বছর ছেচল্লিশের এক মাঝবয়সি, সম্পূর্ণ বেকার, থানায় এসে জানান তিনি তাঁর দাদাকে খুন করেছেন। সময়টা ২০২২-এর জুন মাস। তদন্ত করে দেখা যায়, ওঁর দাদার মৃতদেহ-র পাশে পড়ে রয়েছে বালিশ। কিন্তু সেই বালিশ যে মারণাস্ত্র, সে অঙ্ক মিলছে না মোটেই। কারণ ছটফট করে নিজেকে বাঁচানোর কোনও প্রচেষ্টা-চিহ্নই নেই।
প্যারি নগরের রাস্তায়, ঠেলাগাড়ি করে, হেঁকে বেড়াচ্ছেন এক ফেরিওয়ালা। এ-রাস্তা অবশ্য বড় রাস্তা নয়। গলিগলতা। বড় রাস্তায় ঠেলাগাড়ি নিষিদ্ধ। যেদিনের কথা বলছি, সেদিন কেমন করে যেন, তাঁর রাস্তায় বেরতে বড় দেরি হয়ে গেছে। সেই দেরি সেদিনকার মতো, তাঁর ব্যবসা গিলে নিয়েছে। বিক্রি হচ্ছে না তাঁর বাসন। প্রায় হতাশ, নিজেরই ওপর বিরক্ত সেই ফেরিওয়ালার কাছে এসে দাঁড়ান এক পুলিশ। সেই পুলিশ টাকা চান, অনৈতিক সেই চাওয়া।
হকার দিতে নারাজ। অন্যদিন হলে তাও চলত, কিন্তু আজ এই মন্দার বাজারে! পুলিশ একরোখা, ফেরিওয়ালার ঠেলাগাড়ি থেকে তুলে নেন বাসন। জমাটি এক হইহল্লা বাঁধে এ ঘটনায়। কিন্তু অফিস টাইম। কেউ দাঁড়ানোর পাত্র নয়। আর পুলিশের ঝামেলায় খামোকা কে পড়বে!
কিন্তু এক চিকিৎসক ছিলেন পাশেই দাঁড়িয়ে। তাঁর তাড়া নেই কোনও। প্যারি শহরে তখন গজিয়ে উঠেছে চিকিৎসক-ব্যারিস্টারদের মতো সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিদের সংগঠন। সংগঠনের কাজ মানবাধিকারের খেয়াল রাখা। তিনি, মানে এই চিকিৎসক ব্যাপারখানা আদ্যোপান্ত দেখছিলেন। এবং বুঝলেন, এই হল মওকা। এইবেলা পুলিশ বাবাজীবনের বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। ফেরিওয়ালাকেও বুঝিয়ে দিতে হবে, আমরা, এই নাগরিক সংগঠন তাঁর পাশে। তাঁর মতো হাজার হাজার অধিকারচ্যুত নাগরিকের পাশে।
চিকিৎসক পুলিশকে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
উর্দিধারী সেই পুলিশের বক্তব্য: এই ফেরিওয়ালা আমাকে বেজন্মার বাচ্চা বলে গালাগাল দিয়েছে!
চিকিৎসক সটান অস্বীকার করলেন, বললেন, মোটেই না। আমিই তো প্রত্যক্ষদর্শী।
পুলিশও রোয়াব দেখান। বলেন, তাহলে গালাগালটা নিশ্চয়ই আপনি দিয়েছেন। চলুন থানায়!
