নতুন নামে কি স্টেশন-সংলগ্ন দোকানে চা-বিক্রি বেড়েছে? পরিযায়ী শ্রমিকের ভিড় কমেছে নির্ঘাত? গুটখার লাল থুতু ফেলামাত্রই উবে যাচ্ছে স্টেশন থেকে? যে মেয়েটা বোবা, ভিক্ষে করে, হাতে পেয়েছে লাখো রুপিয়া? ফিরে পেয়েছে বাক্শক্তি? হয়েছে খিল্লি। ভারতের সনাতন মুখ আদতে বদলায়নি। সংরক্ষণের মোড়কে, ঐতিহ্যের অছিলায়, জাস্ট ধুয়ে-মুছে সাফ। এটাই কি স্বচ্ছ ভারত? কারণ, নামের উৎসমুখে জ্বলজ্বল করে ইতিহাস।
আপনারা সেই বুড়ো লোকটাকে চেনেন? ক্লান্ত আর অবসন্ন মুখ যার! পরনে ধূসর ওভারকোট। ছাতির সাইজ কি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি? হতে পারে। সকালে বিকেলে হাঁটতে বেরোয়। দুটো একটা কথা বলে। আর সারাটা সন্ধে বসে থাকে চেয়ারে। সামনে টেবিল। টেবিলের ওপর অ্যালার্ম ঘড়ি। পুরনো সংবাদপত্রের ডাঁই। ফোটো-অ্যালবাম। দেওয়ালে আয়না। একটা ছবি। পাশে বিছানা ও দেরাজ। সংসার বলতে এটুকুই। গ্যাদগ্যাদে। মোটে স্বাদ নেই। অতএব এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠে বুড়োর মনে হল: বদলে দিতে হবে! তা কী বদলে দিতে হবে? এই ধরুন– নাম।
পিটার বিকসেলের এ-গল্পখানা, ‘টেবিল ইজ এ টেবিল’, আপাতত থামিয়ে জাম্প কাটে ফিরি একুশ শতকে। ভারতে। উত্তরপ্রদেশের লখনউ শাখার আটটি রেল-স্টেশনের নাম বদলে গেছে। অমেঠির প্রাক্তন সাংসদ, স্মৃতি ইরানির উদ্যোগে। ‘জায়েস’ রেল-স্টেশনের নতুন নাম, গুরু গোরক্ষনাথ ধাম। ‘মিসরৌলি’ স্টেশন বদলে হয়েছে, মা কালিকা ধাম। ‘আকবরগঞ্জ’ বর্তমানে, মা আহর্যা ভবানী ধাম। ইত্যাদি।
ভক্তি। হুড়মুড়িয়ে উপচে পড়ছে দেশে। চৌবাচ্চা পুকুর অথবা মগ– কোথাও আঁটছে না। অমৃতকাল কি না! স্মৃতি ইরানি বলছেন, যা-কিছু হয়েছে, হচ্ছে, হবে, ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ-স্বার্থে। তা বেশ। কিন্তু সংরক্ষণ-কার্যে নাম যদি মুখ্য টার্গেট হয়, তাহলে তৈরি হয় কাঁঠালের আমসত্ত্ব। যেমন, মোঘলসরাই। সকলে নিশ্চিত জানেন, স্টেশনটির সাম্প্রতিক নাম, পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়। কেন? মোঘল শব্দটি শুনলেই বোধহয় কারও কারও চোঁয়াঢেঁকুর ওঠে। অগত্যা স্টেশন নয় শুধু, এনসিআরটি-র সিলেবাস থেকেও সে ইতিহাস উধাও। ভ্যানিশ।
নতুন নামে কি স্টেশন-সংলগ্ন দোকানে চা-বিক্রি বেড়েছে? পরিযায়ী শ্রমিকের ভিড় কমেছে নির্ঘাত? গুটখার লাল থুতু ফেলামাত্রই উবে যাচ্ছে স্টেশন থেকে? যে মেয়েটা বোবা, ভিক্ষে করে, হাতে পেয়েছে লাখো রুপিয়া? ফিরে পেয়েছে বাক্শক্তি? হয়েছে খিল্লি। ভারতের সনাতন মুখ আদতে বদলায়নি। সংরক্ষণের মোড়কে, ঐতিহ্যের অছিলায়, জাস্ট ধুয়ে-মুছে সাফ। এটাই কি স্বচ্ছ ভারত? কারণ, নামের উৎসমুখে জ্বলজ্বল করে ইতিহাস।
…………………………………………………….
অগাস্ট। ২০২০। পণ্ডিত বিসমিল্লাহ খানের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল যোগী আদিত্যনাথের সরকার। যে ঘরে বসে রেওয়াজ করতেন বিসমিল্লা, সেটিও ধুলো। এই ঐতিহ্যের প্রতিপালক হয়েছি আমরা? এ-সবই মনে হয়, ধুলো। একটা মস্ত বড় ধুলোর ভেতর ঢুকে পড়েছি। কেউ বলেছে, শহীদ ভালে সুলতানের নামে রেল-স্টেশন চাই। কেউ বলছে, মহারাজা বিজিল পাসি-র জন্য নিহালগড় বদলে যাক। বিস্তর এই নামসংকীর্তনে, ভারতীয় রেল দুর্ঘটনার ছেঁড়া ছেঁড়া রক্তমাংসপিণ্ডের কথা বেমালুম ভুলে যাই।
…………………………………………………….
