বেচারামগণ সাধ্যমতো পশরা সাজিয়েছেন। সপ্তাহখানেক আগে থেকে শুরু মাতৃদিবসের ঢক্কানিনাদ। প্রথমে বুঝতে হবে ‘টার্গেট’-এর মন, তাঁর ইচ্ছে ও চাহিদা। তিনি কি নতুন-মা? তবে হাজির করা যায় শিশুসামগ্রী, হারানো সৌষ্ঠব ফিরে পেতে মায়ের জন্য জিমের মেম্বারশিপ। তিনি কি ভাবী-মা? তাহলে তাঁকে দেওয়া যায় বাহারি ঢিলে পোষাক বা হেলথ ড্রিংক৷ তিনি কি কেজো-মা? তাঁর জন্য আছে ল্যাপটপ ইত্যাদি সপ্রতিভ গেজেট। তিনি কি গৃহকর্মী-মা? তবে খুশি হবেন নতুন ওয়াশিং মেশিন বা ফ্রিজে। তিনি কি মাতৃত্বের ভারে ন্যুব্জ, হারাচ্ছেন জৌলুস? তবে তাঁর জন্য সাজিয়ে দেওয়া যায় অবাধ্য বয়স আটকে রাখার উপাচার।
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
ইদানীং দিবস-পরিবৃত আমাদের শহুরে বেঁচে থাকা। দিবস নিত্যনতুন গজায় বা আমদানি হয়। পিতৃদিবস, মাতৃদিবস, কন্যাদিবস, পুত্রদিবস, প্রেমিক-প্রেমিকা দিবস– দিবসের শেষ নেই। এতে বাজারেরও মঙ্গল, গ্রাহকেরও।
ঘটনার ঘনঘটায় বাড়ে গ্রাহকের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ। বাজার বিশেষ বিশেষ দিন মনে করিয়ে তার থোড়বড়িখাড়া জীবনকে করে তোলে উৎসবমুখর। বাজারেও কেনাকাটি বাড়ে। একই পেস্ট্রির ওপর হৃদয়চিহ্ন এঁকে ভ্যালেন্টাইন দিনে তা বেচা যায় দ্বিগুণ দামে। তেমনই একই কেকের ওপর ‘মা’ নামক ছোট্ট কথাটি লিখে দিলে মাতৃদিবসে তার বিশেষ মূল্য ধার্য হয়।
মাতৃত্ব নিয়ে এদিকে পুরনো বখেড়া এমনিতেই ছিল। মাতৃত্ব যদি হয় বাৎসল্যের আরেক নাম, তাহলে মাতৃত্ব মানে, দুয়ারে ছেড়ে রাখা ছোট চটিজোড়া দেখে মন ভিজে যাওয়া। এই অনুভব তো লিঙ্গায়িত নয়। পুরুষের মনেও এ ফল্গু বইতে পারে। তবে কেন মাতৃত্বকে বেঁধে ফেলা একটি লিঙ্গে? নারীবাদ এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছে বহু বছর ধরে। তার মতে, গর্ভধারণ ও সন্তান ভূমিষ্ঠ করার বিষয়টি জৈবিক। স্তন্যদান বা স্তন্যপানও শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজন। কিন্তু তারপরে সন্তান প্রতিপালনের সম্পূর্ণ ভারটি নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে, তাকে তথাকথিত (ধনতান্ত্রিক মতে) ‘উৎপাদনশীল’ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘরবন্দি করতে, নিঃস্বার্থ মাতৃত্বের মিথ গড়ে তোলা হয়েছিল পিতৃতন্ত্রের মদতে।
কিন্তু সত্য জটিলতর এখন। দিন বদলেছে। শ্রমের বাজার এখন চাইছে আরও বেশি মেয়েদের অংশগ্রহণ। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে একুশ শতক পর্যন্ত মাতৃত্বের সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক তাই ক্রমশ বদলেছে। মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করার পাশাপাশি এসেছে নারীর অন্যান্য রূপেরও স্বীকৃতি। বাজার দেবতা এখন এমন মা চান, যিনি সর্বগুণসম্পন্না। তিনি রাঁধেন-বাড়েন, অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট সামলান, বাচ্চা মানুষ করেন, আবার চুল-ত্বক রাখেন