এখন সার্কাস বললে প্রথমেই শীতকালীন বিনোদনের কথা মনে পড়ে না; আমাদের মহান নেতা-ব্যক্তিরা দেশজুড়ে যে পরাবাস্তব কাজকর্ম করছেন, করে চলেছেন, তাঁদের সেসব আচরণের কথা মনে পড়ে— একে দুর্ভাগ্য বলব না কী বলব জানি না। এটুকু জানি, আমাদের ছোটবেলার শীতকালীন দূত এখন নেহাতই চ্যাংড়ামি, তারল্যের নামান্তর।
স্কুল থেকে ফেরার সময়ে, তেমাথার মোড় থেকে বাসটা বাঁ-দিকে বাঁক নিতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ত। রাস্তার ধারে প্রকাণ্ড লোহার গেট, তার দু’দিকে দু’টি পেল্লায় বাঘের ছবি আঁকা, তারা একে অপরের ওপরে লাফিয়ে পড়ছে। বড়রা বলতেন, ওই গেটের ওপারের বাড়িটায় সার্কাসের বাঘ-সিংহরা থাকে (নাকি থাকত? টেন্স মনে নেই)। সার্কাসে বন্য জন্তু-জানোয়ারের খেলা দেখানো নিষিদ্ধ হওয়ার পর ওই বাড়িটাতে নাকি সার্কাসের বাঘ-সিংহের ঠাঁই হয়েছিল। আমরা কখনও অবিশ্বাস করিনি। বস্তুত, অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠেনি। চলন্ত বাস থেকেই উঁকিঝুঁকি মেরে একঝলক দেখার চেষ্টা করেছি গেটের ওপারে– যদি কপালজোরে দেখা পাওয়া যায় কারও! রাস্তাঘাটের কোলাহল ছাপিয়ে যদি একবার শোনা যায় বাঘ-সিংহের গর্জন– এই বাসনা পূর্ণ হওয়াই তখন হাতে চাঁদ পাওয়া। তবে দুটোর কোনওটিই কোনও দিন হয়ে ওঠেনি।
মফসসলি শীতের অনেকগুলো চিহ্নক আছে। ড্যাম্পের গন্ধ মেখে আলমারি থেকে বেরনো মাফলার-সোয়েটার-উলের টুপি; বাজারে উজ্জ্বল কমলালেবুর মসৃণ শরীরে পিছলে যাওয়া কাঁচা-হলুদ রোদ; রাত্রে শোওয়ার সময়ে হাঁটু গুটিয়ে হাতের তালুতে ঠেকার উপক্রম হলে বালাপোশ রোদে দেওয়া; প্রতি নিশ্বাসে খানিকটা করে ধোঁয়া বেরিয়ে চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে আসা; সকালে অলৌকিক কুয়াশা ছিঁড়ে চলে যাওয়া লোকান্তরের সাইকেল-আরোহী; খেজুরগাছের গায়ে বেঁধে দেওয়া মাটির হাঁড়ি; বিকেল পাঁচটা নাগাদই আকাশে সাপের বিষের মতো রঙ লাগিয়ে সন্ধে নেমে আসা। এসবের পাশাপাশি মফসসলি শীতের অপরিহার্য এক দূত ছিল সার্কাস-পার্টি। তারা বুঝি তাদের ম্যাজিক-তাঁবুতে ভরেই বয়ে আনত শীতের যাবতীয় উপকরণ, এলাকার শেষপ্রান্তের মাঠে তারা ঘাঁটি গাড়লেই প্রকৃতি গাছের পাতা ঝরিয়ে সরকারিভাবে ঘোষণা করত: শীত এল। সারা অঞ্চলে পোস্টার পড়ত, ফ্লুরোসেন্ট হলুদ-সবুজ-গোলাপি রঙে ছাপানো সেসব পোস্টার। সার্কাস মানেই বিকেলের শো, বিস্তর নুন-মরিচ ছড়ানো হলদেটে ভুট্টা ভাজার প্যাকেট আর ঝলমলে আলোয় মানুষ এবং না-মানুষদের তাক-লাগিয়ে-দেওয়া খেলাধুলো। শৈশবের এবং বাল্যের শীতের যে ক’টি স্মৃতি আজও ঝকঝকে-তকতকে, তার মধ্যে অতি অবশ্যই আসে সার্কাস দেখার স্মৃতি। অজন্তা-অলিম্পিক-রাশিয়া– কতরকমের