অমানবিক আঁধার পর্যটনের দায়ভাগ শুধু আমজনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে ভুল হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই হুজুগে ভ্রমণের আগ্রহ তৈরি করার পেছনে নানা ভাষার কয়েক হাজার নিউজ চ্যানেলের অবদান কম নয়। গ্রাউন্ড জিরোয় দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে লাইভ সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিতভাবেই কিছু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এই সমস্ত ঘটনার অকুস্থলে পৌঁছে যেতে। দামি মুভি ক্যামেরা না থাকলেও সর্বক্ষণের সঙ্গী মোবাইল ক্যামেরার এক ক্লিকে বা কয়েক মিনিটের ভিডিও সুটে নিজেকে ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের অংশ করে নেওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষাকে বশে আনা সহজ নয়।
২০১৯-এর ৩ মে, ফণী ঘণ্টায় ২০৫ কিলোমিটার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুরী শহরের ওপর। তার ঠিক সপ্তাহ তিনেক বাদে পা রেখেছিলাম জগন্নাথ ধামে। সেটা ছিল মে মাসের ২৯। যাবই না ভেবেছিলাম, কিন্তু হোটেল ভাড়ার হাজার পাঁচেক টাকা জলে যাবে ভেবে যেতেই হল। দূরদর্শনের নিউজ চ্যানেলে,সংবাদপত্রে চূড়ান্ত অব্যবস্থার খবর, পরিচিতদের নিষেধ, সবকিছুর মধ্যে একমাত্র সম্বল হোটেল মালিকের দূরভাষিক আশ্বাস, ‘চলে আসুন, কোনও সমস্যা নেই’। কিন্তু গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার ধাক্কায় পাঁচ বছর হয়ে গেল আর পুরী যাইনি। আসলে যেতেই পারিনি।
এখনও পুরীর কথা ভাবলেই অদ্ভুত একটা ট্রমা দলা দলা অন্ধকারের মতো নিমেষে শরীর মনকে অবশ করে ফেলে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফণী-বিপর্যস্ত পুরীর মনখারাপ করা ছবি। উল্টে পড়া গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার, দরজা জানলা ভাঙা বিধ্বস্ত খাঁ খাঁ শূন্য আলিশান হোটেল, চাল উড়ে যাওয়া দোকান ঘর, ধসে যাওয়া মেরিন ড্রাইভের অতলান্ত বিমর্ষতা, অবচেতনে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যে পুরী যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে যায়।
বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। নিজেকে আনস্মার্ট মনে হয়। হীনম্মন্যতায় ভুগতে ভুগতে দেখি, কোনও কোনও শ্রীক্ষেত্র ভ্রামণিক সমাজমাধ্যমে তাঁদের ফণী দর্শনের কিস্সা আলঙ্কারিক শব্দে সাজিয়ে সাতকাহন করে পরিবেশন করছেন। ভিডিও, ছবি পোস্ট করছেন। তাঁদের লেখার প্রতিটা শব্দ থেকে ঝরে পড়ছে অনন্য বিরল অভিজ্ঞতা প্রাপ্তির অহংকার। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায়, মুম্বই-এর ধারাভী বস্তিতে দারিদ্র ভ্রমণের (poverty tourism) গদগদ চিত্ত কাহিনিগুলির কথা। নির্দ্বিধায় তাঁরা কীভাবে মানুষের দারিদ্র, অস্বাস্থ্যকর যাপনের প্রসঙ্গ নির্লজ্জ ভঙ্গীতে বর্ণনা করছেন! আর দারিদ্রকে বিক্রি করে লাখো লাখো ডলার আয় করছেন ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো! কোনও হইচই, প্রতিবাদ নেই। ধারাভীর দরিদ্র শ্রমজীবী থেকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীর শিক্ষিত নাগরিক সমাজ, সকলেরই মুখে কুলুপ। অথচ ডমিনিক ল্যাপিয়ারের ‘দা সিটি অফ জয়’-এর দারিদ্র চিত্র নিয়ে কলকাতা জুড়ে কী তুমুল প্রতিবাদই না হয়েছিল!
গানের মতোই ভ্রমণ নিষ্পাপ সুকুমার আনন্দের উৎসভূমি। ভাবতে অবাক লাগে বাণিজ্যিক মানসিকতার ইন্ধনে ভ্রমণের মতো সুকুমার আনন্দ উপভোগ করার জন্য মানুষ বেছে নিচ্ছে স্যাডিজিমের অনৈতিক পথ। কথায় কথায় সম্রাট নিরোর শহরে আগুন জ্বালিয়ে বীণায় বিষাদ সুর সৃষ্টির উপমা ব্যবহার করা আমরা অন্যের জীবনের বিপর্যয়, দুঃখ, দারিদ্র উপভোগের জন্য যাবতীয় অসুবিধে, সমস্যা, এমনকী ব্যক্তিগত সুরক্ষাও বাজি রাখতে পিছপা নই। পুলিশ বা বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মীদের হাতেপায়ে ধরে আদায় করে নিচ্ছি আসন্ন দুর্যোগের কেন্দ্রস্থলে থাকার অনুমতি।
………………………………………………………
আরও পড়ুন তিলোত্তমা মজুমদার-এর লেখা: ধ্রুপদী তকমার পরে বাঙালি কি আর বাংলা বলায় গ্লানি বোধ করবে না?
………………………………………………………
ইদানীং মহাকোটালে দীঘার হোটেলে হোটেলে পর্যটক উপচে পড়ে। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাড় ওপচানো উত্তাল ঢেউয়ের সামনে বিপজ্জনকভাবে সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। পুজোর আগে থেকেই ‘দানা’-র পূর্বাভাসে জানানো হচ্ছিল আঘাতের সম্ভাব্য সময়সারণি। তবুও পুরী বা দীঘাতে পর্যটক উপচে পড়েছিল। পুজোর ভ্রমণের সঙ্গে ঝড় ফাউ! এদের সরাতে প্রশাসনকে হিমসিম খেতে হয়েছে। পুরী ফাঁকা করা গেলেও দীঘা ও মন্দারমণিতে ইতিউতি সামান্য কিছু পর্যটক পুলিশের সঙ্গে যে লুকোচুরি করে রয়ে গিয়েছিলেন তার সাক্ষী ২৫ অক্টোবরের সংবাদপত্রের পাতা ও ইউটিউবের কিছু ভিডিও।
এঁরা নিজেদের স্বপক্ষে কৈফিয়ত দিয়ে বলতেই পারেন, ঝড়ের সঙ্গী হওয়া নতুন কিছু নয়। যাঁরা স্পিলবার্গের ‘টুইস্টার’ দেখেছেন তাঁরা অবশ্যই ‘স্টর্ম চেজার’-দের বিষয়ে জানেন। টর্নেডো ও হ্যারিকেন প্রবণ আমেরিকায় ‘স্টর্ম চেজিং’ বেশ জনপ্রিয় । কিন্তু এখানে যাঁরা ঝড় দেখার জন্য আদেখলার মতো প্রশাসনের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলছিলেন তাঁরা কেউই ‘স্টর্ম চেজিং’- এর মতো বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চার টুরিজম তো দূরের কথা হয়তো সাধারণ ট্রেকিং- ও কোনওদিন করেননি। বেশিরভাগই নিছক পারিবারিক ভ্রমণে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত সাংসারিক চরিত্র। বন্ধুমহলে, অফিস ক্যান্টিনের আড্ডায়, চায়ের ঠেকে ঝড়ের দুঃসাহসী কথকতায় সকলের ঈর্ষার পাত্র হয়ে ওঠা বা ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে সনসনিখেজ ছবি, ভিডিয়োয় কয়েক হাজার লাইক ও ভিউয়ার পাওয়াই এদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
তবে এই হুজুগ শুধু ভারত বা বাংলা নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই চলছে। এই ধরনের পর্যটনের গালভরা নাম ‘ডার্ক’ বা ‘ ব্ল্যাক টুরিজম’। অক্সফোর্ড ডিকসেনারির ব্যাখ্যা ‘Tourism that involves travelling to places with death and sufferings.’ এই ব্যাখ্যার আলোয় ‘ডার্ক টুরিজম’ শব্দের যথার্থ অনুবাদ বোধহয় ‘অন্ধকার পর্যটন’। জেরুজালেম শহরের বাইরে গোলগাথা পাহাড়ে (মতানৈক্য আছে) যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পবিত্রভূমিতে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের তীর্থযাত্রাকে বহুকাল আগে থেকেই ‘ব্ল্যাক টুরিজম’ বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ডের কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আউৎসভিৎস-এ পর্যটকের ঢল নেমেছিল। নাৎসি অত্যাচারের বীভৎসতম বন্দিশিবিরে ভ্রমণ ‘অন্ধকার পর্যটন’-এর আদর্শ উদাহরণ। অমানবিক নৃশংসতার জীবন্ত আর্কাইভ দর্শনকে ‘ট্র্যাজেডি টুরিজম’ বললেও বোধহয় ভুল হবে না।
মানুষের কৌতূহল সাধারণত তাড়া করে সাম্প্রতিককে। তাই এই সেদিনের পারমাণবিক চুল্লী বিস্ফোরণে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া চেরনোবিল শহর আজ অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। আমরা অবশ্য এতটা অমানবিক নই। তাই গ্যাস দুর্ঘটনাকে মনে রেখে নয়, ভারতীয়রা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্যই ভূপাল ভ্রমণে যাই। কিন্তু গতিময়, চূড়ান্ত রকমের বস্তুবাদী ইউরোপীয় বা আমেরিকানদের মধ্যে অঙ্কের হিসেবে সামান্য হলেও কিছু মানুষ নাকি এই মুহূর্তে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ভ্রমণে যেতে আগ্রহী। মৃত্যু-শীতল বিপর্যয় দর্শনের এই আকাঙ্ক্ষার তুলনায় প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে পুরী বা দীঘায় ‘দানা’-র সাক্ষী থাকার চেষ্টা ধর্তব্যযোগ্য নয়।
এই অমানবিক আঁধার পর্যটনের দায়ভাগ শুধু আমজনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে ভুল হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই হুজুগে ভ্রমণের আগ্রহ তৈরি করার পেছনে নানা ভাষার কয়েক হাজার নিউজ চ্যানেলের অবদান কম নয়। গ্রাউন্ড জিরোয় দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে লাইভ সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিতভাবেই কিছু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এই সমস্ত ঘটনার অকুস্থলে পৌঁছে যেতে। দামি মুভি ক্যামেরা না থাকলেও সর্বক্ষণের সঙ্গী মোবাইল ক্যামেরার এক ক্লিকে বা কয়েক মিনিটের ভিডিও সুটে নিজেকে ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের অংশ করে নেওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষাকে বশে আনা সহজ নয়। আর এখন সমাজমাধ্যমে আত্মপ্রচার বা অর্থ উপার্জনের সুযোগ যখন সকলের নাগালের মধ্যে তখন ব্যক্তিগত সুরক্ষা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ বা মানবিকতাকে কে আর গুরুত্ব দেয়!
বৃহত্তর অর্থে গোটা সভ্যতাই তো এখন একধরনের শূন্যগর্ভ ‘আঁধার পর্যটন’-এ ব্যস্ত।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….