কর্নাটকে জন্ম দয়া নায়েকের। তবে সিনেমার গল্পের মতো তাঁর জীবন। একটা সময়ে ক্যান্টিনে কাজ করেছেন। রাত কাটিয়েছেন সেই ক্যান্টিনের মেঝেতে। পরিবারের খরচ জোগানোর তাগিদে তখন ওই পেশাই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তবে পুলিশের চাকরির প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধা ছিল। জানা যায়, কলেজে পড়ার সময়ে এক কলমিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে কাজ করার সময়ে নার্কোটিক্স বিভাগের কিছু অফিসারকে দেখেই তাঁর মনে ইচ্ছে জেগেছিল পুলিশ হওয়ার।
সময়টা নয়ের দশক। মুম্বইয়ের মাটিতে তখন অন্ধকার জগতের ‘বাহুবলী’দের অবাধ বিচরণ। দিনে দুপুরে শুট আউট তো সে সময়ে জলভাত! সারা বিশ্বের তকমা পাওয়া সমাজবিরোধীদের তখন মুম্বইয়ের প্রতি অমোঘ টান। কথায় আছে, মুম্বই শহরে কখনও আলো নেভে না। এই শহর নাকি সব সময় সচল। তবে সেই সময়ের বাণিজ্যনগরী প্রায় অচল হতে বসেছিল। ব্যবসাদার থেকে অভিনয় জগতের বিভিন্ন ব্যক্তিকে হুমকি দিয়ে মোটা টাকা আদায় করা একটা ‘ট্রেন্ড’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর কথা না শুনলেই শুট আউট! সাধারণ মানুষের ঘরের বাইরে বেরনো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, সেইসব শুট আউটের মাঝে পড়ে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল অহড়হ। বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যায়, সেই সংখ্যাটা প্রায় হাজার। তবে এই সংখ্যা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। দাউদ গ্যাং, পাঠান গ্যাং, ছোটা রাজন গ্যাং, অরুণ গাউলি গ্যাং তখন রাতের ঘুম কেড়েছে। এইসব গ্যাংস্টার আইনের জালে না জড়িয়ে সোজাসুজি অপরাধ করার সময়ে খতম করে দেওয়ার প্রশাসনিক চিন্তা থেকেই জন্ম হয়েছিল মুম্বই পুলিশের ‘ডিটেকশন ইউনিট’।
সারা ভারত যাকে এনকাউন্টার জগতের ধ্রুবতারা বলে চেনে, সেই প্রদীপ শর্মার তত্ত্বাবধানে গঠিত হয়েছিল মুম্বই পুলিশের ডিটেকশন ইউনিট। প্রদীপ শর্মা ১৯৮৩ সালের মুম্বই পুলিশ ব্যাচের অফিসার। ওঁর ব্যাচমেটরাও এনকাউন্টার জগতে নামকরা ব্যক্তিত্ব। বিজয় সালাস্কার, যিনি ২০০৮ সালে মুম্বই হামলার সময়ে শহিদ হন। এছাড়াও প্রফুল ভোঁসলে, আসলাম মোমিন, রবীন্দ্র আংরে, সচিন ওয়েজ– তখন মুম্বই জগতের ‘নোংরা’ সাফ করতে করতে প্রায় একযুগ কাটিয়ে দিয়েছেন। সেই সময় সংবাদমাধ্যম তাঁদের ‘ডার্টি হ্যারিস অফ মুম্বই’ বলে আখ্যা দিত। নয়ের শেষের দিকেই এই মুম্বই পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদে যোগ দিলেন একজন তরতাজা যুবক। নাম দয়া নায়েক। পেশিবহুল চেহারার মধ্যে একটা এক্স-ফ্যাক্টর ছিল। আর সেই এক্স-ফ্যাক্টর ছিল বলেই প্রদীপ শর্মার চোখে পড়েছিল দয়া। নয়তো সেই ছেলেটা আজকে খুব সাধারণ থেকে যেত।
কর্নাটকে জন্ম দয়া নায়েকের। তবে সিনেমার গল্পের মতো তাঁর জীবন। একটা সময়ে ক্যান্টিনে কাজ করেছেন। রাত কাটিয়েছেন সেই ক্যান্টিনের মেঝেতে। পরিবারের খরচ জোগানোর তাগিদে তখন ওই পেশাই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তবে পুলিশের চাকরির প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধা ছিল। জানা যায়, কলেজে পড়ার সময়ে এক কলমিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে কাজ করার সময়ে নার্কোটিক্স বিভাগের কিছু অফিসারকে দেখেই তাঁর মনে ইচ্ছে জেগেছিল পুলিশ হওয়ার। বারবার বিভিন্ন উপায়ে পুলিশে চাকরি পাওয়ার জন্য যে পড়াশোনা এবং কায়িক শ্রম করতে হয় সেই চেষ্টা করেন তিনি। তবে অর্থের অভাবে বারেবারে পিছিয়ে আসতে থাকেন। এক সময় তাঁর মনে হয়েছিল যে আর তিনি পারবেন না। কিন্তু ওই ক্যান্টিনের মালিক তাঁকে অর্থ সাহায্য করেন এবং তিনিও সেই সাহায্য পেয়ে মুম্বই পুলিশে চাকরি পান।
তবে বারবার তথাকথিত সুখের জীবনের হাতছানি তিনি প্রত্যাখান করেছেন। এক সময়ে মুম্বইয়ের শাসক দলের থেকে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হওয়ায় প্রস্তাব আসে। তিনি নাকচ করে দেন। ফিরিয়ে দিয়েছেন রাজ্যসভার প্রস্তাব। এছাড়াও সিনেমা জগতে পা রেখে প্রোডিউসার হওয়ার সুযোগও তিনি হেলায় হারিয়েছেন। লাইমলাইটের আলোয় থেকে ‘হিরো’ হতে তিনি চাননি। পুলিশের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার কথাও তিনি ভাবেননি। শোনা যায়, সেই সময় অন্ধকার জগতের কোনও এক বাহুবলী তাঁকে বিরাট একটা ব্যবসা তৈরি করে দিতে চান, কিন্তু দয়া সেই প্রলোভনে পা দেননি। নিজের জীবনে তিনি একটাই মন্ত্র আওড়ে গিয়েছেন। প্রসেস। প্রক্রিয়া। না হওয়া পর্যন্ত এক নাগাড়ে সেই বিষয়ের প্রতি উনি মনোনিবেশ করে গিয়েছেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত উনি লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, ততক্ষণ শুধু শ্রম করে গিয়েছেন।
…………………………………………..