সাধারণত থানায় যেতে আমআদমি না চাইলেও, এই চিকিৎসক খুবই উত্তেজনা অনুভব করলেন। তিনি এটাই তো চাইছিলেন। ফলে ওই ফেরিওয়ালা, পুলিশ ও চিকিৎসক একজোট হয়ে চললেন থানায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
শ্রীঘর নাম হলেও, কে আসতে চায় এই গারদে? কিন্তু দুপুরবেলা খাবার এল। বিনামূল্যে পেটে পড়ল দানাপানি। ফেরিওয়ালা মুগ্ধ! তিনি জীবনে এই প্রথম, নিজে না উপার্জন করেই খাবার দিতে পারলেন পেটে। রাত নেমে এলে তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর বস্তির তুলনায় এই হাজতের দেওয়ালের আরাম অনেক বেশি। উপলব্ধি করলেন, ওঁকে পাহারা দিচ্ছেন যিনি, তিনি মাইনে পাচ্ছেন, তা তো তাঁর জন্যই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
থানায় কী ঘটল?
তা চিকিৎসকের জন্য খুব ভালো ব্যাপার না। দারোগামশাই চিকিৎসককে চিনতে পেরে এই গালাগালের মামলা থেকে তাঁকে প্রথমেই অব্যাহতি দিলেন। কিন্তু সেই ফেরিওয়ালাকে সন্দেহবশত আটক করলেন। পরের দিন কেস উঠবে কোর্টে। চিকিৎসকও নিজের মানবাধিকার সংগঠনের হয়ে কেস লড়বেন। তৈরি হয়ে আসবেন, ভেবেই নিয়েছেন। কিন্তু সেদিন দুপুরেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল।
যা ঘটল, তা ওই ফেরিওয়ালার মনে। অন্তঃস্তলে। কী ঘটল? প্রথমে তো বেজায় অস্বস্তি। শ্রীঘর নাম হলেও, কে আসতে চায় এই গারদে? কিন্তু দুপুরবেলা খাবার এল। বিনামূল্যে পেটে পড়ল দানাপানি। ফেরিওয়ালা মুগ্ধ! তিনি জীবনে এই প্রথম, নিজে না উপার্জন করেই খাবার দিতে পারলেন পেটে। রাত নেমে এলে তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর বস্তির তুলনায় এই হাজতের দেওয়ালের আরাম অনেক বেশি। উপলব্ধি করলেন, ওঁকে পাহারা দিচ্ছেন যিনি, তিনি মাইনে পাচ্ছেন, তা তো তাঁর জন্যই। তাঁকে পাহারা দিয়েই সেই পাহারাদারের সংসার চলছে।
তাহলে তো তিনি মোটেই কোনও হেলাফেলা করা কোনও গুরুত্বহীন মানুষ নয়।
পরের দিন যখন কোর্টে উপস্থিত করা হল, জজ সাহেব যখন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বেজন্মার বাচ্চা বলেছিলেন– তখন সেই ফেরিওয়ালা জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ’। চিকিৎসক প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগলেন, কিন্তু অভিযুক্তই যদি হ্যাঁ বলে বসেন, তখন কী-ই বা করার থাকে! জজসাহেবের সাফ বক্তব্য, ওই ফেরিওয়ালা হয়তো বেজন্মার বাচ্চা বলেননি, কিন্তু গালাগাল দিয়েছেন, অতএব শাস্তি তাঁর কাম্য। এবং ফেরিওয়ালার ভাগ্য খুলে গেল। জুটল এক হপ্তার কারাদণ্ড!
এক হপ্তা পর, সেই ফেরিওয়ালা বেরিয়ে এসে বেচে দিলেন তাঁর ঠেলাগাড়ি। সে টাকায় দেদার মদ্যপান করে উর্দিধারী এক পুলিশের কাছে গিয়ে এবার সত্যি সত্যিই বললেন, বেজন্মার বাচ্চা! কিন্তু সেই পুলিশ যেন শুনতেই পেলেন না। ফেরিওয়ালা আরও জোরে, পুলিশের কানের কাছে চেঁচিয়ে বললেন, বেজন্মার বাচ্চা!
সেই পুলিশ প্রায় নির্বিকারচিত্তে, ফেরিওয়ালার দিকে তাকিয়ে বললেন, একজন কর্তব্যরত পুলিশকে গালি দিতে লজ্জা করে না? ছি!
