২২ জানুয়ারি ২০২৫, গাজ়ার কবি-লেখক মোশাব আবু তোহা দুনিয়াবাসী সমীপে প্রেরণ করেন এক খোলাচিঠি। জানান তাতে: ২০১৭-র বসন্তে উত্তর গাজ়ার বেইতুন লেহিয়াম শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি গাজ়ার প্রথম ইংরেজি বইয়ের পাঠাগার; পরে, সেপ্টেম্বর ’১৯-এ খোলেন তার আরেক শাখা গাজ়া বন্দর-নগরে; ইজরায়েল সরকারের প্যালেস্তিনিয়ান-বিলোপ-অভিযানে পুড়ে খাক, বিলকুল ধুয়েমুছে গেছে ভুষ্টিনাশের স্মারক ও দুই সংগ্রহ। এতে নিশ্চয় রয়েছে করুণ এক রঙ্গের ইশারাও: নষ্ট ও জোড়া পুস্তকাগার যাঁর নামে অলংকৃত ছিল, তিনি কে? না, জেরুসালেম-এ জাত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্যালেস্তিনিয়ান পক্ষের বুদ্ধিজীবী লড়াকু; যুক্তরাষ্ট্রের কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক; পশ্চিম গোলার্ধের সারস্বতসমাজ যে কায়দায় পূর্ব গোলার্ধকে জরিপ-অবলোকন ও উপস্থাপনে অভ্যস্ত তার কঠোর সমালোচক; ভুবনবিশ্রুত ‘ওরিয়েন্টালিসিম’ (১৯৭৮) বইয়ের রচয়িতা, এডওয়ার্ড সাইদ (১৯৩৫-২০০৩)।
১৯ জানুয়ারি ২০২৫: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী বাইডেন প্রশাসনের ক্ষমতা হস্তান্তরের আগের দিন–স্থগিত হয় ইজরায়েল বনাম গাজ়া যুদ্ধ; টানা পনেরো মাস গাজ়ার ওপর ইজরায়েলের আকছার বোমবর্ষণে পড়ে সাময়িক ছেদ।
২০ জানুয়ারি ২০২৫: মাঝখানে ছিল চার বছরের নিষ্কৃতি– ৫ নভেম্বর ২০২৪-এ্রর সাধারণ নির্বাচনে জিতে, ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা জো বাইডেন স্থলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে পুনঃসমাসীন রিপাবলিকান পার্টির সর্বেসর্বা ডোনাল্ড জন ট্রাম্প।
১.
শপথ-গ্রহণ সাঙ্গ হতে না হতে, অভিষেকের শুভলগনেই, গাদাগুচ্ছের শাসনিক হুকুমনামায় পটাপট সই করে সাড়ম্বরে জানিয়ে দেন ট্রাম্প, ২০১৭ থেকে ২০২১, তাঁর প্রজাপালনের প্রথম পর্বের চেয়েও ঢের ঢের বেশি তুলকালামি, এমনকী, সাংবিধানিক ধরাবাঁধায় বেতোয়াক্কা হবে দুয়ের দফা। শুধু জানুয়ারি ’২৫-এই, মাত্র এক ডজন দিবসে যা-সকল খেল দেখিয়েছেন ট্রাম্প, তাঁদের রাজকীয় মাপমাত্রায় স্তম্ভিত, শিহরিত না হয়ে জো নেই।
চিরটাকালই অভিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর মহাখাপ্পা ডোনাল্ড– বছর-বছর ধরে, পই পই করে বুঝিয়েছেন তিনি তাঁর সহনাগরিক সমবায়কে, বিশেষ তার দরিদ্রাংশকে, তাদের যত যা দুর্দশা, দুঃখকষ্ট, তার জন্য প্রধানত দায়ী পরিযায়ী পরদেশিরা। কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত টপকে, মেক্সিকো পেরিয়ে, দিন পর দিন, পিলপিলিয়ে আসে লাতিন আমেরিকার যত রাজ্যের দুর্বৃত্ত– ওই গুন্ডা-বদমাশ, খুনে বজ্জাতরা কি সাংঘাতিক সব মাদক, নেশাদ্রব্যের পোষক-প্রেষক