একটু চমকের খুশি দিতে, কাউকে? দিল্লির নজফগড়ের আদিত্যও তা-ই তো চেয়েছেন। চলন্ত গাড়ির বনেটে দাঁড়িয়ে দেখাতে চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রিয় সুপারহিরোর ক্যারদানি ও ক্যারিশমা। আগাপাশতলা সেজেছেন তিনি স্পাইডারম্যান, যদিও পায়ে হাওয়াই চপ্পল। ট্র্যাফিক আইন ভেঙেছেন বলে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। যদিও, এ জাতীয় গ্রেপ্তারি তাঁর কাছে মনে হয়, তুচ্ছ ব্যাপার। মাস তিনেক আগেও পুলিশ ধরেছিল তাঁকে। স্পাইডারম্যান হয়ে তখন তিনি বাইক চালাচ্ছিলেন; পিছনে বসে ছিলেন সঙ্গী, অঞ্জলি।
এরকম ঘটনা নতুন? উঁহু। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখবেন, ঘরের কাছে, দুর্গাপুরের বাস-স্ট্যান্ডে, একটা বাস থেকে আরেকটা বাসের ছাদে লাফিয়ে যাচ্ছে স্পাইডারম্যান। আমেরিকার হোলিওকে, এক ভদ্রলোককে হাজতবাস করতে হয়েছে; কারণ, তাঁর পাঁচ বছরের সন্তানের স্কুল-ব্যাগে পাওয়া গেছে বাড়ির বড়দের নেশাদ্রব্য। খুদে-মন জানিয়েছে ক্লাস-টিচারকে, ও জিনিস মুখে পুরলে স্পাইডারম্যান হয়ে যায় সে।
কোনটা নেগেটিভ, কোনটা পজিটিভ– এসব তর্ক একটু সরিয়ে, আসুন, দেখি, কল্পনাকে উড়ান দিতে কী কী করতে পারে মানুষ? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সিনেমা বানাতে পারে। কোনও কিছু ছাড়া, জাস্ট কিচ্ছু ছাড়া, শুধুমাত্র কল্পনা আর জেদ সম্বল করে সে সিনেমা বানাতে পারে। মস্তবড় উদাহরণ, মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ের শেখ নাসির। যাঁর হাতে জন্মেছে– ‘মালেগাঁও কা সুপারম্যান’। এ সুপারম্যানের সিক্স-প্যাক অ্যাবস তো দূর, তাকে ‘রোগা’ বললে বেশি বলা হয়। ‘খ্যাংরা কাঠি’ একটা যুতসই বিশেষণ হতে পারে বটে। গলার আওয়াজে তার নেই কোনও ভারিক্কি চাল। পায়ে, রাবারের চটি। পরনে ঢলা বারমুডা, যার উচ্চকিত ফিতে সর্বদা বাইরে ঝুলছে। এ সুপারম্যান লাফ দিতেও ভীত। ভয়ংকর ভিলেনের সঙ্গে নদীবক্ষে অ্যাকশনের সময়ে, টায়ারের ভেলা আঁকড়ে কোনওক্রমে ভেসে থাকে সে।
গরিবি আর বেরোজগারিতে ন্যুব্জ ছিল মালেগাঁও। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, খুনখারাপি, বোম-ব্লাস্ট। মুক্তির একমাত্র উপায়, সস্তার ভিডিও হলে মশলাদার ফিলিম। হিন্দি হোক, বা ইংরেজি– ভাষাটা সেখানে কোনও বড় কথা নয়। আনন্দটা ছিল কয়েক ঘণ্টা ভেসে থাকা, কল্পনার দাঁড়ে। নায়ক-নায়িকার প্রেম, গান, সিটি-বাজানো সংলাপ, আর দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। একসময় নাসির ভাবলেন, এবার নিজেই বানাবেন সিনেমা। শুরু করলেন ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়ে। তৈরি হল ‘মালেগাঁও কা শোলে’। এত জনপ্রিয় হল সে সিনেমা, একটা আস্ত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই শুরু হয়ে গেল ওই ছোট্ট টাউনে। একের পর এক ব্লকবাস্টার সিনেমার স্পুফ বানাতে শুরু করলেন ওখানকার মানুষজন। ‘মালেগাঁও কা শোলে’-র পর ‘মালেগাঁও কি লগান’, ‘মালেগাঁও কা গজনি’, ‘মালেগাঁও কা ডন’, ‘মালেগাঁও কি শান’…
নাসির ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের কীর্তিকলাপের খবরে, সরেজমিনে ব্যাপারটা দেখতে গেলেন ফৈজা খান। দেখলেন কোনও স্টুডিও নেই, সেট নেই, স্টার নেই, স্টান্ট নেই, গ্যাজেটের আড়ম্বর, স্পেশাল এফেক্ট– কোনও কিচ্ছু নেই। আছে শুধু একদল মানুষের প্যাশন। পেট চালানোর কাজকর্মের শেষে, সময়ের ফাঁকফোকরে, নিজেদের অ্যাডজাস্ট করে বানিয়ে চলেছে সিনেমা। তাঁদের শুটিংয়ের কাণ্ডকারখানা ফৈজা বাঁধলেন ক্যামেরায়। তৈরি হল ডকুমেন্টারি, ‘সুপারমেন অফ মালেগাঁও’। যাঁরা মনে করেন ‘ডকুমেন্টারি’ জিনিসটা খুব বোরিং, ‘ধুস! ওসব কে দেখবে!’ টাইপ– তাঁদের করজোড়ে বলি, এটা না দেখে থাকলে, দেখুন। প্লিজ। আপনার ওই ধারণা বদলে যেতে বাধ্য।
…………………………………………………………………………………………………….