বার্ধক্য-বিবর্জিত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করে ব্যক্তি-মাকে অবজ্ঞা করা পিতৃতন্ত্রের গোঁয়ার্তুমি। কিন্তু ধনতন্ত্র ওমন একবগ্গা নয়। সে মাতৃত্ব নিয়ে আদিখ্যেতা করে ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তি-মা তার কাছে ভোক্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বারবার মেসেজ বা অ্যালার্টের মাধ্যমে সে আশ্চর্য ‘ফোমো’ তৈরি করে। ‘ফোমো’ মানে ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’। হারিয়ে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা, দৃশ্যমান না পারা, তালে তাল না মেলাতে পারার ভয়। এই ভয় সৃষ্ট হয় মা ও সন্তান উভয়েরই মনে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অতএব মাতৃদিবসে বাজারে বড় শোরগোল। বেচারামগণ সাধ্যমতো পশরা সাজিয়েছেন। সপ্তাহখানেক আগে থেকে শুরু ঢক্কানিনাদ। প্রচারের নিয়ম হল, প্রথমে বুঝতে হবে ‘টার্গেট’-এর মন, তাঁর ইচ্ছে ও চাহিদা। তিনি কি নতুন-মা? তবে হাজির করা যায় শিশুসামগ্রী, হারানো সৌষ্ঠব ফিরে পেতে মায়ের জন্য জিমের মেম্বারশিপ। তিনি কি ভাবী-মা? তাহলে তাঁকে দেওয়া যায় বাহারি ঢিলে পোশাক বা হেলথ ড্রিংক। তিনি কি কেজো-মা? তাঁর জন্য আছে ল্যাপটপ ইত্যাদি সপ্রতিভ গেজেট। তিনি কি গৃহকর্মী-মা? তবে খুশি হবেন নতুন ওয়াশিং মেশিন বা ফ্রিজে। তিনি কি মাতৃত্বের ভারে ন্যুব্জ, হারাচ্ছেন জৌলুস? তবে তাঁর জন্য সাজিয়ে দেওয়া যায় অবাধ্য বয়স আটকে রাখার উপাচার।
মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করে ব্যক্তি-মাকে অবজ্ঞা করা পিতৃতন্ত্রের গোঁয়ার্তুমি। কিন্তু ধনতন্ত্র ওমন একবগ্গা নয়। সে মাতৃত্ব নিয়ে আদিখ্যেতা করে ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তি-মা তার কাছে ভোক্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বারবার মেসেজ বা অ্যালার্টের মাধ্যমে সে আশ্চর্য ‘ফোমো’ তৈরি করে। ‘ফোমো’ মানে ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’। হারিয়ে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা, দৃশ্যমান না পারা, তালে তাল না মেলাতে পারার ভয়। এই ভয় সৃষ্ট হয় মা ও সন্তান উভয়েরই মনে। মা ভাবে– আমায় ভুলে যাচ্ছে না তো সন্তান? সন্তানও ভাবে– ভুলে যাচ্ছি না তো? ভুলে যাচ্ছি নাকি যাচ্ছি না, সবই মাপা হয় বাজারের নিক্তিতে। খরিদ্দারির নিক্তিতে। সমাজমাধ্যমে মাকে নিয়ে আবেগ থরথর লেখা লিখতে, বা মাকে জড়িয়ে ছবি তুলতে দেখা যায় আমাদের।
যদি আধুনিক বিপণন কৌশলের অ-আ-ক-খ ঘাঁটা হয়, তবে দেখা যাবে, ‘ফোমো’ বা উক্ত ‘পিছিয়ে পড়ার ভয়’টিকে ‘ট্রিগার’ করার স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে। ‘ট্রিগার’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়। মানে, উসকে দেওয়া– চরমভাবে, দ্রুত লয়ে ও সহসা। এর জন্য বিজ্ঞাপনের ভাষাকে হতে হবে সংক্ষিপ্ত কিন্তু আক্রমণাত্মক। ‘কী করিতে হইবে’, সে নিয়ে থাকবে দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ। থাকবে সতর্কবার্তা: যেমন ‘অফার সীমিত’, ‘স্টক থাকা পর্যন্ত’ ইত্যাদি। সঙ্গে অ্যালার্মের চিহ্নওয়ালা ঘড়িতে কাউন্টডাউন চললে আরও ভালো।