২০০৪ সালের বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘আব তক ছাপ্পান’ এই দয়া নায়েকের জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। যেখানে নানা পাটেকর মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। তেলেগু সিনেমায় তৈরি হয়েছে ‘গোলিমার’, কন্নড় ভাষায় তৈরি হয়েছে ‘এনকাউন্টার দয়া নায়েক’। ২০১৫ সালে হিন্দি সিনেমা ‘আব তক ছাপ্পান ২’ রিলিজ করে। ২০১২ সালে তৈরি হয়েছে ‘ডিপার্টমেন্ট’, মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন সঞ্জয় দত্ত।
…………………………………………..
শুধু তাই নয়, লক্ষ্যে পৌঁছেও মাথা নিচু রেখেছেন। পুলিশের পোশাকটায় তাঁর কাছে সবচেয়ে কাছের হয়ে উঠেছে। গুলি-বন্দুকের বাস্তব জীবন তাঁর কাছে বড্ড প্রিয়। তিনি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়েও একটা ছিমছাম জীবন বেছে নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের আলো থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন।
সেদিন তাঁকে অনেক দিন পরে আবার টিভির পর্দায় দেখা গেল। চুলে পাক ধরেছে। নীল জিন্সের পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে সার্ভিস রিভলভার। সম্ভবত আমেরিকান রুগার। কালো টি-শার্ট ভেদ করে পেশিবহুল চেহারা এখনও আগের মতোই উজ্জ্বল। চোখে রিমলেস চশমা। সামনের বছর তাঁর চাকরির মেয়াদ ফুরোতে চলেছে। সইফ আলি খানের বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার তদন্তে সেই বিখ্যাত দয়া নায়েক!
অনেকের মনে প্রশ্ন, তিনি কেন? তিনি তো এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট! যদিও বর্তমানে তিনি মুম্বই ক্রাইম ব্রাঞ্চের সিনিয়র ইন্সপেক্টর। প্রসঙ্গত, এখন আর মুম্বইয়ের ডিটেকশন ইউনিট নেই। এনকাউন্টার এখন নিষিদ্ধ। তবে দয়া নায়েকের মতো পুলিশ অফিসার এখনও বিরল। তিনি জুহু থানার সাব ইন্সপেক্টর হয়ে পুলিশ জীবন শুরু করলেও মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ছোট রাজন গ্যাংয়ের দুই সদস্যকে এনকাউন্টারে খতম করেন। ১৯৯৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি যে ‘জঞ্জাল’ সাফাইয়ের কাজে নামেন, সেই কাজ তিনি আজও করে যাচ্ছেন।
প্রদীপ শর্মার মতো গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে মুম্বই শহরের ‘জঞ্জাল’ সাফাই করতে শুরু করেছিলেন দয়া নায়েক, নিজের কথা কখনও ভাবেননি। নিজের পরিবারের কথাও ভাবার সময় পাননি। একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, নিজের পরিবারের সঙ্গে কোথাও তিনি যেতে পারেন না, কারণ তাঁর মতো পরিবারকেও খুন করার পরিকল্পনা কষতে পারে– এমন বহু লোক শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাড়ির বাইরে পা রাখলেই সবসময় সঙ্গে রাখেন সার্ভিস রিভলবার। একটা নয়, দুটো। কারণ, তাঁর জীবনের ঝুঁকিটা বড্ড বেশি। এ যাবৎ প্রায় ৮০টি এনকাউন্টার রয়েছে তাঁর নামের পাশে। তবে সেটা সরকারি হিসেব। কিছুদিন আগে অভিনেতা গোবিন্দার পায়ে নিজের সার্ভিস রিভলবার থেকে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে, অনেকেরই হয়তো মনে আছে। জখম হন অভিনেতা। সেই ঘটনারও তদন্তে ছিলেন দয়া। সলমন খানের বাড়িতে গুলি চালানোর ঘটনায় তিনিই তদন্তে নামেন।
২০০৪ সালের বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘আব তক ছাপ্পান’ এই দয়া নায়েকের জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। যেখানে নানা পাটেকর মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। তেলেগু সিনেমায় তৈরি হয়েছে ‘গোলিমার’, কন্নড় ভাষায় তৈরি হয়েছে ‘এনকাউন্টার দয়া নায়েক’। ২০১৫ সালে হিন্দি সিনেমা ‘আব তক ছাপ্পান ২’ রিলিজ করে। ২০১২ সালে তৈরি হয়েছে ‘ডিপার্টমেন্ট’, মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন সঞ্জয় দত্ত। দয়া নায়েক আসলে রূপকথার হিরো, যিনি জীবন্ত তবুও রূপকথার!
