এই পৃথিবী নামক ভূখণ্ডের মালাকানা কী করে পেল এই রাষ্ট্র? কীভাবে শুধুই সীমারেখা দিয়ে ভাগ করে গোটা পৃথিবী হয়ে গেল ছোট ছোট জেলখানা। এক জেলখানার মানুষ, অন্য জেলখানায় গেলে হয়ে যায় ‘অবৈধ’। একটি রক্তমাংসের মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মরে গেলেও সে মানুষ নয়, সে বৈধ নয় যদি তাঁর কাগজ না থাকে। অবৈধভাবে আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের দেশে পাঠাল আমেরিকা। বুক ছ্যাঁত করে ওঠে মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের, যাঁরা প্রতিনিয়ত তাদের সন্তানদের জন্য লালন করেন আমেরিকান ড্রিমস! ও ছেলে বিদেশে!– এই ঠোঁট বাঁকানো ঈর্ষার আলোতে গৌরবান্বিত হতে চান মধ্যবিত্ত ভারতীয়। সেই আমেরিকায় স্বপ্নভঙ্গ!
মানুষ কি শুধুই কাগজে?
আমার শহর কোথায়?
আমি খোঁজ করি আমার নিজের শহরের?
কোথায় আমার শহর?
কোথায় ছিল আমার শহর?
ঝপাসা হয়ে আসে আমার স্মৃতি।
হয়তো আমার শহর ছিল গোধরার কোনো বস্তিতে
কিংবা নর্মদার কোনো উপত্যকায়
না না
ছিল মুজাফ্ফরনগর-এ
বা ছিল নেলি তে
অথবা ঝিলম নদীর তীরে
অথবা ছিল বস্তারের গভীর জঙ্গলে
অথবা কুচেইপাদারে
অথবা নন্দীগ্রামে
অথবা মরিচঝাপিতে
অথবা দিল্লির জাফরাবাদ, চাঁদবাগ…
আমি ভুলে যাচ্ছি আরও নাম
আমার স্মৃতি আমার সাথে প্রতারণা করছে।
আমার স্মৃতি হচ্ছে দলিল
ঘেঁটে যাচ্ছে সময়, বছর, জায়গাগুলো
২০২০, ১৯৪৭, ১৯৬৪, ১৯৬৮, ১৯৮৪, ১৯৮৩,
১৯৮৯, ১৯৯২, ২০০২, ২০০৭, ১৯৭৯
চলছেই…
আমার সমস্ত শহর জুড়ে বারুদের গন্ধ
খাকি পোশাকের সাইরেন আর
আমার নাম ধরে সেই মৃত্যুডাক
সবকিছু একই…
আমার শহর কোথায়?
কোথায় আমার শহর?
তোমরা তোমাদের ঘৃণা দিয়ে
গিলে ফেলেছ আমার শহরকে…
(মূল কবিতা – Where Is My City?-এর ভাবানুবাদ। কাব্যগ্রন্থ The Musings Of The Dark থেকে নেওয়া)
কিছু মানুষের ভেসে বেড়ানোই যেন ললাট লিখন। শিকড়, মূল ছেড়ে ভেসে বেড়ানো। বন্যা, খরা, যুদ্ধ, জেনোসাইড আর সর্বোপরি দুটো ভাতের সন্ধানে মানুষ ভেসে বেড়ায়। ব্রহ্মপুত্র মেল, বিকানির এক্সপ্রেস, গৌহাটি ত্রিবান্দ্রম, কালকা মেল, নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেস-এর জেনারেল কামড়াগুলোতে উঠলেই দেখা যায় কুঁকড়ে থাকা মানুষগুলো। শিকড় কেটে দিলে, বা ছাগলে মুড়ে খেলে যেমন গাছগুলো কুঁকড়ে যায়। মানুষগুলোর চোখ, মুখ, নাক, শরীর– সবেতেই এক গন্ধ, যে গন্ধ অপরিষ্কার সাধারণ কামড়াগুলোর টয়লেটগুলোর গন্ধকেও ছাপিয়ে যায়, তাঁদের শরীর জুড়ে অনিশ্চয়তার গন্ধ। অনিশ্চয়তার গন্ধে লেপ্টে তাঁরা একটুখানি নিশ্চয়তা খুঁজতে যায়। কেউ ফেরে শিকড়ে কিছুদিনের জন্য, আবার একটু ছায়ায় জুড়িয়ে ফিরে যায়। পেট বড় বালাই। বেশ ভালো হত যদি পেট না থাকত। এই পেটের জন্যই কেউ কেরলে, তো কেউ ক্যালিফোর্নিয়ায়। পার্থক্য কেউ শুধুই পেটের টানে আর কেউ পেটের সঙ্গে আরও সুখ ও স্বচ্ছলতার খোঁজে।
………………………………………
ট্রাম্প অভিবাসী মুক্ত করবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। ট্রাম্প দখল নিতে চাইছেন পানামা খাল, কিনতে চাইছেন গ্রিনল্যান্ড। আর আমাদের দেশেও আসাম থেকে ‘বিদেশি’ বলে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। কাগজ নেই তুমি অবৈধ, তুমি শ্বাস নেও, না নেও কিচ্ছুটি যায় আসে না রাষ্ট্রের।