এই গল্প লিখেছিলেন আনাতোল ফ্রাঁস। সে বহুকাল আগে। বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্প নামের এক সংকলনে ঠাঁই পেয়েছিল তা। কিন্তু আজ এই অবেলায় কেন আবার এই গল্পের কথা মনে পড়ল? কারণ এই কলকাতা। কারণ এই কলকাতার পুলিশ।
কী ভাবলেন? ভাবলেন সেই ঘুষের গল্প? সেই টেবিলের তলা? বাঁ-হাত? আরেকটু অপেক্ষা করুন তবে।
বছর ছেচল্লিশের এক মাঝবয়সি, সম্পূর্ণ বেকার, থানায় এসে জানান তিনি তাঁর দাদাকে খুন করেছেন। তদন্ত করে দেখা যায়, ওঁর দাদার মৃতদেহ-র পাশে পড়ে রয়েছে বালিশ। কিন্তু সেই বালিশ যে মারণাস্ত্র, সে অঙ্ক মিলছে না মোটেই। কারণ ছটফট করে নিজেকে বাঁচানোর কোনও প্রচেষ্টা-চিহ্নই নেই। ময়নাতদন্তে দেখা যায়, সেই মৃত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে। ফলে, এ কোনও খুনের কেসই নয়!
তবে? তবে এরকম কেন? বাবার মৃত্যুর পর বাবা-মা’র পেনশনের টাকায় চলত সংসার। মা’র মৃত্যুর পর সংসার চালাত দাদাই। দাদার চোখের সমস্যায় চাকরি ছেড়ে দেয় আগেভাগেই। এবার সংসার চলত দাদার পেনশনে। কিন্তু দাদার মৃত্যুর পর? আর উপায় কী ছিল দিনযাপনের? নিজেকে অপরাধী প্রমাণ করে জেল খাটার চেষ্টা করা ছাড়া? সেই প্যারি নগরীর ফেরিওয়ালার মতোই। জেলের নিশ্চিন্ত খাবার, থাকার জায়গা, এই ছিল দু’জনের চাওয়ার মিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: রসিকতা, বিদ্রুপের আড়ালে ‘বডি শেমিং’ চলবেই?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কিন্তু এক্ষেত্রে গল্পটা শুধু ‘নিরপরাধ’ প্রমাণিত হওয়াতেই শেষ হয়ে যায় না। বাণিজ্যে স্নাতক এই ব্যক্তিটিকে থানাতেই অল্পস্বল্প কাজ জুগিয়ে দেন পুলিশরাই। ব্যক্তিটি কম্পিউটারে সড়গড় হওয়ায় থানার সুবিধেও হয়। গত দু’বছরে তাঁর জীবন বদলে গিয়েছে। এখন এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি করে সে। বেহালার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। প্রকট অন্নচিন্তা নেই।
এ-ও আরেকটা গল্পই আসলে। ফেরিওয়ালার গল্পের মতো হতে হতেও এই গল্প হলেও সত্যিখানা বেহালার ছোট ভাড়াবাড়িতে জায়গা করে নিল। পুলিশ মানেই যে তামিল অনুবাদ করা হিন্দি-বাংলা হিরো বা ভিলেন হবে, এমন নয়, এই বাংলায় নিজস্ব মৌলিক সহানুভূতিশীল পুলিশও আছেন বিবিধ প্রকার অভিযোগ, অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও। তাঁদের গল্পের গরু কিংবা গল্পের গাড়ি অকারণে মাধ্যাকর্ষণ লঙ্ঘন করে না। করে না বলেই, এই কলকাতাকে এখনও আত্মীয়বন্ধু মনে হয়।
হে পুলিশ, এই ব্যাপারটা একটু খেয়াল রাখবেন।
প্রচ্ছদের শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী