বাঙালি একুশের রিহার্সালে যখন সবে গ্লিসারিন লাগাচ্ছে চোখে, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার মুখস্থ করে নিচ্ছে আরেকবার, ভাষা শহিদদের ইতিহাস গুগল করে নিচ্ছে বক্তৃতায় ঝেড়ে কাশবে বলে, এই থরোথরো বাজারে, অনুরাগ কাশ্যপ গড়পড়তা বাংলা সিনেমাকে ‘ঘাটিয়া’ বলে দেগে দিলেন। বাঙালি যতটা রাগ বা অনুরাগ করল, তার চেয়ে ‘ঘাটিয়া’কে হয়তো ঢের বেশি আত্মীয় করে নিল। বাংলা বাজার একটু ঘাঁটিয়ে দেখিলেই সত্য প্রকাশ পাবে।
বাঙালি তিন প্রকার। দার্শনিক, রসিক এবং সপ্রতিভ।
যেকোনও সত্যিকারের সভ্য মানুষের মতোই গুটিকয়েক মননশীল, গভীর, দার্শনিক বাঙালির ক্রমাগত লড়াই চলে নিজের সঙ্গে। নিজ চিন্তাভাবনা, নিজ বিশ্বাসের সঙ্গে। যেমন একদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার যেকোনও দামি রেস্তরাঁয় গিয়ে ইংরেজিতে আলুভাজা চাইবে, দু’জন বাঙালি বাংলা ভাষার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকা বাহারি পানশালায় নিজেদের মধ্যে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলবে, অন্যদিকে আবার বিহারি ট্যাক্সিওয়ালা বাংলা না বুঝতে পারলে রাগে গর্জে উঠে ফেটে পড়বে! একদিকে রোমান অক্ষরে বাংলা না-লিখে দিলে সেটা পড়তে পারবে না, অন্যদিকে আবার কেউ ‘bol6chi’ লিখলে তাকে ছোট করে বলবে ওটা ‘Bowlchee’ হবে। একদিকে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন, ইংরেজি ভাষার প্রভাব, ইত্যাদি নিয়ে পাতার পর পাতা রচনা নামাবে, অন্যদিকে বাংলার যেকোনও উপভাষাই ওর কাছে রাঢ়ী সমতুল। হ্যাশট্যাগ সব জেলাতেই ‘হবেক লাই’। একদিকে পাঞ্জাবি শোভিত হয়ে মাচায় উঠে গমগমে গলায়, গোটা গোটা অক্ষরে বাংলা ভাষার জয়জয়কার করবে, অন্যদিকে ওর ঝাঁ-চকচকে পরিসরে কেউ ককরোচকে তেলাপোকা বলে ডাকলে তাকে হ্যাটা দেবে। ‘আজকাল আর কেউ বাংলা বই পড়ে না…’ মর্মে কেঁদে কঁকিয়ে একসা করে দেবে, কিন্তু বাংলা ভাষায় অলৌকিক তন্ত্রমন্ত্র, বা ঐতিহাসিক থ্রিলার, বা ঐতিহাসিক তন্ত্রমন্ত্র, বা অলৌকিক থ্রিলার বিক্রি হলেও মরমে মরে যাবে। কারণ ও মেনে নিতে পারে না যে, মানুষ বই মূলত মনোরঞ্জনের জন্যই পড়ে। এলিয়েনেশন বুঝে বক্তিমে করার জন্য নয়। মেনে নিতে পারে না যে, বাঙালি রসিক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সিনে-মায়ের ডায়গল নিয়ে বিশেষ লেখা: মাতৃভাষা, মানে মায়ের বুলি, মানে মায়ের ডায়লগ
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এদিকে রসিক বাঙালি বহুকাল আগেই বুঝতে পেরেছে যে, মাতৃভাষাটা ভুল বলতে পারার মতো উৎকট আমোদ আর কোনও কিছুতে নেই। তাই যেভাবে খাঁচা ও কাঁকরিদানার মায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চায় মধ্যবিত্ত বদ্রীপাখি, ঠিক সেভাবেই ‘মাতৃভাষার বেড়াজাল’ থেকে বারে বারে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে বাঙালি। পেরেওছে। বাঘের মতো। একটা সময় বিবিধ বাঙালি বাপ-মা তাঁদের সন্তানাদির ব্যাপারে গর্বিত হাসিমুখে হালুম করেছেন, “আর বলিস না, এই তো সেই দিন ইশকুলে গিয়ে আটচল্লিশের পর ন’চল্লিশ বলে এসেছে!” তারপর কালে কালে সময় ও বিজ্ঞাপনের ষড়যন্ত্রে সামাজিক অবস্থানের মান হয়তো বদলে গেছে, হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া এসেছে, কিন্তু বাঙালি বদলায়নি। কারণ বাঘ কখনও শিকার করতে ভোলে না। হ্যাঁ, আস্ফালনের দায়ে পড়ে বাধ্য হয়েছে আক্ষেপের আশ্রয় নিতে, কিন্তু ঠাঁট সেই একইরকম বজায় রয়েছে, ‘কাশ আমার ছেলেটা একটু বাংলা পড়ত…’ কথ্য ভাষার ক্ষেত্রে এই মাপের প্রগতিশীল বহুগামিতা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সত্যিই বিরল। অবশ্যি এক্ষেত্রে বাঙালি সাহায্যও কিছু কম পায়নি। এই যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে বিখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ ‘ঘাটিয়া’ শব্দটি উপহার দিয়ে গেলেন, তা কি আর বাঙালি ফেলে দেবে? না। দেবে না। আমার বিশ্বাস, ‘এখানকার বিরিয়ানিটা খেতে অসাম হলেও রায়তাটা কিন্তু ঘাটিয়া!’ জাতীয় অলংকার বাংলাভাষা পেতে চলেছে শীঘ্রই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রসিক বাঙালি বহুকাল আগেই বুঝতে পেরেছে যে, মাতৃভাষাটা ভুল বলতে পারার মতো উৎকট আমোদ আর কোনও কিছুতে নেই। তাই যেভাবে খাঁচা ও কাঁকরিদানার মায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চায় মধ্যবিত্ত বদ্রীপাখি, ঠিক সেভাবেই ‘মাতৃভাষার বেড়াজাল’ থেকে বারে বারে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে বাঙালি। পেরেওছে। বাঘের মতো। একটা সময় বিবিধ বাঙালি বাপ-মা তাঁদের সন্তানাদির ব্যাপারে গর্বিত হাসিমুখে হালুম করেছেন, “আর বলিস না, এই তো সেই দিন ইশকুলে গিয়ে আটচল্লিশের পর ন’চল্লিশ বলে এসেছে!”
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এইবার দার্শনিক যে এ-হেন অপূর্ব বিষয়কে অবক্ষয় বলবেন, ‘গেল গেল’ রব তুলবেন, কাতর কণ্ঠে প্রতিবাদ করবেন, এ আর নতুন কী! তার নেপথ্যে অবিশ্যি একটা কারণও আছে। আসলে ওরা বুঝতে পেরেছে না সেইদিন আসন্ন, যেখানে প্রশ্নপত্রে ‘বাংলা কথ্যভাষায় ভ্লগ ও রিল নির্মাতাদের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে যা জানো লেখো’ জাতীয় প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী। অমনি ব্যস! হিংসায় পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে! আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখুন ‘তারপর আমি জামাটা পরলাম’– এর বদলে যদি কেউ, ‘তারপর আমি ড্রেসটা ওয়্যার করে নিলাম’ বলে তাহলে কোন অভিধানটা অশুদ্ধ হয়ে যাবে শুনি? আর অভিধান অশুদ্ধ হলেই বা কী? অভিধান কে কিনছে বলুন তো, কিনলেও দেখছেই বা কে!