গরিবি আর বেরোজগারিতে ন্যুব্জ ছিল মালেগাঁও। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, খুনখারাপি, বোম-ব্লাস্ট। মুক্তির একমাত্র উপায়, সস্তার ভিডিও হলে মশলাদার ফিলিম। হিন্দি হোক, বা ইংরেজি– ভাষাটা সেখানে কোনও বড় কথা নয়। আনন্দটা ছিল কয়েক ঘণ্টা ভেসে থাকা, কল্পনার দাঁড়ে। নায়ক-নায়িকার প্রেম, গান, সিটি-বাজানো সংলাপ, আর দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। একসময় নাসির ভাবলেন, এবার নিজেই বানাবেন সিনেমা। শুরু করলেন ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়ে। তৈরি হল ‘মালেগাঁও কা শোলে’। এত জনপ্রিয় হল সে সিনেমা, একটা আস্ত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই শুরু হয়ে গেল ওই ছোট্ট টাউনে।
…………………………………………………………………………………………………….
আচ্ছা, শুধুই কি সুপারহিরো? শুধুই কি স্পাইডারম্যান আর সুপারম্যান? নাহ্, ওসব আসলে তো আমরাই। আমাদেরই রূপভেদে, মানুষ থেকে অতিমানুষ। ধরুন, কুর্দিস ফিল্ম, ‘বেকশ’। বাপ-মা হারানো দুই ভাই, অন্যায়-অবিচারের নালিশ জানাতে, দেখা করতে চায় সুপারম্যানের সঙ্গে। সুপারম্যান কোথায় থাকে? কেন, আমেরিকায়! তা হলে, দুই হতদরিদ্র বালক কীভাবে পৌঁছবে অত দূর? সমাধান, একটা নড়বড়ে গাধা। দুই ভাই গাধার পিঠে চড়ে যখন যাত্রা করে আমেরিকার দিকে, সারা গাঁ উজাড় হয়ে দেখতে আসে তাদের– ব্যস, অর্ধেক জয় তো ওখানেই! আর, পরিত্যক্ত রণক্ষেত্রে পুঁতে রাখা মাইনে বেখেয়ালে পা দিয়ে ফ্যালা দাদাকে বাঁচাতে, ভাই যখন তোলপাড় করে গোটা বাজার, অথচ কেউ পাত্তা দেয় না তাকে– হা-ক্লান্ত বালক হাল ছেড়ে হাঁপায় আর হঠাৎ দেখতে পায় ফিরে এসেছে দাদা, বেঁচে আছে সে কোনও অমোঘ জাদুতে– ভাইয়ের বিশ্বাসে দাদা-ই হয়ে ওঠে তার সবেধন ‘সুপারম্যান’।
তার মানে, এসব শুধুই সিনেমা? শুধুই পর্দাজাদুতে আলো ও ছায়ার কেরামতি? নাহ্, মোটেও তা নয়। আয়নায় তাকিয়ে দেখুন, আপনিও এক অতিমানব। ওই যে ক্ষয়াটে লোকটা, অজস্র খিস্তি-খেউড় সয়ে দৃঢ় ধরে রেখেছে ঠাসাঠাসি বাসের হাতল, কারণ আজও সময়মতো না পৌঁছতে পারলে টাকা কেটে নেবে বলেছে মালিক– সেও কি অতিমানব নয়? ওই যে শ্যামলা মহিলা, দশ টাকা বাঁচাবে বলে ট্রেনের টিকিট কাটে না, ঢাকুরিয়া নেমে হেঁটে যায় একডালিয়া, কারণ ঢাকুরিয়ায় চেকার থাকে না– ফ্ল্যাটবাড়িতে সারাদিন বাসন মেজে, সন্ধ্যায় ফেরার পথে দশ টাকার আলো-মাখা আইসক্রিম খায়, ওই দশটুকু মিনিট তার একান্ত আপন– সেও কি অতিমানব নয়? আর, প্ল্যাটফর্মের ওই যে নোংরা শিশুটা, যে জানেও না ‘অনাথ’ শব্দের মানে কেরোসিন না আচ্ছেদিন, ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করে একটা পাউরুটি পেলে, পোষা কুকুরবাচ্চাটাকে আধখানা দেয়– বুকে হাত রেখে বলুন, সেও কি এক টুকরো আলাদিন নয়?
…………………………………………………………………
আরও পড়ুন উদয়ন ঘোষচৌধুরির লেখা: প্রশ্নগুলো আর কাকে করব, আপনিই তো ‘তের নদীর পারে’ চলে গেছেন, বারীনবাবু!
…………………………………………………………………
জয় গোস্বামী দিয়ে শুরু করে, ওঁকে দিয়েই শেষ করি:
‘মেঘনাদ ও একাই নাকি? ওই ছেলেটা? তুমি নও? আমি নই? রোজ
রোজ কি অসমযুদ্ধে, রোজ কি খাবার খুঁজতে
আমাদের বধ করবে জন্মায়নি এমন লক্ষণ বেরোই না আমরা অগণন?
আমাদের বধ করবে?
আমাদের বধ করবে আমাদের বধ করবে জন্মায়নি এমন লক্ষণ!’
……………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………………