………………………………………
গোটা পৃথিবী জুড়েই ডানপন্থীদের বাড়বাড়ন্ত। নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিজেরাই তৈরি করছে শত্রু, কোথাও সেটা কালো অভিবাসী, কোথাও সেটা সংখ্যালঘুরা। কেউ কাগজ দেখতে চাইছে নিজের দেশের মধ্যে, নিজের নাগরিকের কাছে, আর ট্রাম্প বলছে সমস্ত অভিবাসীকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, অভিবাসীরাই সমস্ত সমস্যার মূলে! আর তাতেই হাততালি। যেমন এদেশে সদর্পে ঘোষণা, ‘হাম হিন্দু রাষ্ট্র বানায়েঙ্গে’, ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ আর তাতেই বাজিমাত, ব্যালট বাক্স ভর্তি ভোটে।
খবরের শিরোনাম, অবৈধভাবে আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের দেশে পাঠাল আমেরিকা। বুক ছ্যাঁত করে ওঠে মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের, যাঁরা প্রতিনিয়ত তাদের সন্তানদের জন্য লালন করেন আমেরিকান ড্রিমস! ও ছেলে বিদেশে!– এই ঠোঁট বাঁকানো ঈর্ষার আলোতে গৌরবান্বিত হতে চান মধ্যবিত্ত ভারতীয়। সেই আমেরিকায় স্বপ্নভঙ্গ!
আমার চোখ কিন্ত আটকে যায় ‘অবৈধ’ শব্দটিতে। আচ্ছা একটি মানুষ কী করে অবৈধ হতে পারে? এই পৃথিবীর জল, হাওয়া, অক্সিজেন– ট্রাম্প, মাস্ক বা আদানির মতো বিলিনিয়র তো সৃষ্টি করেনি। এই পৃথিবী নামক ভূখণ্ডের মালাকানা কী করে পেল এই রাষ্ট্র? কীভাবে শুধুই সীমারেখা দিয়ে ভাগ করে গোটা পৃথিবী হয়ে গেল ছোট ছোট জেলখানা। এক জেলখানার মানুষ, অন্য জেলখানায় গেলে হয়ে যায় ‘অবৈধ’। লাগে কাগজ, হ্যাঁ আমরা এখন সবাই শুধুই ‘কাগজ’। একটি রক্তমাংসের মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মরে গেলেও সে মানুষ নয়, সে বৈধ নয় যদি তাঁর কাগজ না থাকে। ব্যাংকে কাগজ, খেতে কাগজ, শ্বাস নিতে কাগজ। এই দেশে আধার নামক ফাঁস গলায় ঝুলিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে আপনার ওপর সবসময় নজর আছে শাসকের। আপনি কোন রেস্টুরেন্টে খাচ্ছেন, কোথায় সেক্স করছেন– সব। আর এই আধার না থাকলে আপনি ‘অবৈধ’। আপনি উপস্থিত থেকেও নেই। আপনার ডিজিটাল মৃত্যু হতে পারে, আর যা দিতে পারে রাষ্ট্র।
ট্রাম্প অভিবাসী মুক্ত করবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। ট্রাম্প দখল নিতে চাইছেন পানামা খাল, কিনতে চাইছেন গ্রিনল্যান্ড। আর আমাদের দেশেও আসাম থেকে ‘বিদেশি’ বলে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। কাগজ নেই তুমি অবৈধ, তুমি শ্বাস নেও, না নেও কিচ্ছুটি যায় আসে না রাষ্ট্রের।
মানুষের জন্য পৃথিবী, সেই পৃথিবীর দখল নিয়েছে শাসকরা। আর এখন রাষ্ট্র মানেই শিল্পপতির দখলে। আগে আড়ালে সরকারকে সাহায্য করে বন্ধু সরকার বানাত শিল্পপতিরা, এখন আর কোনও রাখঢাক নেই। শিল্পপতিরাই সরকার। ট্রাম্প আর ইলন মাস্কের দহরম মহরম, ভারতে মোদি-আদানি ঘনিষ্ঠতা সবই তারই ইঙ্গিত-বহ। সবটাই এখন পুঁজির, পুঁজিই ঠিক করবে বৈধ, অবৈধ এর সংজ্ঞা। সেখানে এদের অস্ত্র এনআরসি- সিএএ-এর মতো আইন।
