প্রার্থনা পূরণ না হলে ভগবানের ‘বিচার’? হ্যাঁ, তেমনও হয়। হয় এ দেশেই। অন্যায় করলে যেমন আদালতে মানুষের বিচার হয়, তেমনই বিচারের জন্য কাঠগড়ায় উঠতে হয় স্বয়ং ‘সর্বশক্তিমান’-কেও। বিচারে দোষ প্রমাণ হলে থাকে শাস্তির নিদানও। ছত্তিশগড়ের বস্তার অঞ্চলে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই অদ্ভুত প্রথা।
‘বাবা তারকনাথ’ ছবির সেই জনপ্রিয় গান ‘আজ তোমার পরীক্ষা ভগবান/ তুমি পাথর নাকি প্রাণ ভগবান/ তুমি আছ কিনা কর তা প্রমাণ’, মনে পড়ে?
ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে গোটা বিশ্বেই দ্বন্দ্ব অহর্নিশ, সেই তর্ক-বিতর্ক নিরন্তর চলছে। অনেকে মনে করেন, মানুষের বিশ্বাসেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব। সৃষ্টির শুরুতে প্রকৃতির সামনে অসহায় মানুষ অজানা শক্তিকে বোঝার জন্য ‘ঈশ্বর’ নামক অতিশক্তির কল্পনা করেছিল। ঝড়-বৃষ্টি, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জীবনপথের চড়াই-উতরাই, নানা বাধা-বিপত্তি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের। উত্তরাধিকারসূত্রে এই ধ্যানধারণা মানুষের মধ্যে চলে আসছে সেই আদিকাল থেকে। অর্থাৎ, ‘মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে করে দেব মহিমা নির্ভর’। এবং তাদের চাওয়া-পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় ভগবানের জনপ্রিয়তা। অর্থাৎ, কোন থানে বা পীঠের দেবতা বেশি জাগ্রত, কার কাছে প্রার্থনা করলে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলে, তা-ই হয় মানুষের বিবেচ্য। সেই অনুপাতে ভিড় জমে কোনও মন্দিরে বা মাজারে।
এবং ভগবানকেও তাই ‘পরীক্ষা’য় বসতে হয়। ভক্তির নিক্তিতে ঈশ্বরের উপাসনা তো আছেই। রয়েছে ভক্তের নানা প্রকারভেদ। কেউ করেন সমর্পণ। নিজের সত্তাকে। সেখানে ভগবান আরাধ্য। কারও কাছে ভগবান সন্তানতুল্য, কারও কাছে প্রেমিক। কারও কাছে পিতামাতা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেপথ্যে থাকে প্রার্থনা। কেউ চান জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধি-ঐশ্বর্য। কারও প্রার্থনা নিকটজনের সুস্থতা। আবার অনেকেই চান ‘মুক্তি’। সব চাওয়ার পিছনেই এই ‘লেনদেন’ নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ, ভক্তের প্রার্থনার বিনিময়ে আরাধ্য দেবতা মনোবাসনা পূরণ করবেন, এমনটাই কাঙ্ক্ষিত বলে মনে করা হয়। আর যদি তা পূরণ না হয়? কমতে থাকে সেই ভগবানের ‘জনপ্রিয়তা’।
কিন্তু প্রার্থনা পূরণ না হলে ভগবানের ‘বিচার’? হ্যাঁ, তেমনও হয়। হয় এ দেশেই। অন্যায় করলে যেমন আদালতে মানুষের বিচার হয়, তেমনই বিচারের জন্য কাঠগড়ায় উঠতে হয় স্বয়ং ‘সর্বশক্তিমান’-কেও। বিচারে দোষ প্রমাণ হলে থাকে শাস্তির নিদানও। ছত্তিশগড়ের বস্তার অঞ্চলে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই অদ্ভুত প্রথা। যে এলাকায় প্রায়শই জনতাকে নিয়ে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ বসিয়ে মানুষকে প্রাণদণ্ড দেওয়ার জন্য খবরের শিরোনামে এসেছে। তার নেপথ্যে থাকতেন মাওবাদীরা। আর এই বিচারব্যবস্থায় ‘বাদী’ স্থানীয় সাধারণ আদিবাসী মানুষ। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন গোন্দ, মারিয়া, ভাতরা, ধুরওয়া উপজাতিরা। যাঁরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তাঁদের লোকসংস্কৃতি বস্তারের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই প্রথা মেনেই প্রতি বছর বর্ষাকালে স্থানীয় ভাঙারামদেবী মন্দির চত্বরে বসে জনতার আদালত। ওই সময়ে তিন দিন ধরে হয় ‘ভাদো যাত্রা।’ সেখানেই চলে দেবতার বিচার।
তিনদিনের এই উৎসবে বিচারকের আসনে থাকেন ভাঙারামদেবী। কাঠগড়ায় উঠতে হয় দেবদেবীদের। সেখানে আইনজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন জনজাতি গোষ্ঠীগুলির নেতৃত্ব। বিচারপর্বে বিভিন্ন পশুপাখি, বিশেষত মুরগিকে সাক্ষী হিসাবে হাজির করানো হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ হয়ে গেলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কোন কোন অপরাধের বিচার হয়? তালিকা লম্বা।
……………………………………………