নয়, তারা কি ধর্ষণে-ধর্ষণে মার্কিন মেয়েদের উজাড়ে কৃতসংকল্প নয়, তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরাই কি ছিনিয়ে নিচ্ছে না খেতখামার, মাংসমোড়কের কারখানা, রেস্তোরা-বিপণি ইত্যাদিতে গায়েগতরে খেটে-খাওয়া সাচ্চা মার্কিনদের চাকরিবাকরির ন্যায্য হক? কেবল লাতিনি দুরাত্মারা কেন, মার্কিন মুলুকের সমৃদ্ধিতে ঈর্ষাকাতর, পৃথিবীর কোন্ কোণ থেকে সোনায় মোড়া সে দেশে ঢোকে না, ঢুকতে চায় না রবাহূত রদ্দি, আদেখলা হ্যাংলাদের দল– ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের হাইতি বলো, আফ্রিকার নানা মড়াখেগো বুভুক্ষু অঞ্চল বলো, প্রযুক্তিবিদ্যায় খানিকসানিক সড়গড় ইন্ডিয়া-চায়না বলো, হেথা-সেথার জাত-খতরনাক মুসলিম বলো, কোত্থেকে না হামলে পড়ে পাল-পাল অবাঞ্ছিতরা মার্কিন স্বপ্নধামে, স্বপ্নভঙ্গে নাজেহাল করে ছাড়ে খ্রিস্ট-শরণাপন্ন স্বদেশি দুঃস্থদের। ট্রাম্পের প্রবোধ তাই: যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের গরিবগুরবোদের ভেতর মুখ্যত শ্বেতচর্মধারীগণের আর্থিক দুর্গতি, মানসিক বৈকল্য, স্বাস্থ্যগত বিপত্তির মূল কারণ দেশান্তরী হাওয়ায় ভেসে-আসা কালা-হলদে-বাদামি লোকপোক, অতএব, বহিরাগতদের ডালেমূলে বিতাড়ন এবং সম্ভাব্য প্রবেশপথে পুলিশ-চৌকি, কাঁটাতারের ঢ্যাঁড়া মারলেই চোকে তাবৎ গোল। এই মহোদ্দেশ্যেই তো প্রথমবার প্রেসিডেন্টের তক্তে আরোহণের এক হপ্তার মাথায়, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ডোনাল্ড জারি করেছিলেন ইরান-ইরাক-লিবিয়া-সোমালিয়া-সুদান-সিরিয়া-ইয়েমান সাত মুসলিমপ্রধান দেশের বাসিন্দাদের ওপর মার্কিন মাটিতে চারণ-বিচরণের নিষেধাজ্ঞা। আদালতি ধস্তাধস্তিতে ভেস্তে গেলেও তাঁর সাধের ‘মুসলিম ব্যান’, গদি ছাড়ার মাস এক আগ ৩১ জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের শ্বেতপ্রাসাদ থেকে নানাবিধ ফরমান-চাউরে চালিয়ে গেসলেন ট্রাম্প, প্রাণান্ত তাঁর মুসলিম-নিবারণী প্রয়াস। ২০২৪-এর জয়ের পর তাঁকে আর পোয়াতে হবে না চুনাব-চুনৌতির হ্যাপা– যদি না অবশ্য, দু’বারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৪৭ সালে গৃহীত সাংবিধানিক ও সংশোধনীখানিই উপড়ে ফেলেন তিনি; সুতরাং, ৭৮ বৎসর বয়স্ক ট্রাম্প ২.০ দুর্দম বেপরোয়া এখন।
জিদ্দি তিনি, অকুতোভয় তিনি, পুরুষালি নৃশংসতাই জীবনবেদ ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প-এর– এই সাদা সত্যের সদম্ভ প্রদর্শ-বাসনায়, ২২ জানুয়ারি ’২৫ থেকে লাগু হয়েছে, সমাজ-মাধ্যমের নিমন্ত্রিত প্রতিনিধি ও টিভি ক্যামেরার খোলা-লেন্স সামনেই, ‘অ-নথিভুক্ত’ অভিবাসীদের বেলাগাম ধরপাকড়; বাড়ি-স্কুল-চার্চ-রাস্তা, যত্রতত্র অচানক গ্রেপ্তার হচ্ছে ‘অপরাধী’রা; এখনও অবধি বেড়ি-শেকলে বেঁধে একেবারে সেনাবাহিনীর বিমানে চড়িয়ে ফেরতযোগ্য দ্রব্য ন্যায় তাদের বেশ ক’জনকে চালান করা হয়েছে লাতিন আমেরিকার কলোম্বিয়ায়। পাছে নিন্দুকরা কুৎসা রটায় যে তাঁর প্রথম টার্মে অভিপ্রয়াণ-নিকাশি যা ব্যবস্থা গড়েছিলেন ট্রাম্প, তাতে এমনকী দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরও তাদের মা-বাপের কোল থেকে কেড়ে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ঘটানো হয়েছিল, এবার তাই কচিকাঁচা সমেতই আপদগুলিনকে বিদেয় করা হচ্ছে। মুশকিল কেবল, ‘অনথিভুক্ত’ কোঠায় যেমন আছে চোরাগোপ্তা, বেআইনিভাবে প্রবিষ্ট অভিবাসী, তেমনই আছে কানুনি পন্থায় আগত অভিবাসী। দুয়ের ভাগের মানুষজন তারাই যাদের যুক্তরাষ্ট্রে রওয়ার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে; গেলেও, তাদের জন্য আছে বসবাসের অনুমোদনপত্র নবীকরণের সুযোগ। তর সওয়ার সময় নেই ট্রাম্পের; নেই অতএব প্রেসিডেন্টের লোকলস্করের বাছাই-ঝাড়াইয়ের অবসরও– এ-তক্ যত অভিবাসীকে কুলোর বাতাসে খেদানো হয়েছে, সেই ত্রাসতাড়িত জনতার অধিকাংশেরই আছে সরকারি প্রত্যর্পণে উদ্বাস্তু না-হওয়ার বৈধ অধিকার।
কিন্তু, কেবল কি সাততাড়াতাড়ি স্বগৃহ সাফসুতরো করার উদ্যোগেই নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন ট্রাম্প? নেই তাঁর পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের দায়িত্ব, নেই তাঁর বৃষস্কন্ধে ভিনদেশসমূহের হালহকিকত বিষয়ে মাথা ঘামানোর গুরুভার? আছে বলেই তো ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবারের বারবেলায়, ঘোষণা করলেন ডোনাল্ড: বিশ্বের ঘনতম বসতির অন্যতম, ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারের গাজ়ায় নিবসিত লগভগ ২১ লাখ প্যালেস্তিনিয়ানরা নিক অভিবাসনের প্রব্রজ্যা; হলেও ছোট্টখাট্টো, ভূমধ্যসাগরের কোল-ঘেঁষা গাজ়া-ফালা যে ভূসম্পত্তি, ‘রিয়েল এস্টেট’ ব্যবসাপাতির, নানাবিধ নির্মাণ প্রকল্পের পক্ষে দারুণ প্রশস্ত, খুবই লাভদায়ক; কাজে গাজ়া ফালাখানি গোটাগুটি ফাঁকা করে ওখানকার মহামেডানরা প্রতিবেশী জর্ডন-মিশরে পাতলে সংসার, সবারই পোয়া বারো। ‘রিলিজন’-এর নিরিখে, গাজ়ার অধিবাসীদের ৯৯% মুসলিম, যাদের আদ্দেক আবার আঠেরো বছর বয়সের কম। উচ্ছেদের রামধাক্কায় গাজ়ায় প্যালেস্তিনিয়ানদের ঝাড়েবংশে সাফাই, ‘এথনিক ক্লিনসিং’-এর ট্রাম্প-প্রস্তাবে জর্ডন বা মিশর এখনও অরাজি। তবে, অন্যান্য সার্বভৌম রাষ্ট্র থেকে আমদানি-করা পণ্যের ওপর শুল্ক চাপিয়ে তাদের অলৌকিক কোন্ আয়করে-করে জেরবার করে মার্কিন ধনভাণ্ডার উপচে ফেলার যে উদভুট্টে বায়না ধরেছেন ট্রাম্প, যে-হারে দিগ্বিদিকে অনর্থময় হুমকি ঝাড়ছেন, তার জেরে ভবিষ্যতে কী না হতে পারে।
২.