যে সার্কাস-পার্টি আসত, তার ইয়ত্তা নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সার্কাসের আলো-ঝলমলে পরিবেশটিতে চোখ সয়ে যেতে একদিন দৃষ্টি গেল হাতির পায়ের দিকে। পায়ে লোহার শেকলের দগদগে ঘা। ফুলে আছে। ওই অবস্থাতেই হাতিটি খেলা দেখাচ্ছে। বলা ভালো, দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। খেয়াল করতে শুরু করেছি, মাহুতের হাতের ছড়ির আস্ফালন। ধীরে ধীরে জানতে পারছি, জোকারদের জীবনটা আদপেই রঙচঙে, উজ্জ্বল নয়, বরং তার বিপরীত মেরুতেই তারা থাকে। পরিচয়হীন। শেকড়হীন। বিত্তহীন। অসহায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মফসসলি শীতের মতোই, সাবালক হওয়ারও কতগুলো চিহ্নক আছে, ভোটার কার্ড ইত্যাদি দিয়ে সাবালকত্বকে মাপা মূর্খামি। প্রথম নিষিদ্ধ-ভিডিও দেখা; ঘাড়ে প্রেম-দংশনচিহ্ন লুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা; ব্যক্তিগত ঘরটিতে গড়ে তোলা নিজের জগৎ– সাবালক হওয়ার প্রথম ধাপ, বোধ করি এগুলোই। সাবালকত্বের আরেকটি এরকম চিহ্ন হল, সমস্ত অপাপবিদ্ধ বিশ্বাস, প্রশ্নহীন আনুগত্যকে যুক্তি দিয়ে ফালাফালা করে ক্রমাগত উপসংহার খোঁজার অভ্যেস (নাকি বদভ্যেস বলব?)। খুড়তুতো দাদা এক শীতের দুপুরে আচমকাই বলে বসল, সান্তা ক্লজ বলে কিছু হয় না। আমরা ঘুমোনোর সময়ে বাড়ির লোক, প্রধানত মা-বাবাই, বালিশের নিচে রেখে দেয় কাঙ্ক্ষিত উপহার। ব্যস! লাল পোশাক পরা শ্মশ্রুগুম্ফধারী বুড়োর আইকনোগ্রাফি, সিঁড়ি দিয়ে চুপিসাড়ে উঠে এসে কেউ একজন বালিশের তলায় রেখে যাচ্ছে খেলনা– এই সমস্ত কল্পনা আমার মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে গেল। বড় হওয়ার পথে একধাপ এগোলাম।
ঠিক তেমনই, সার্কাসের আলো-ঝলমলে পরিবেশটিতে চোখ সয়ে যেতে একদিন দৃষ্টি গেল হাতির পায়ের দিকে। পায়ে লোহার শেকলের দগদগে ঘা। ফুলে আছে। ওই অবস্থাতেই হাতিটি খেলা দেখাচ্ছে। বলা ভালো, দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। খেয়াল করতে শুরু করেছি, মাহুতের হাতের ছড়ির আস্ফালন। ধীরে ধীরে জানতে পারছি, জোকারদের জীবনটা আদপেই রংচঙে, উজ্জ্বল নয়, বরং তার বিপরীত মেরুতেই তারা থাকে। পরিচয়হীন। শেকড়হীন। বিত্তহীন। অসহায়। ঘোড়ার নাছোড় দৌড়ে যে গতির অহংকার নেই, আছে অপারগতা— ততদিনে বুঝতে শিখছি। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন সার্কাসের তাঁবুতে আগুন লেগে গেল। পরেরদিন খবরের কাগজে হিসেব বেরিয়েছিল ক’টা পাখি মারা গেছে, ক’জন আহত এসবের। প্রশ্ন উঠছে, সার্কাস-পার্টির সচেতনতা নিয়ে। বাজার এলাকায় তাঁবু খাটিয়ে তারা কী করে এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করতে পারে, তা নিয়ে এলাকাবাসী সরব হচ্ছে। আমি আরও বুঝতে পারছি, যে আলোয় আমার বাল্যের দু’টি চোখ বুঁদ হয়ে থাকত, সেই আলোটুকুই সার্কাসের সব নয়, তার ওপাশে ঘনিয়ে আছে আমার অজানা এক অনিবার্য অন্ধকার। বড় হলাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: নকশিকাঁথার সুতোয় বিনুনি কেটে আবার বাঙালি কি আঁকবে এক সম্প্রীতির নকশিকাঁথা?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এখন সার্কাস বললে প্রথমেই শীতকালীন বিনোদনের কথা মনে পড়ে না; আমাদের মহান নেতা-ব্যক্তিরা দেশজুড়ে যে পরাবাস্তব কাজকর্ম করছেন, করে চলেছেন, তাঁদের সেসব আচরণের কথা মনে পড়ে– একে দুর্ভাগ্য বলব না কী বলব, জানি না। এটুকু জানি, আমাদের ছোটবেলার শীতকালীন দূত এখন নেহাতই চ্যাংড়ামি, তারল্যের নামান্তর। জীবনের বাজি রাখা ট্র্যাপিজ খেলা কোনও দিনই উঁচু-সংস্কৃতির আওতাভুক্ত হতে পারেনি, থেকেছে নেহাতই লম্ফঝম্পের নিষ্ফল নিদর্শন হয়ে। সার্কাসও এখন আর অ্যাথলেটিজম, দৈহিক-মানসিক শৈলীর উদাহরণ নয়; কতকগুলো বিশৃঙ্খল, অভদ্র আচরণ বোঝানোর পরিভাষায় পর্যবসিত হয়েছে। আমাদেরও এই জটিল মন আর সহজে বিস্মিত হয় না, কী এক অলীক গাম্ভীর্য ছুঁতে চেয়ে আমাদের অবাক হওয়া, তাজ্জব বনার মতো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনাগুলিকেই নানারকম শর্তে বেঁধে ফেলেছি। সার্কাস আর সেইসব শর্তের কোনওটিই পূরণ করতে পারে না। ফলস্বরূপ, সার্কাস ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে শীতের মানচিত্র থেকে। তাকে এবার তাঁবু গুটিয়ে নিতে হবে। গুটিকয়েক অঞ্চল বাদে রমরমিয়ে সার্কাস আর কোত্থাও চলে না।
অব্যাখ্যেয়র খুব কাছে যেতে নেই। ম্যাজিক ধরে ফেললেই আর ম্যাজিক থাকে না। প্রেয়সীকে কেন চাই, বুঝে ফেললেই কমে আসে প্রেম। তেমনই সার্কাসের আলো পেরিয়ে অন্ধকারে চোখ যেতেই আর টান থাকেনি। পাশাপাশি, চলে গেছে সেইসব পোস্টারের যুগ। হাতে-আঁকা পোস্টার বিলুপ্তপ্রায়, এখন এআইয়ের যুগ। নোনতা পপকর্নের প্যাকেটের বদলে লোকে এখন চিজ-মাখানো পপকর্নের টাব খোঁজে। এই পরিবর্তনের একটিও যে অপ্রয়োজনীয়, এমন নয়। কালের নিয়মে পুরাতনের চলে যাওয়াই দস্তুর। তবে, আমার মনে হয়, হারায় না কিছুই। ঠিক-ভুলের চৌকাঠের বাইরে থাকা যে মাঠ, সেই মাঠে আজও শীত ডেকে আনে সার্কাসের দল। অপার্থিব কুয়াশায় আবছা দেখা যায় তাদের তাঁবু। কাছে যাওয়া যায় না, ছোঁওয়া যায় না, দূর থেকে শুধু দেখা যায় তাদের রংচঙে নিশান। এইসব যুক্তি-বুদ্ধির দোলাচল পেরিয়ে, যখন পৌঁছব সেই মাঠে, তখন ফিরে পাব শৈশবের শীতকাল। যে শীত সার্কাসের তাঁবু ছাড়া কোনও দিন, কক্ষনও আসেনি।