নদীয়া জেলার যে অঞ্চলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বসবাস, প্রতিপত্তি ও খ্যাতি! ইতিহাস বলছে, ১৭৩০ সালের কথা। সে অঞ্চলের নিকটবর্তী রেল-স্টেশনের নাম ‘কৃষ্ণনগর’ হতে বাধ্য! বেগুনকোদর নিশ্চয়ই হবে না। দ্বাদশ শতাব্দীতে যখন, গোরক্ষনাথ– এক হিন্দু সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটছে উত্তর ভারতে! অত্যন্ত স্বাভাবিক মতেই সে অঞ্চলটির নাম হবে গোরক্ষপুর। ষোড়শ শতাব্দীতে, মোঘল-সম্রাট জাহাঙ্গীরের ঠিকানা যেখানে, দিল্লির সেই মেট্রো-স্টেশনের নাম জাহাঙ্গীরপুরীই হবে। ইতিহাসের আত্মা জড়িয়ে থাকে সে-নামে। তাই বলে কি দেশের প্রতিটি রেল-স্টেশনের নাম ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে? কখনও না। হতে পারেও না। কিন্তু ‘আকবরগঞ্জ’, ‘ফুরসতগঞ্জ’, ‘ওয়াসিরগঞ্জ’ কিংবা ‘নিহালগড়’– এ-হেন উর্দু নামগুলি বদলে দেওয়ার যে প্রবণতা এবং প্রবণতার অভিঘাত মারাত্মক। সুচিন্তিত। রাষ্ট্রের সিলেবাস কি হালফিলের সনাতন ভাষায় লেখা হচ্ছে, হে পাঠক? সেক্ষেত্রে, ভারতের যাবতীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য, যে ভার্সেটালিটি, যে অবাধে পায়চারি, হাওয়ার মতো– তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং একসময়, আমাদের স্মৃতি থেকে উবে যায়।
…………………………………………………
আরও পড়ুন রোদ্দুর মিত্র-র লেখা: সারা পৃথিবীতেই আন্দোলন ফুটবলের জন্মদাগ
…………………………………………………
অগাস্ট। ২০২০। পণ্ডিত বিসমিল্লাহ খানের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে ঘরে বসে রেওয়াজ করতেন বিসমিল্লা, সেটিও ধুলো। এই ঐতিহ্যের প্রতিপালক হয়েছি আমরা? এ-সবই মনে হয়, ধুলো। একটা মস্ত বড় ধুলোর ভেতর ঢুকে পড়েছি। কেউ বলেছে, শহিদ ভালে সুলতানের নামে রেল-স্টেশন চাই। কেউ বলছে, মহারাজা বিজিল পাসি-র জন্য নিহালগড় বদলে যাক। বিস্তর এই নামসংকীর্তনে, ভারতীয় রেল দুর্ঘটনার ছেঁড়া ছেঁড়া রক্ত-মাংসপিণ্ডের কথা বেমালুম ভুলে যাই। রেলে নিয়োগ হয় না। রেল ধুঁকতে থাকে। মানুষ মরে। একটা একটা স্টেশনের নাম পালটে যায়।
নামে কী আসে যায়? ইউনিক আইডেন্টিটি। আজ যে ছেলের নাম অন্তর, আগামিকাল বদলে হল দর্শন, পরশু দিন কেষ্ট, তারপর রবীন্দ্রনাথ। এরপর সে দারুণ কবিতা লিখবে না ভক্তিগীতি গাইবে– কেউ জানে না। অথবা, নির্ভর করবে অন্তরের অন্তরে। কিন্তু একজন ব্যক্তি হিসেবে সে বিভ্রান্ত। বিভ্রান্ত তার পারিপার্শ্বিক। মানুষটির অস্তিত্ব কেমন বায়বীয়!
…………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………………….
শেষ করি শুরুয়াতে। পিটার বিকসেলের গল্পে। বুড়ো লোকটা কী করেছিল? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, বিছানার নাম দিয়েছিল ‘ছবি’। টেবিলকে ‘গালছে’। চেয়ার হয়েছিল ‘ঘড়ি’। আয়না হল ‘চেয়ার’। এরপর থেকে সে ক্রমাগত একা হতে শুরু করে। ভাষা কেউ বোঝে না। সে একটি ঘরে আবদ্ধ। পিটার বিকসেলের গল্পটির ভাষ্য এত সরল নয়, তবু বুড়ো লোকটাকে কেউ ডেকে জিজ্ঞেস করে না, ‘কেমন আছেন!’ সে যেন অন্য গ্রহের জীব। সকলে এড়িয়ে চলে। ভয়ও পায়।
খানিকটা রাষ্ট্রের মতো।
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।