৭ অক্টোবর ২০২৩-এ, গাজ়ার কর্তাবর্গ ‘হামাস’-এর জঙ্গিবাহিনীর ইজরায়েল সীমান্তে অকস্মাৎ হামলায় ১১৯৫ ইহুদির পাশবিক হত্যা ও ২৫১ জনের হরণের প্রত্যুত্তরে ১৩ অক্টোবর গাজ়ায় প্রবেশ করে ইজরায়েল এবং ২৭ অক্টোবর ’২৩ থেকে ‘হামাস’ নিকাশ-বিনাশ লক্ষ্যে লেগে পড়ে ধুন্ধুমার সমরে। পনেরো মাসে, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫-এর রণবিরতি অবধি, ইজরায়েলি ফৌজের উপার্জন: ৪৬০০০ মতো প্যালেস্তিনিয়ানের প্রাণ, ৭০% যার নারী ও শিশু। নারকীয় এ হননকাণ্ডে, গোড়া থেকে শেষ, ইজরায়েল সরকারের পাশটিতে ছিল মার্কিন সরকার– যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ, এমনকী প্রয়োজনাতিরিক্ত সামরিক সহকার বই, ইজরায়েলের চব্বিশ-ঘন্টা-প্রস্তুত, দুর্দান্ত প্রশিক্ষিত, অতি-সুপটু সেনাদেরও অত বড় মারণযজ্ঞ সম্পন্ন করা সাধ্য হত না।
১৯৯৭ সালে ডেমোক্র্যাট সেনেটর প্যাট্রিক লেহি এই মর্মে এনেছিলেন বিল, কোনও বিদেশি সরকারের যে-সমস্ত ‘নিরাপত্তা ঘাঁটি’ মানবাধিকার খর্ব দোষে দুষ্ট হবে, তাদের আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তর অস্ত্রশস্ত্র জোগাবে না এবং ২০১১-য় ‘লেহি সংশোধন’কে মার্কিন কংগ্রেস ‘বিদেশ সহায়তা বিধান’ নামে আইনি মর্যাদা প্রদায়। মানবাধিকার-লঙ্ঘনের প্রশ্নে ‘লেহি ল’-এর এক্তিয়ার সার্বিক নয়, সীমিত– তা কেবল কোনও ‘নিরাপত্তা ঘাঁটি’-র বাড়াবাড়ির বেলাতেই প্রযোজ্য। তাও তা বিভিন্ন সময়ে আরোপিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বোলিভিয়া, কলোম্বিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ প্রভৃতির ওপর; কিন্তু, পশ্চিম এশিয়ায় যতই কদর্য কাণ্ড ঘটাক ইজরায়েলের ঘাঁটি-ফাঁড়ি, ইজরায়েলকে কদাচ ঘাঁটায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ-পর্যায়েও এর অন্যথা হয়নি। অক্টোবর ২০২৩ থেকে অক্টোবর ২০২৪, কেবলমাত্র বারো মাসে, জো বাইডেন-এর ডেমোক্র্যাট সরকার ইজরায়েলকে দয়াদাতব্য করেছে ১৭.৯ লক্ষ-কোটি ডলার মূল্য-সমান মারণযন্ত্র, যা কিনা বার্ষিক দানখয়রাতের অঙ্কে রেকর্ড। গাজ়ায় বেসামরিক নাগরিকদের যথেচ্ছ খুন-জখমের পরিপ্রেক্ষিতে, নির্দল বামপন্থী সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স-এর নেতৃত্বে বেশ কয়েক ডেমোক্র্যাট সাংসদ ইজরায়েলকে ‘বিদেশ সহায়তা বিধান’-এর শর্তভঙ্গ করার বদামিতে দায়িক ঠাওরালেও, জো বাইডেন ছিলেন অবিচল। এতে যা পরিষ্কারত বিঘ্নিত হয় তা হল প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েল পৃথক দুই রাষ্ট্র পত্তনের সম্ভাবনা। ট্র্যাম্পের ‘গাজ়া ছোড়ো’ নারায় গোটা-গোটা বানচাল সে খোয়াব– সুগম বরং ইজরায়েল-মুখে প্যালেস্তাইন-গ্রাসের রাহা।