ঠিক এভাবেই কি চারপাশের প্রতি প্রসাধনী সংস্থা, নারীবস্ত্র সংস্থা, গেজেটের দোকান, হোম অ্যাপ্লায়েন্স বা গয়নার পশরা মাদার্স ডে-কে বিজ্ঞাপিত করেনি? সময় নির্ধারণ করে কার্য বেঁধে দেওয়া, সঙ্গে মৃদু ধমকের ঢঙে স্মরণবার্তা, এ হল ‘ফোমো’ নির্মাণের সুচিন্তিত ধাপসকল। কিছু দিন আগে ওলা এনেছিল এক অদ্ভুত ‘নোটিফিকেশন’। অ্যান্ড্রয়েডের পর্দায় ভেসে উঠছিল: ‘মায়ের আটটি মিসড কল’ কথাটি। ঘাবড়ে, ঘেঁটে, অপরাধবোধে ভুগে ক্লিক করলে পড়া যাচ্ছিল যে, মা নয়, ওলা বলছে: মা হয়তো আট বার ফোন করলেও করতে পারতেন এই কারণে যে ওলায় ৪০% ছাড় চলছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: মহিলা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে না চাওয়া এক পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মাতৃত্ব তাহলে একদিকে মায়ের এক সর্বসংহা মূর্তি যেমন তৈরি করেছে, তেমনই সন্তানকে সদাসন্ত্রস্ত রাখছে: মায়ের পারিশ্রমিকহীন শ্রম ও স্বার্থত্যাগকে মর্যাদা দেওয়া যথেষ্ট হচ্ছে তো? বাজার বুঝেছে, অতিমানবী ইমেজ সৃষ্টি করে মাকে দিয়ে যেমন সামর্থ্যাতীত খাটিয়ে নেওয়া যায়, তেমন সন্তানের সুপ্ত অপরাধবোধ জিইয়ে রেখে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটি করানো যায়।
জোমাটোও তেমনই কিছু করতে চেয়েছিল মাতৃদিবস উপলক্ষে। জোমাটোর পেজ খুললেই নাকি অ্যাপ মনে করাচ্ছিল, মাকে ‘কল’ করতে হবে এখনই। হয়তো তাদের আশা ছিল, দূরে থাকা মাকে মনে করে মাতৃদিবসে ভালোমন্দ কিনে পাঠাবে সন্তান। কিন্তু এক্স হ্যান্ডেলে তরজা বেধেছে এক মেয়ে প্রতিবাদ করায়। সে মাতৃহারা। তার বক্তব্য, বিজ্ঞাপনটি তাকে বিষাদ ছাড়া আর কিচ্ছুটি দিচ্ছে না।
শুধু কি তাই? অন্য কারও ক্ষেত্রে মাকে ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টা যদি মন্দ-অভিজ্ঞতা জাত হয়? বস্তুত সব মা তো সন্তানের আশ্রয় হয়ে উঠতে পারেন না। হয়তো পারেন না, কারণ তাঁর সামনেও সঠিক রোলমডেল নেই। হয়তো মাতৃত্বে নিজেকে বেঁধে ফেলে, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে, তারপর তিনি তাঁর মূল্য দাবি করে বসেন সন্তানের প্রশ্নহীন আনুগত্য চেয়ে। সে মাকে ভুলে যাওয়া কি ক্ষমাহীন পাপ? না কি মাতৃত্ব এমনই এক পূতপবিত্র ধারণা, যা নিয়ে প্রশ্ন করা মানা?
আর যারা মাকে মনের সিংহাসনে স্থাপনও করেছে, তারা কীভাবে মনে রাখে মাকে? মা, যিনি মুখ ফুটে কখনও কষ্ট-খিদের-জ্বরজারির কথা বলেননি। মা, যার হাতের রান্না অমৃতসমান। মা, যিনি হাতে-বোনা শেষ সোয়াটারের কারিগর। পরিষেবাহীন মাকে ক’জন মনে রাখে? মাদার্স ডে’র উপহার তবে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি, না পরিষেবা নিশ্চিত করার উৎকোচ?