অর্ঘ্যের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটাকে মিউজিক থেরাপির সুফল বলা যায়। সুর আর গানের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। মিউজিক থেরাপি হল সংগীত ও সুরের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি ঘটানো। পছন্দের সুর শুনলে মন ভাল হয়ে যায়। ভালো গান অথবা মিউজিক মুহূর্তেই এনে দিতে পারে মানসিক স্বস্তি। আর অনেক চিকিৎসকই মনে করেন মানসিক স্বস্তি থাকলে শরীরের নানা ব্যথাবেদনাকে সহজেই ভুলে থাকা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় আজ একথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, শরীরকে আংশিক অবশ করে (Local Anesthesia) অপারেশনের করার সময় মিউজিক থেরাপি রোগীকে তার ব্যথা থেকে ভুলিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
‘আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে
তখন আপনি এসে দ্বার খুলে দাও ডাকো তারে।’
অর্ঘ্য দলুই, বয়স মাত্র আট। কিন্তু অসাধারণ মানসিক দৃঢ়তায় এক কঠিন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে দুর্বার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সে আজ খবরের শিরোনামে। সেই সঙ্গে কুড়িয়ে নিয়েছে সকলের অকুণ্ঠ বাহবা আর স্যালুট। ঈশ্বরের নিদারুণ খেয়ালে অর্ঘ্য জন্মেছে এক বিরল ধরনের ছানি নিয়ে যা তাকে একটু একটু করে অন্ধত্বের দিকে টেনে নিয়ে চলেছিল। ক্ষীণদৃষ্টির জন্য লেখাপড়া, খেলাধুলায় দিনদিন পিছিয়ে পড়ছিল, বন্ধুরাও তাকে ডেকে নিত না তাদের আনন্দ-কোলাহলে। সারাদিনই সে মনখারাপ করে বসে থাকত নিজেদের ভাঙা ঘরের দাওয়ায়। তারই মধ্যে অর্ঘ্য আঁকড়ে ধরেছিল রবিঠাকুরকে। তাঁর কবিতাই তাকে ভুলিয়ে রাখত দেখতে না পাওয়ার দুঃখটাকে।
নুন আনতে পান্তা ফুরোনো সংসার। দিনমজুর বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কোনওমতে দু’মুঠো অন্নের জোগাড় করেন। স্কুলের মাস্টারমশায়ের কথায় একদিন ছেলেকে নিয়ে গেলেন কাছের হেলথ সেন্টারে, যদি কোনও ওষুধ দিয়ে চোখটাকে ভালো করে দেওয়া যায়। কিন্তু ডাক্তারের কথায় মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল! অর্ঘ্যের দু’চোখেই ছানি পড়েছে। আর এতটাই বাড়াবাড়ি হয়েছে যে এক্ষুনি অপারেশন না করলে সে জন্মের মতো অন্ধ হয়ে যাবে! অপারেশন ! মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাবা। অর্ঘ্য চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবু চোখ অপারেশন করলে আবার সবকিছু দেখতে পারব’? ‘একদম পারবে। সবার মতো।’ অর্ঘ্যের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তার অন্ধকার পৃথিবীটা যেন আলোয় ঝলমল করে উঠল। সে ঠিক করে ফেলল অপারেশনের পরেই একমুঠো আকাশ আর রোদ্দুর ধরে এনে ভরিয়ে তুলবে তার অন্ধকার জগৎটাকে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমি কবিতা শুনতে শুনতে সব ব্যথা সহ্য করে নেব। এইটুকু বাচ্চার মনের জোর দেখে সবাই অবাক। তাই হয় নাকি? যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায়! ছানি অপারেশন করতে গিয়ে যদি চোখটা নষ্ট হয়ে যায় ! কিন্তু না। অর্ঘ্যের জেদের কাছে হার মানতে হল ডাক্তারদেরও। চোখের কোনায় ছোট্টো একটা ইনজেকশন দিয়ে শুরু হল অপারেশন। আর অর্ঘ্যের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে সিস্টার দিদিমণি একের পর এক আবৃত্তি করে চললেন তার প্রিয় রবীন্দ্রকবিতাগুলি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গ্রামের লোকেরা বললেন কলকাতার বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিন্তু অর্ঘ্য কোথাও যাবে না, সে তার ডাক্তারবাবুকে দিয়েই তার চোখ অপারেশন করাবে। অপারেশনের দিন ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু ছোট্ট অর্ঘ্যের চোখ কেমন করে অবশ করা হবে– সেটা ভেবেই ডাক্তারেরা পড়লেন মহা দুশ্চিন্তায়। আজকাল বিশেষ অবশকারী আইড্রপের সাহায্যে অত্যন্ত সহজে, একেবারে ব্যথাহীনভাবে চোখের অপারেশন করা হয়। কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়া ছাড়া সেটা একেবারেই সম্ভব নয়। অথচ সেই গ্রামীণ হাসপাতালে জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই। তাহলে? অপারেশন কি করা যাবেই না?
এই ঘোর সংকটে এগিয়ে এল অর্ঘ্য। বলল, ডাক্তারবাবু আপনি অপারেশন শুরু করুন। আমার কিচ্ছু হবে না। আমি কবিতা শুনতে শুনতে সব ব্যথা সহ্য করে নেব। এইটুকু বাচ্চার মনের জোর দেখে সবাই অবাক। তাই হয় নাকি? যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায়! ছানি অপারেশন করতে গিয়ে যদি চোখটা নষ্ট হয়ে যায় ! কিন্তু না। অর্ঘ্যের জেদের কাছে হার মানতে হল ডাক্তারদেরও। চোখের কোনায় ছোট্টো একটা ইনজেকশন দিয়ে শুরু হল অপারেশন। আর অর্ঘ্যের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে সিস্টার দিদিমণি একের পর এক আবৃত্তি করে চললেন তার প্রিয় রবীন্দ্রকবিতাগুলি। তিনি যখন বলছিলেন, ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/ তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,/ আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে/ রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে’– তখন অর্ঘ্যের মন যেন হাসপাতালের অপারেশনের থিয়েটার ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল কোন সুদূর, সেই জোড়াদীঘির মাঠে। আর এমনই করেই কবিতা শুনতে শুনতে অ্যানাস্থেসিয়ায় ছাড়াই ছোট্ট অর্ঘ্যের ছানি অপারেশন হয়ে গেল নিখুঁত দক্ষতায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: চালাক পৃথিবীকে হারিয়ে জিতে গেল যে বোকা ছেলেটা, সে বলছে…
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কী হতে পারে এই ঘটনার ব্যাখ্যা? এ কি শুধুই মনের জোর না অন্যকিছু? প্রশ্ন হল, মানুষ ব্যথা পায় কেন? গবেষকদের মতে, ব্যথা শুধুমাত্র শারীরিক ব্যাপার না, এ নিছক মস্তিষ্কের এক বিশেষ অনুভূতি। যখন শরীরের কোনও অংশে আঘাত লাগে তখন সেখান থেকে সংকেত-বার্তা নার্ভ টিস্যু বেয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। আর সেখানেই তৈরি হয় ব্যথার অনুভূতি। তখন কেউ চিৎকার করে, কেউ দাঁতে দাঁত চেপে, কেউ বা শরীরটাকে শক্ত করে রেখে ব্যথার মোকাবিলা করার চেষ্টা করে। আর ব্যথা-নিরোধক নানা ধরনের ওষুধ তো আছেই।
তবে অর্ঘ্যের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটাকে মিউজিক-থেরাপির সুফল বলা যায়। সুর আর গানের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। মিউজিক-থেরাপি হল সংগীত ও সুরের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি ঘটানো। পছন্দের সুর শুনলে মন ভালো হয়ে যায়। ভালো-গান অথবা মিউজিক মুহূর্তেই এনে দিতে পারে মানসিক স্বস্তি। আর অনেক চিকিৎসকই মনে করেন মানসিক স্বস্তি থাকলে শরীরের নানা ব্যথাবেদনাকে সহজেই ভুলে থাকা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় আজ একথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, শরীরকে আংশিক অবশ করে (Local Anesthesia) অপারেশনের করার সময় মিউজিক-থেরাপি রোগীকে তার ব্যথা থেকে ভুলিয়ে রাখতে সাহায্য করে। পছন্দের সুর, গান বা কবিতা মনের উপর প্রভাব যে বিস্তার করে, তার ফলে আমাদের শরীর বিশেষ ধরনের হরমোন উৎপাদন করে ব্যথার অনুভূতিকে হ্রাস করে।
তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্তও রয়েছে। প্রথমত কবিতা বা সংগীত হতে হবে রোগীর পছন্দের আর মনের মতো। অর্থাৎ যে গান ভালোবাসে তাকে কবিতা শোনালে তেমন কাজ হবে না। আর কবিতার লোককে গান বা উচ্চাঙ্গসংগীত শোনানো কেবলমাত্র সময়ের অপচয়। এছাড়া প্রয়োজন মনের একান্ত ইচ্ছা, একাগ্রতা আর পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি। অর্ঘ্য কবিতা ভালোবাসে। রবীন্দ্রনাথের কবিতাই তার অন্ধকারের দিনগুলিকে আলোয় ভরিয়ে রেখেছিল। সে জানত নতুন চোখ দিয়ে পৃথিবীকে আবার নতুন করে দেখতে পারবে। তাই অপারেশনের জন্য তার এই অধীর ব্যাকুলতা। এই বিশ্বাসেই কবিতা তাকে সাহস জুগিয়েছিল, ভুলিয়ে রেখেছিল শরীরের সব ব্যথা। এক কথায়, ‘ম্যাজিক অফ মিউজিক-থেরাপি’।