প্রতীক সমেত হোক আর প্রতীক ছাড়া– রাজনীতির গতিপথ সচল রাখতে জরুরি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট করানো। ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছাত্রনেতা থেকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে কাউন্সিলর থেকে বিধায়ক, সাংসদ। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি।
অবশেষে এ রাজ্যে ছাত্র নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ‘অবশেষে’ এবং ‘সম্ভাবনা’– এই দু’টি শব্দ বলতে হচ্ছে এই জন্যই যে, বিগত অনেক বছর ধরে মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভোটের নামগন্ধ নেই। এবং আগেও কয়েকবার ছাত্রভোট হবে-হবে করে আর এগোয়নি। এবার অবশ্য ছাত্রভোটের ঘোষণাই শুধু নয়, তার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি আরও কিছু পরিবর্তন হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। প্রতীকহীন নির্বাচন নয়, প্রতীক-সহ নির্বাচন করার বিষয়ে আইন পরিবর্তনের চিন্তাভাবনাও রাজ্য সরকার শুরু করতে চাইছে। সামনের বছরের মাঝামাঝি সময়ে লোকসভা ভোট হওয়ার কথা। তার জন্য রাজনৈতিক পারদ চড়তে শুরু করেছে। তারই মাঝে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, পুজোর পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে রাজ্যে ছাত্রভোটের সলতে পাকানোর পর্ব। যার শুরুতেই থাকছে আইন পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।
ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছাত্রনেতা থেকে মূল স্রোতের রাজনীতিতে কাউন্সিলর থেকে বিধায়ক, সাংসদ। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। আবার নকশাল ইতিহাসে শিক্ষার চৌহদ্দির টানাপোড়েনেরও সাক্ষী শহর থেকে গ্রাম। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র রাজনীতির মূলধারা রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে জড়িয়েই থেকেছে। অন্য যে কোনও ভোটের মতোই ছাত্রভোটও তাই অনেক ক্ষেত্রেই রক্তাক্তও হয়েছে। দখলদারির লড়াই হয়েছে। আর সেই আবহ যাতে ফের বিপর্যয় না ডেকে আনে, সন্ত্রাস না ছড়ায়, তার জন্য ছাত্রভোট কয়েক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে বলে বারবারই বলেছে শাসকদল। বিরোধীদের যুক্তি, কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যই ছাত্রভোটে সায় নেই রাজ্য সরকারের। এই চাপানউতোরের মাঝে মোদ্দা ফল হয়েছে ছাত্রভোট বন্ধ। ২০১৬ সালে শেষবার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভোট হয়েছিল। তারপর সব জায়গায় না হলেও ২০২০-তে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, রবীন্দ্রভারতীতে ভোট হয়েছে। যদিও বেশিরভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নেই।
রাজনীতির হাল-হকিকত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা লোকজন অবশ্য ছাত্র সংসদ না থাকা বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব না দেওয়ার একটা প্রভাবের কথাও বলছেন। সেটা জানতে গেলে আগে বুঝে নিতে হবে, ভোট না হওয়ায় নতুন করে পদ মেলার সুযোগ থাকছে না। বা সুযোগ থাকলেও তা ভোটের মাধ্যমে নয়। স্রেফ দলীয় নির্দেশে হয়ে যাচ্ছে। সেই জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতা-নেত্রী হওয়ার সুযোগ না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সময় না দিয়ে বরং স্থানীয় রাজনীতিতে সময় দেওয়া অনেক বেশি লাভজনক। ফলে গুরুত্ব কমেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের রাজনীতির। দলীয়ভাবে ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে, কলেজের দায়িত্ব সামলাবেন কোন কোন ছাত্রনেতা। কিন্তু ছাত্র সংসদ না থাকায় আর্থিক বা অন্যান্য বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাঁদের থাকছে না। অনেকে আবার দীর্ঘদিন ধরে রয়ে গিয়েছেন পদে। বয়স তো আর থেমে থাকেনি। সে বেড়েছে বটে, কিন্তু ছাত্র-রাজনীতির গণ্ডি পার হওয়া হয়নি!
কিন্তু এমনটা হওয়ার নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার সুস্পষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে যাতে বাহুবল বা ধনবল, মানে মানি ও মাস্ল পাওয়ার সব হয়ে না ওঠে, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০০৬ সালে লিংডো কমিটি গঠিত হয়। ছাত্রভোটে সংশোধন আনতে ওই বছরই ২২ সেপ্টেম্বরে কমিটি সুপ্রিম কোর্টকে তার সুপারিশও রিপোর্ট আকারে জমা দেয়। তা গ্রহণও করে সর্বোচ্চ আদালত। নির্দেশ দেয়, ২০০৭ সাল থেকে সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভোট কমিটির সুপারিশ মেনে করতে হবে। সংক্ষেপে বললে, প্রার্থী হলে ক্লাসে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ হাজিরা, ভোটের প্রচারে পাঁচ হাজার টাকার বেশি খরচ করতে না পারা, ভোটারদের ভয় না দেখানো, নির্বাচনের সময়ে পঠনপাঠন ব্যাহত না করা, একবার প্রার্থী হলে দ্বিতীয়বার আর প্রার্থী হতে না পারা, প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েট হলে ২২ বছর, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হলে ২৫ বছর এবং গবেষণারতদের জন্য ২৮ বছর হওয়ার মতো অনেক ভাল ভাল কথা বলা রয়েছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল, সেশন শুরুর ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচন সেরে ফেলা এবং কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে নির্বাচনে না লড়ার বিষয়টি। সেক্ষেত্রে প্রতীক-সহ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিধানসভায় প্রস্তাব আনা হবে বলেই এখনও পর্যন্ত খবর।
সিম্বল সমেত হোক আর সিম্বল ছাড়া– রাজনীতির গতিপথ সচল রাখতে জরুরি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট করানো। ছাত্র সংসদ না থাকায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিজনিত আন্দোলনের দিশা না মেলা যেমন বড় প্রশ্ন, তার থেকে বড় ফল এটাই যে, কয়েক প্রজন্মের আর ছাত্র নির্বাচনে দাঁড়ানো হল না। সংগঠন গড়ার পাঠও বোধহয় অধরাই রয়ে গেল। ছাত্রনেতা-নেত্রীরও দেখা মিলল না। কলেজ-রাজনীতি কেমনতর, তাও জানা হল না। মানে, রাজনীতির যে একটা ধারাবাহিকতা থাকে, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র থেকে যুব, সেখান থেকে মূল রাজনীতিতে প্রবেশ করার সিঁড়ির ধাপ পার হতে হল না। সেক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা নেতৃত্বের কী হবে, তা বোধহয় ভবিষ্যৎই বলবে।
বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্র যে বাঁকে দাঁড়িয়ে, তাতে ভবিষ্যতের সাক্ষী মালিক, মনিকা বাত্রা, লক্ষ্য সেনদের বিকল্প পথের কথা ভাবতে শুরু করতে হবে। কমনওয়েলথ গেমসকে ভুলে অলিম্পিক, এশিয়াডের প্রস্তুতি হিসেবে পাখির চোখ করতে হবে নিজ খেলার আঞ্চলিক, মহাদেশীয় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলোকে।