সাফাইকর্মী মারা গেলে এককালীন থোক টাকা দিয়ে দেওয়া যথেষ্ট নয়। পরিবারের কাউকে চাকরি দেওয়াও যথেষ্ট নয়। দরকার সাফাইকর্মীদের পেশাজনিত রোগ নিয়ে গবেষণা, সমস্যার জায়গাগুলি খুঁজে বের করা এবং তার সমাধান করা। তবে এসবের জন্যে আধুনিক ও মানবিক মন লাগবে, টাকা লাগবে, প্রো অ্যাকটিভনেস লাগবে। তার থেকে অনেক সোজা পেশার নাম বদলে দেওয়া বা ‘ভালোবাসার আলিঙ্গন’-এর ধাপ্পা দেওয়া।
১৯০৭ সালের সকালবেলা ছাব্বিশ বছরের যুবক নফরচন্দ্র কুন্ডু চক্রবেড়িয়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। সেই সময় তিনি ম্যানহোলে আটকা পড়া দুই সাফাইকর্মীর আর্তনাদ শুনতে পান। নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে নফর ম্যানহোলে নামেন এবং দুই কর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনাটি নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর লেখা ‘নফর কুন্ডু’ নামের একটি কবিতা আছে, যার প্রথম তিনটি লাইন হল, ‘‘নফর নফর নয়,– এক মাত্র সেই তো মনিব/ নফরের দুনিয়ায়; দীন-হীন প্রতি জীবে শিব/ প্রত্যক্ষ করেছে সেই। নহিলে কি অস্পৃশ্য মেথরে…’
পদ্যটি থামিয়ে দিয়ে তাকানো যাক ‘অস্পৃশ্য মেথরে’-র দিকে। ওই দুই মেথরের নাম কী? কবিতায় সেকথা বলা নেই। নফর মারা গেলেও তাঁরা কি বেঁচেছিলেন? বলা নেই সে কথাও। এই ঔদাসীন্য কবির একার নয়। স্বয়ং রাষ্ট্র এঁদের ‘অস্পৃশ্য’ এবং ‘অদৃশ্য’ করে রেখেছে।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে খাটা পায়খানা ছিল। সারা সপ্তাহের গামলা ভরা গু সংগ্রহ করতে আসত জমাদার। মাথায় গুয়ের পাত্র নিয়ে হেঁটে গিয়ে সে ঢেলে দিত ‘মুন্সিপাল্টি’র গুয়ের গাড়িতে। ওসব ‘ন্যাস্টি’ জিনিস অনেক কাল উধাও হয়েছে। আমরা আর ‘পায়খানা’ যাই না। টয়লেটে যাই। আমাদের আর পায়খানা পায় না, ‘পটি’ পায়। জমাদার, ঝাড়ুদার, মেথর, ধাঙড়– এই নোংরা নামগুলির বদলে ‘সাফাইকর্মী’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে আমরা সভ্য হয়েছি।
সাফাইকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে দু’-কথা বলতে গেলে সবার আগে জানতে হবে সাফাইকর্মী কারা। সরকারি সাফাইকর্মী আর প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ঠিকাকর্মী ছাড়াও এর মধ্যে পড়ছেন সেইসব ব্যক্তি যাঁরা রাস্তাঘাট থেকে ময়লা কুড়িয়ে থাকেন। ইংরেজিতে র্যাগপিকার, বাংলায় ময়লাকুড়ুনি।
‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ ছবিতে সাফাইকর্মী মাকসুদ ভাইকে মুন্নাভাই ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ বা ভালোবাসার আলিঙ্গন উপহার দেন। কারণ মাকসুদ বারবার, খুব যত্ন নিয়ে হাসপাতালের মেঝে মুছছিলেন। ভালবাসার আলিঙ্গন ভালো জিনিস। কিন্তু সাফাইকর্মীদের যেটা লাগবে, তা হল স্বাস্থ্য পরিষেবা। ১৯০৭ সালের নামহীন দুই ম্যানহোল সাফাইকর্মী থেকে আজকের ময়লাকুড়ুনিরা ঐতিহাসিক ভাবে প্রান্তিক এবং নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। রাষ্ট্রের রাডারের বাইরে বাস করেন। বৈষম্য এবং অনিশ্চিয়তা তাঁদের পেশা এবং জীবনের অঙ্গ। এইসব মানুষদের ক্ষেত্রে ‘পেশাজনিত রোগ’ নিয়ে চিন্তা করার কেউ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