সবার অলক্ষ্যে শুরু হয়েছে শত্রু সম্পত্তি উদ্ধারের কাজ। আমার গ্রামে প্রায় ৮৪টি পরিবার উচ্ছেদের মুখে। দেশভাগের সময় বা তার পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত লোকজন পাকিস্তানে চলে যায়, তাঁদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি হল শত্রু সম্পত্তি। কী আজব নাম! এ দেশ থেকে চলে গেছে বলেই শত্রু বলে দাগিয়ে দেওয়া! রাষ্ট্রের নির্মিত সংজ্ঞা, যা বাধ্য হয়ে শিকড় ফেলে যাওয়া নাগরিককে শত্রু বলে চিহ্নিত করে! রাষ্ট্রই তাঁর ভাষ্যে ঠিক করে কে বন্ধু কে শত্রু। তাঁদের ফেলে যাওয়া জমিতে বসবাস করেন অনেক প্রান্তিক কৃষক। Enemy Property Act-এ তাঁদের উচ্ছেদ হলে তাঁরা যাবেন কোথায়? উত্তর নেই। রাষ্ট্রের যায়-আসে না। তাঁরা হয়তো কোনও ঝুপড়িতে আশ্রয় নেবেন। বা কোনও পরিত্যক্ত জায়গায়। আবার সেখান থেকে উচ্ছেদ হবেন। আবার কোনও দিন খাকি বাহিনী সব গুঁড়িয়ে দেবে সরকারের ফরমানে। যেমন সামরিক বিমানে চাপিয়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে শিকল বেঁধে ভারতে পাঠাল বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী দেশে আমেরিকা ১০৪ জন ভারতীয়কে। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো এই শিকল পরিয়ে পাঠানোর জন্য চরম প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি পাঠিয়েছেন নিজস্ব বিমান তাঁর দেশের অভিযুক্ত অবৈধ নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। আর আমাদের দেশ? যে দেশে ২৩ কোটি সংখ্যালঘুকে প্রতি মুহূর্তে নিজের দেশেই ‘অপর’ হয়ে থাকতে হয়, সেই দেশে মানবাধিকার, নাগরিক সম্মান নিয়ে যে রাষ্ট্র ভাবিত নয় বলাই বাহুল্য।
এই সেই অভিশপ্ত ফেব্রুয়ারি মাস। এই মাস সাক্ষী নেলি গণহত্যা (১৯৮৩), গুজরাত দাঙ্গা (২০০২), দিল্লি দাঙ্গার (২০২০)।
কোথায় গেল এই হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে না মরে বেঁচে ফেরা লোকগুলো। তাঁরা ভাসমান, শিকড়ের সন্ধানে। আসলে মানুষও চায় গাছ হতে। কিন্তু যেখানে ক্লাইমেট ইকোসাইড চলছে, সেখানে গাছও বিপন্ন মানুষের হাতে, রাষ্ট্রের হাতে।
শিকল পরা মাথা নীচু করে দেশে ফেরা ওই ‘অবৈধ’ মানুষগুলো আসলে এই পৃথিবী নামক ভূখণ্ড, শিকল আর কাঁটাতারে ক্ষত-বিক্ষত।
হয়তো একদিন সমস্ত পৃথিবী জুড়ে চাঁদের আলোটাও বাটোয়ারা হবে। বা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ হয়তো শিরদাঁড়া সোজা করে সমস্ত কাগজ আস্তাকুড়ে ফেলে বৈধ, অবৈধর সমস্ত বিভেদ ভুলে ঘুরে দাঁড়াবে। সেদিন কোনও জর্জ ফ্লয়েড বন্দুকের নলের নিচে হাঁটু রেখে কাতর স্বরে মিনতি করবে না যে ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’। সেই ফ্লয়েড যাকে মিনেপোলিস-এর পুলিশ পাক্কা নয় মিনিট হাঁটু গেড়ে রেখেছিল তাঁর দমবন্ধ না হওয়া পর্যন্ত। পুরো পৃথিবীর এখন ফ্লয়েডের মতো দমবন্ধ অবস্থা। শ্বাস চেপে ধরেছে ফ্যাসিস্ট শাসক– পুঁজিবাদী নেক্সাস।
মুক্তির স্বপ্ন এ মুহূর্তে খুব ধূসর লাগছে। কিন্তু মানুষ স্বপ্ন দেখতে পেরেছিল বলেই মানুষ টিকে আছে। ট্রাম্প, মোদি একদিন অতীত হবেই। শুধু ভয় কোলাট্যারেল ড্যামেজের। পৃথিবীর বুকের উষ্ণতা বাড়ছে। গিলে খেতে পারে লাভা। সেটাই ভয়ের।