৩.
পনেরো মাস ধরে, সময়াসময় নেই, ইজরায়েলি বোমারুর আশমানি গরজানিতে অনন্তর কেঁপেছে উত্তর গাজ়ার আকাশ; ফলে, হাজারে-হাজারে মরিয়া পাগলপারা মানুষ সরে-সরে গেছিল গাজ়ার দক্ষিণপ্রান্তে। সেখানেও অবশ্য ইজরায়েলি বোমাবোমি, বন্দুক-ওঁচানো সেনানীদের গুঁতোগুঁতি, খানাখারাবের কমতি ছিল না। ১৯ জানুয়ারি ’২৫-এ নামে কী নামে না টলোমলো বিপজ্জনক শান্তি, পরদিনই সাতসকালে শুরু হয় পশ্চিমের অনিকেত গাজ়ানদের হারানো ঘরে প্রত্যাবর্তনের প্রবাহ। সে এক আজব চলৎছবি: পথে-পথে এর খুনে যাযাবরি ওর লাশ; মোড়ে-মোড়ে মানুষের বাস্তুবিজ্ঞানের পরম নজির– বাসা গুঁড়ো, পোড়া শবে স্তূপ, সমাধি প্রচুর; সম্বলে শূন্য পলাতকেরা ফিরছে কাতারে-কাতারে মাটিতে অবলিপ্ত, লুপ্ত তাদের ডেরায়; ধ্বংস থেকে ধ্বংসে ধ্রুব গাজ়ান পদযাত্রা।
৪.
সমূহ ও তছনছে ইশকুল-হাসপাতাল-প্রার্থনাস্থল সহ গ্রন্থগৃহও যে ছাড় যাবে না, তা বলা বাহুল্য। ২২ জানুয়ারি ২০২৫, গাজ়ার কবি-লেখক মোশাব আবু তোহা দুনিয়াবাসী সমীপে প্রেরণ করেন এক খোলাচিঠি। জানান তাতে: ২০১৭-র বসন্তে উত্তর গাজ়ার বেইতুন লেহিয়াম শহরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি গাজ়ার প্রথম ইংরেজি বইয়ের পাঠাগার; পরে, সেপ্টেম্বর ’১৯-এ খোলেন তার আরেক শাখা গাজ়া বন্দর-নগরে; ইজরায়েল সরকারের প্যালেস্তিনিয়ান-বিলোপ-অভিযানে পুড়ে খাক, বিলকুল ধুয়েমুছে গেছে ভুষ্টিনাশের স্মারক ও দুই সংগ্রহ। এতে নিশ্চয় রয়েছে করুণ এক রঙ্গের ইশারাও: নষ্ট ও জোড়া পুস্তকাগার যাঁর নামে অলংকৃত ছিল, তিনি কে? না, জেরুসালেম-এ জাত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্যালেস্তিনিয়ান পক্ষের বুদ্ধিজীবী লড়াকু; যুক্তরাষ্ট্রের কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক; পশ্চিম গোলার্ধের সারস্বতসমাজ যে কায়দায় পূর্ব গোলার্ধকে জরিপ-অবলোকন ও উপস্থাপনে অভ্যস্ত তার কঠোর সমালোচক; ভুবনবিশ্রুত ‘ওরিয়েন্টালিসিম’ (১৯৭৮) বইয়ের রচয়িতা, এডওয়ার্ড সাইদ (১৯৩৫-২০০৩)।
৫.
১৯৯৩ পর্যন্ত সাইদ ছিলেন ‘প্যালেস্তিনিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল’-এর সদস্য। সে-সময় তাঁর অভিমত ছিল, এই যে দিনানুদিনের ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাত, মাঝেসাঝেই আরক্ত সংঘর্ষ, সমাধান এ ঝঞ্জাটের, স্বতন্ত্র দুই রাষ্ট্র– মুসলিম-ইহুদি সহাবস্থান অসহ্য যখন মঙ্গল তখন দু’-তরফের পূর্ণবিচ্ছেদে। ১৯৯৯ নাগাদ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায় সাইদ-এর অবস্থান; তাঁর বক্তব্য হয় তখন, পশ্চিম এশিয়ায় শান্তিস্থাপনের একক উপায়, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যৌগিক রাষ্ট্রের সংস্থাপন।
দূরের দৃষ্টি যাঁদের আবছা, তাঁদের মনে হতেই পারে, কোথাকার কোন্ ‘প্যালেস্তাইন-সমস্যা’র সঙ্গে স্বাধীনতা-পূর্ব ঘরোয়া ‘ভারত-সমস্যা’র তিলটুকু সংস্রব ছিল না, থাকতেই পারে না। ঘটনা কিন্তু অন্যরূপ। আদতে, প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইহুদি-মুসলমান দ্বৈরথ মেটাতে যা-সব প্রকল্প দাখিল হয়েছে, এখনও হচ্ছে, তাদের সঙ্গে অবিভক্ত ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিষমতার কাটানে পেশ-করা বিসম্বাদী নানা সমাধানের ভালোই আত্মীয়তা আছে।
১৪ মে, ১৯৪৮: গ্রেট ব্রিটেনের তত্ত্বাবধানে ‘ইজরায়েল’ নামক স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা– এদ্দরুন বহু সংখ্যক প্যালেস্তিনিয়ান ঘরদোর ফেলে চলে যেতে বাধ্য হন ভূমধ্যসাগর পাড়ে, ঠাঁই নেন গাজ়ায়, বাস্তুহীনদের খাতির-জন্য গাড়া শিবিরে-শিবিরে। এর উনিশ বছর আগে, ২৩-২৯ অগস্ট ১৯২৯, জেরুসালেম-সহ অন্যান্য শহরে বাধে ইহুদি-মুসলিম তুমুল দাঙ্গা। মাস না গড়াতেই, ২২ সেপ্টেম্বর ’২৯, কলকাতার ‘টাউন হলে’ বসে জনবৈঠক– কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘আল-মুসলিম’ মাসিকে মুদ্রিত ‘ফলস্তিন সমস্যা’ প্রতিবেদন অনুসারে, ‘আরব-ইহুদী সংঘর্ষের প্রতিবাদকল্পে বিরাট সভা’। ওই জমায়েতের পৌরোহিত্যে ছিলেন, ‘মুসলিম লীগ’-এর প্রথম সারির নেতা, ‘নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি’র প্রধান, স্যর আবদুর রহিম (১৮৬৭-১৯৫২)। উক্ত সভায় প্রদত্ত তাঁর ইংরেজি অভিভাষণের বঙ্গানুবাদ বেরয় ‘আল-মুসলিম’-এ। তাত্থেকে স্পষ্ট, স্যর আবদুর-এর পরামর্শ ছিল: প্যালেস্তাইনে যুধুমান দু-গোষ্ঠি মধ্যে ‘ভীষণ রক্ত-প্রতিযোগিতা’ হতে ভালো ক’রে শিক্ষা নিক ‘ভারতের মুসলমান’। ‘পর-কীর্ত্তি অসহিষ্ণু ইউরোপ’ ও ইউরোপয়ীনদের ‘ধর্ম্মগত অন্ধ গোঁড়ামী’র বিরুদ্ধ কম ধিক্কার ছিল না আবদুর রহিমের বক্তৃতায়; কিন্তু, তিনিই ডিসেম্বর ১৯২৫-জানুয়ারি ১৯২৬-এ আলিগড়ে অনুষ্ঠিত ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’-এর সপ্তদশ সমাবেশে জোর গলায় জানিয়েছিলেন: ভারতে হাজার বছর পাশাপাশি বসবাস ক’রেও হিন্দু-মুসলমানে পার্থক্য-প্রভেদ এতই অতিকায়, এতই অমোচ্য, যে, দু’-সম্প্রদায়ের সংশ্লেষে অদ্বিতীয় এক নেশনের গঠন আকাশকুসুম জল্পনা।
৬.
উনিশ শতকের শেষাশেষি ইউরোপে দানা বাঁধে ‘জ়ায়োনিসম’ মতাদর্শ। জ়ায়োনবাদী দাবি ছিল, ইউরোপের এ-দেশে সে-দেশে ছড়ানো-ছিটোনো ইহুদিদের এককাট্টা করতে প্যালেস্তাইনের ঔপনিবেশিকরণ মারফত স্থাপিত হোক সেথায় স্রেফ ইহুদি-জন্য বাসভূমি। এই বিশ্বাসের অনুগামী ‘দ্য জুইশ স্ট্যান্ডার্ড’ সাক্ষাৎকার নেন রবীন্দ্রনাথের ২৮ নভেম্বর ১৯৩০-এ। কাগজের সাক্ষাৎপ্রার্থী রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করান প্যালেস্তাইনে অগস্ট ’২৯-এর হাঙ্গাম-ফ্যাসাদের কথা। বলেন ‘দ্য জুইশ স্ট্যান্ডার্ড’-এর মুখপাত্র: হাজার বছর দুই হল তাদের পুণ্যভূম প্রাচীন ইজরায়েল থেকে উচ্ছিন্ন ইহুদিগণ; নির্বাসিতের যাপন-যন্ত্রণায় ভবঘুরেরা কেবলই হয়েছে দ্বিসত্তায় বিশ্লিষ্ট; যেখানেই থিতু হয়েছে তারা সেখানকার রীত-রেওয়াজের অংশত বশে এসে আপসে-আপসে আত্মখণ্ডিত হয়েছে ভাগ্যহতরা; ইহুদি জাতীয়তাবাদীরা আজ ফিরে পেতে চায় তাদের বিশুদ্ধ সত্তা; জ়ায়োনবাদীরা তাই চায় না যে, ইহুদিদের সাপেক্ষে প্যালেস্তাইনও হোক আমেরিকা বা ফ্রান্স বা জার্মানির আরেক সংস্করণ; এ-কারণেই কাম্য তাদের আরব-নির্মূল ইজরায়েল। এসব শ্রবণ পরও জাতীয়তাবাদের কলুষ সম্পর্কে তাঁর আপত্তিতে অনড় রবীন্দ্রনাথ। তাঁরই জবানিতে, ‘জ়ায়োনিসম’ বিষয়ে তিনি এবং তাঁর বন্ধু এলবার্ট আইনস্টাইন সহমত। তবু, পীড়িত, অবমানিত ইহুদি জনগণের সমব্যথী হয়েও, তাদের দুর্গ্রহমোচনে পাতিত হোক আরবেরা, বদলাবদলির এ কূটকুটিল নীতিতে সামান্যতম সায় নেই তাঁর। রবীন্দ্রনাথের ফয়সালা তাই: আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমঅধিকারে আরব ও ইহুদিরা একসঙ্গে রইলে তবেই দুই জাতির আত্মবিকাশের পথ মসৃণ হবে; অধ্যাত্মগত বৈভিন্ন্যের স্বাস্থ্যকর স্ফুরণের প্রাকশর্তই যে ঐহিক ঐক্য।