নেট ঘেঁটে দেখলাম, লখনউতে সাফাইকর্মীদের অসুস্থতা নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল। (https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2772501422000203)। তাতে দেখা যায় যে ১৯% সাফাইকর্মীর ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের সমস্যা, ৪০%-এর ক্ষেত্রে চোখের সমস্যা, ২২%-এর ক্ষেত্রে চর্মরোগ এবং ৬০.৫%-এর ক্ষেত্রে আঘাতজনিত সমস্যা রয়েছে। জ্বর, সর্দিকাশি, ডায়রিয়া, আমাশা, সড়ক দুর্ঘটনা, চোট লাগা বা পশুর কামড়ের মতো ঘটনাও আছে।
সাফাইকর্মীদের শারীরিক সমস্যা নিয়ে কয়েকদিন আগে একটি সমীক্ষা করেছে বিধাননগর পুরনিগম। কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে এবং পরীক্ষা করে জানা গেছে যে, চোখ জ্বালা, ফুসফুসের সংক্রমণ, ত্বকের সমস্যা খুবই সাধারণ ঘটনা।
কী জাতীয় রোগ হয় সাফাইকর্মীদের? প্রথমত, বর্জ্যের মধ্যে যেসব বিষাক্ত গ্যাস এবং রাসায়নিক থাকে, যেমন মিথেন গ্যাস, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড– সেগুলো শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। বেশি মাত্রায় থাকলে সাফাইকর্মীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিষাক্ত বাষ্প থেকে ফুসফুস, যকৃৎ এবং হৃদয়ের ক্ষতি হয়।
দ্বিতীয়ত, বর্জ্য হল ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক আর পরজীবীর আড়ত। যার ফলে হেপাটাইটিস, লেপ্টোস্পাইরোসিস, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি লেগেই থাকে। ধুলো থেকে আসে শ্বাসের সমস্যা। চামড়া আর নখে দাদ বা হাজার মতো সংক্রমণ হয়। আর রয়েছে ই-বর্জ্য, যাতে সিসা এবং পারদের মতো স্নায়ু-বিষ বা নিউরোটক্সিক এজেন্ট থাকে। এই বিষ গর্ভাবস্থায়, শৈশবে এবং কৈশোরে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে।
মাস্ক, গ্লাভস, ভারি জুতো, পানীয় জল, মশা তাড়ানোর উপাদান– এইসব সুরক্ষা-কবচ কাজের সময় সাফাইকর্মীদের সঙ্গে থাকা উচিত। তাঁদের নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা হওয়া উচিত। ম্যানহোলে মানুষ নামানোর বদলে মেশিনের ব্যবহার চালু হওয়া উচিত।
এসব নিয়ে সরকারকেই ভাবতে হবে। সাফাইকর্মী মারা গেলে এককালীন থোক টাকা দিয়ে দেওয়া যথেষ্ট নয়। পরিবারের কাউকে চাকরি দেওয়াও যথেষ্ট নয়। দরকার সাফাইকর্মীদের পেশাজনিত রোগ নিয়ে গবেষণা, সমস্যার জায়গাগুলি খুঁজে বের করা এবং তার সমাধান করা। তবে এসবের জন্যে আধুনিক ও মানবিক মন লাগবে, টাকা লাগবে, প্রো অ্যাকটিভনেস লাগবে। তার থেকে অনেক সোজা পেশার নাম বদলে দেওয়া বা ‘ভালোবাসার আলিঙ্গন’-এর ধাপ্পা দেওয়া।
শুরু করেছিলাম সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা দিয়ে। শেষ করি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ট্যাংকি সাফ’ গল্পের অংশ তুলে। মাথায় রাখবেন, লেখক এখানে শুধু বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক সাফ করার কথা বলছেন না। বৃহত্তর যে পরিবারকে সমাজ বলা হয়, তার কথাও বলছেন–
‘মাগন ট্যাংকে নামে। গার্দা সব পাথরের মতো বসে গেছে। থকথক করছে পোকা, জল। বহোত গার্দা। কোদালে ময়লা চাঁচতে চাঁচতে মাগন আপনমনে বলে, কাম পুরা করে পয়সা লিব মালিক। বহোত গার্দা বাবা, বহোত গান্ধা। সব গার্দা সাফ থোড়াই হোবে বাবা। গার্দা কুছ জরুর থেকে যাবে মালিক। সব গার্দা কখনো সাফা হয় না।’