এই বিচারব্যবস্থায় ‘বাদী’ স্থানীয় সাধারণ আদিবাসী মানুষ। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন গোন্দ, মারিয়া, ভাতরা, ধুরওয়া উপজাতিরা। যাঁরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তাঁদের লোকসংস্কৃতি বস্তারের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই প্রথা মেনেই প্রতি বছর বর্ষাকালে স্থানীয় ভাঙারামদেবী মন্দির চত্বরে বসে জনতার আদালত। ওই সময়ে তিন দিন ধরে হয় ‘ভাদো যাত্রা।’ সেখানেই চলে দেবতার বিচার।
……………………………………………
ঠিকমতো ফলন না হওয়া থেকে শুরু করে অসুখ না সারা, ভক্তদের প্রার্থনায় সাড়া না দেওয়া, অনেক কিছুই থাকতে পারে। আর শাস্তিও রীতিমতো ‘কড়া’। অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে শাস্তির পরিমাণ ধার্য করেন গ্রামবাসীরাই। কয়েকদিনের জেল, মন্দির থেকে নির্বাসন বা চিরনির্বাসনের মতো কঠিন শাস্তি ভোগ করেন ‘টোটেম’ নামে পরিচিত দেবতারা। তাঁদের ঠাঁই হয় মন্দিরের পিছনের খোলা ময়দানে, গাছের নিচে। কখনও ক্ষমা চেয়ে, কখনও সাজা খেটে তাঁরা ফিরে আসেন মন্দিরের ভিতরে। ২৪০ গাঁয়ের লোক জমায়েত হয়। রীতিমতো ভোজ বসে। যেকোনও সরকারি আদালতের মতো ঈশ্বরের বিচারসভারও একটি খাতা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এতে প্রতিটি মামলার বিবরণ তালিকাভুক্ত করে রাখেন গ্রামবাসীরা।
স্থানীয় উপজাতিদের বিশ্বাস, এই দেবতারা অনেকে আগে মানুষ ছিলেন। কালের যাত্রাপথে তাঁরা ‘ঈশ্বর’ হয়েছেন। যেমন হয়েছেন ‘ডাঃ খান’। তিনি নাকি এসেছিলেন নাগপুর থেকে। কলেরা, গুটিবসন্তের সময় আদিবাসীদের চিকিৎসা করেছিলেন। সময়ের ফেরে এখন তিনি ‘খান দেবতা’ বা ‘কানা ডাক্তার’ হিসেবে ভাঙারামদেবী মন্দিরেই ঠাঁই পেয়েছেন।
কিন্তু ‘দেবতার বিচার’ই বা কেন? স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, দেবতারাও ভক্তদের জন্য দায়বদ্ধ। তাঁদের কাজ, ভক্তকে রক্ষা করা, তাঁদের প্রার্থনা পূরণ করা। তাঁরা যদি সে কাজে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদেরও বিচার হওয়া উচিত। ভুল করলে ভক্ত যদি শাস্তি পেতে পারেন, তাহলে ঈশ্বরই বা বাদ যাবেন কেন? তিনিও বিচারের ঊর্ধ্বে নন। সলিল চৌধুরী যেমন লিখেছিলেন, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে… এই জনতা’।
মানুষের সমবেত শক্তির কাছে ম্লান হয়ে যায় ‘সর্বশক্তিমান’ও। বাস্তব জীবনে যাঁদের আমরা ‘দেবতা’র মর্যাদা দিই, শ্রদ্ধা-সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করি, তাঁদেরও তো নানা সময় ভুল হয়। অন্যায় করে ফেলেন। সেই শ্রদ্ধেয়, শক্তিশালী মানুষদেরও কোনও না কোনও সময় বিচারের সামনে দাঁড়াতে হবে। দেবতা ও মানুষ পরস্পরের পরিপূরক। মানুষের মনোবাসনা পূরণ করেন, তাঁদের রক্ষা করেন বলেই দেবতা পুজো পাওয়ার অধিকারী। সেই কর্তব্যে বিচ্যুত হলে তাঁরা যদি শাস্তি পেতে পারেন, তাহলে রক্তমাংসের ‘ক্ষমতাশালী’ মানুষ ব্যতিক্রম হবেন কেন?
……………………………………………………..
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: কী হবে যদি এই সসাগরা পৃথিবী পুরুষ-শূন্য হয়ে যায়?
……………………………………………………..
ভাঙারামদেবী মন্দিরে বিচারে কিন্তু শুধু শাস্তির কথা বলা হয় না। ব্যবস্থা রয়েছে সংশোধনেরও। দেবতারা যদি ভুল শুধরে নেন, ভক্তের প্রার্থনায় সাড়া দেন, তাহলে ফিরে পেতে পারেন নিজের আসন। তাঁদেরও অন্য আদালতের মতো ‘আপিল’ করার সুযোগ রয়েছে। যদিও শেষ সিদ্ধান্ত নেন ভাঙারামদেবী। এ-ও তো চিরন্তন মানবতার কথাই তুলে ধরছে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। সেই ভুল শুধরে প্রকৃত ‘মানুষ’ হয়ে ওঠাই জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। সবার উপরে মানুষ সত্য। স্বামী বিবেকানন্দও তাই বলেছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ২১ জ্যৈষ্ঠ হেমন্তবালা দেবীকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যেখানে মন্দিরের দেবতা মানুষের দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী, যেখানে দেবতার নামে মানুষ প্রবঞ্চিত, সেখানে আমার মন ধৈর্য্য মানে না।’ মানুষ বঞ্চিত, উপেক্ষিত ও ক্ষিপ্ত হলে দেবতারও বিচার করতে পারে। সেখানে ‘দেবতারূপী’ মানুষ তো কোন ছাড়।
.………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………………