তাঁর কাজের ধরন নিয়ে অনেকে অনেক প্রশ্ন করেছেন। বহুবার বহু জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়েছেন, তবুও উনি ফলাফল এনেছেন। সেই যুগে যখন মোবাইল ফোন একটা আশ্চর্য বস্তু, তখন উনি বিরাট নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, যা ‘ফাইফ জি’-র থেকেও ভয়ংকর! কথিত আছে, ছোটা রাজনের গ্যাংকে একা হাতে শেষ করেছেন দয়া নায়েক। মুম্বইয়ের বেশ কিছু জায়গায় দাউদের নেটওয়ার্ক শেষ করেছেন। এছাড়াও রবি পূজারী এবং ভারত নেপালির গোষ্ঠীর ঘটনাও তিনি একা হাতে সামলেছেন।
বেশ কয়েকবার তাঁকে গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। দিনের পর দিন তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়েছিলেন, তবুও ফিরে এসেছেন। এবং কখনও পুলিশের চাকরি ছেড়ে যাননি। তাঁর পরিবারের তরফেও চাকরি ছাড়ার জন্য চাপ দেওয়া হলেও তিনি পুলিশের পোশাককেই বেছে নিয়েছেন। ২০০৬ সালে বেহিসেবি সম্পত্তি এবং অন্ধকার জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১২ সালে তিনি আবার ফিরে আসেন। কারণ, অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। প্রসঙ্গত, তাঁর সমসাময়িক এবং তাঁর সিনিয়র প্রায় সকল এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট অফিসার কেউই তাঁদের চাকরির সময়সীমা পর্যন্ত চাকরি করতে পারেননি। কেউ সুইসাইড করেছেন, আবার কেউ রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। আবার কেউ কোনও না কোনও অভিযোগে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, আবার কেউ যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা কাটছেন। কিন্তু একমাত্র দয়া নায়েক এখনও বহাল তবিয়তে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন পুলিশের পোশাকে।
আসলে তিনি জীবনকে ব্যালেন্স করতে জানেন। ওই যে প্রসেস-প্রক্রিয়া! তিনি সর্বদা রূপকথার হিরো হয়েও মাটিতে পা রেখে চলেছেন। নিজের শিকড়কে তিনি ভুলে যাননি। ভুলে যাননি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। নিজের গ্রামে একটা স্কুল তৈরি করে দিয়েছেন। রঙিন জীবনের প্রলোভন নয়, বরং খাকি পোশাক এবং বন্দুকই তাঁর জীবনের আদর্শ হয়েছে। জীবনকে সব পরিস্থিতিতে ব্যালেন্স করে নিয়েছেন, হাতের আস্তিন গুটিয়ে বলেছেন, ‘দেখে নেব সব রংবাজকে…’।
তথ্যসূত্র: ন্যাশানাল হেরাল্ড, হিন্দুস্তান টাইমস, মেনসওয়ার্ল্ড, মুম্বই পুলিশ
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….
পারথে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম হার। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৫০ রান করেও, ২৯৫ রানে জয় ভারতের। সেই জয়ের নেপথ্যে বুমরার অসামান্য বোলিং, বিরাটের ত্রিশতম টেস্ট সেঞ্চুরি ছাপিয়ে আলোচনায় বছর বাইশের যশস্বীর দুরন্ত পারফরম্যান্স। ক্রিকেট ও ক্রিকেটের বাইরে তাঁর অনমনীয় লড়াই নিয়ে দু’-চার কথা।
পারথে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম হার। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৫০ রান করেও, ২৯৫ রানে জয় ভারতের। সেই জয়ের নেপথ্যে বুমরার অসামান্য বোলিং, বিরাটের ত্রিশতম টেস্ট সেঞ্চুরি ছাপিয়ে আলোচনায় বছর বাইশের যশস্বীর দুরন্ত পারফরম্যান্স। ক্রিকেট ও ক্রিকেটের বাইরে তাঁর অনমনীয় লড়াই নিয়ে দু’-চার কথা।