‘সপ্রতিভ’ অর্থাৎ স্মার্ট বাঙালি। স্মার্টফোনের মতোই এদের অরিজিনও বেশ নতুন। এইবার, যে বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দরী পাঠিকার মুখ কল্পনা করে আমি এসব লিখি– তিনি নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন যে, স্মার্ট বাঙালির কথা লিখতে গিয়ে এই লেখাটাও কেমন স্মার্ট হয়ে গেল। হতেই হত। স্মার্ট বাঙালি নিজের ঘ্যামে থাকে। দার্শনিকদের ‘মনখারাপমারানিয়া’ ডেকে, নিজেরা ফাটিয়ে ‘চিল’ করে। এদের রেলাটা রিলেও ধরা যায় না, কারণ স্মার্ট বাঙালি কাউকে পাত্তা দেয় না। বাংলা ভাষাতেই বাংলা-সংক্রান্ত সমস্ত কিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে এদের জুড়ি মেলা ভার। এদের টেনশন খালি একটাই, ছুটির দিন ভাইদের সঙ্গে প্ল্যান করে রাখা সিনটা ওয়ার্ক করবে কি করবে না। যদি না করে তাহলে প্ল্যান-বি কী হবে, আর হাই হওয়ার জন্য স্টাফ যথেষ্ট মজুত আছে কি না। পিরিয়ড।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কত কম বলতে হবে, মুখের কথায়, সভায়, কবিতায় কিংবা ক্রোধে– সে এক সম্পাদনারই ভাষ্য
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে বাঙালির আরেকটা শ্রেণিও আছে, যারা এতটাই অদরকারি আর বাড়তি যে, তাদের আলাদা করে শ্রেণিবিভাগ করা হয়নি। বোকা বাঙালি। এরা প্রত্যেকে এখনও তাদের মাতৃভাষায় এমন নানা ধরনের কাজ করে চলেছে, যা অন্য ভাষায় করলে ব্যক্তিগতভাবে তাদের ঢের লাভ হত সবরকমভাবে। তবু তারা বেছে নিয়েছে বাংলা ভাষাকেই। কেউ একের পর এক থিয়েটার করে চলেছে, কেউ স্ট্যান্ড আপ কমেডি করছে, কেউ বাংলা সাহিত্যের নানা মণিমুক্তোকে অডিওস্টোরির মাধ্যমে সেই সমস্ত মানুষের কাছে নিয়ে আসছে, যাদের বই পড়ার অভ্যাস কোনওকালেই ছিল না। বাংলা ভাষায় রক গান গাইছে কেউ। কারও আবার বাংলা বই অনুবাদ হচ্ছে ইংরেজিতে। কিন্তু এতে খুশি হওয়ার তেমন কিছু নেই। কারণ দার্শনিক বাঙালি এদের পাত্তা দেয় না। রসিক বাঙালির এসবে কিছু যায় আসে না। আর স্মার্ট বাঙালি এই সমস্ত কিছুকে এতটাই সাবস্ট্যান্ডার্ড মনে করে যে, এই নিয়ে কথা বলতেও তাদের স্ট্যার্ডাডে বাঁধে। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর পরেও স্মার্ট বাঙালির কাছে আমি কৃতজ্ঞ একটা অন্য কারণে। তিন ভাগের এক ভাগের মধ্যেও পড়তে না পারার দরুন আমার এবং আমার সমগোত্রীয় কিছু মানুষের মনে বড় বেদনা ছিল। স্মার্ট বাঙালি একটি উপবিভাগ গড়ে তুলে আমাদের সেই যন্ত্রণা আমাদের থেকে মুক্তি দিয়েছে।
আমি বা আমরা হলাম: অশিক্ষিত মূর্খ ফালতু বাঙালি, তবে তেমন ‘ঘাটিয়া’ নয়।