অগস্ট ১৯২৯-এ জেরুসালেম ও অন্যত্র ইহুদি-আরব মারামারি-কাটাকাটিকে ঘিরে প্রায় একই সময় স্যর আবদুর রহিম ও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধ-বক্তব্যই যেন প্রতিফলিত ‘প্যালেস্তাইন সমস্যা’ নিরাকরণ নিয়ে এডওয়ার্ড সাইদ-এর অবস্থানান্তরে: এককালে রহিম-প্রতিম চূড়ান্ত ব্যবধানের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি; পরে, রবীন্দ্র-প্রতিম সহবাসে মিতালি-মিলনের।
এতদিন প্রধান পরিপ্রশ্ন ছিল, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন আলাদা দুই রাষ্ট্র হবে নাকি একই রাষ্ট্রে সাঙ্গীকৃত হবে। আর, এই ছিল তার উত্তরপট: স্যর আবদুর রহিম, ‘দ্য জুইশ স্ট্যান্ডার্ড’-এর সাংবাদিক গোছের লোকেরা বিচ্ছেদপন্থী; রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন ধরনের আদর্শবাদীরা সমন্বয়পন্থী; আর এডওয়ার্ড সাইদ-তুল্য ভাবুকেরা দোদুল্যমান।
এখন কিন্তু, এই ২০২৫-এ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রেসিডেন্ট, অধীশ্বরই একরকম, ডোনাল্ড জন ট্রাম্প-এর গগন-কাঁপানে হুহুংকারে বোধ হচ্ছে আগের সমস্ত সমাধান-প্রস্তাবই চেস্তেভেস্তে যাবে। ব্যাপার দাঁড়াবে: অজস্র হাতিয়ার সত্ত্বেও সংযমে সংবৃত রইল ইজরায়েল, নিবৃত্তিপরায়ণ অনাসক্ত ন্যায় ঘরছোড় বিবাগী হল গাজ়ার জনগণ, যুদ্ধ-অবসানে বিনা রক্তপাতে প্যালেস্তানিয়ানে শূন্য হল প্যালেস্তাইন।
আপাতত সবুর করা যাক– দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়…
পুনশ্চ: ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে উদাত্ত ঘোষণা ট্রাম্প বাহাদুরের: গাজ়ার অধিবাসীরা ভালোমানুষের মতো নতশিরে মানলে তো ভালো, নইলে, সমরাস্ত্রমণ্ডিত যুক্তরাষ্ট্রই সবলে তাদের, শুধু জর্ডন-মিশর কেন, যেখানে চাই উৎপাটিত করে দেবে; ততঃপর, ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ নিজ পতাকা গাড়বে গাজ়ায়; অন্তে, ম্যারিকার শান্তিময় পূর্ণ-দখলদারিতে– নিশ্চয়ই, ‘রিয়েল এস্টেট’-বিশেষজ্ঞ ট্রাম্পের দক্ষ পরিচালনায় ও বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি ইলন মাস্ক জ্যায়সা অর্বুদ-নিযুতপতিদের সুখবিধায়, সুস্বাস্থ্যবিধায়– ভূমধ্যসাগরীয় গাজ়াকে রূপান্তরিত করা হবে রম্য পর্যটনকেন্দ্রে।
কৃতজ্ঞতা: আত্মজিৎ মুখোপাধ্যায়, বিজলীরাজ পাত্র, অঙ্কন ঘোড়ই