গ্রন্থাগার ধ্বংস করার ট্র্যাডিশন চলেছে পৃথিবী জুড়েই। সেই ১৮৮০ সালেই মুদ্রক ও গ্রন্থপঞ্জি-নির্মাতা উইলিয়ম ব্লেডস প্রকাশ করেছিলেন ‘দ্য এনিমিজ অফ বুকস’ নামে একটি তামাম হিসেবপঞ্জি, সেখানে বইয়ের শত্রু হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা আছে, তার মধ্যে অবশ্যই আছে আগুন, জল, পোকা। কিন্তু সেই সঙ্গে একই তালিকাভুক্ত হয়েছে আরও দু’টি বইশত্রু– এক, বইয়ের বাঁধাইকর আর দুই, মূর্খলোকের দল! এই শত্রুরা আজও নিশ্চিতভাবেই আছে, কিন্তু এই সবের পাশে যাদের উল্লেখ নেই, সম্ভবত, তারাই সবচেয়ে বড় শত্রু– যুদ্ধবাজ মানুষ!
৭৫০ বছরের দীর্ঘ ব্যবধান দু’টি ঘটনার মধ্যে! তবু তাদের মধ্যে হুবহু সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক, ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকার ১৫ এপ্রিল, ২০০৩ তারিখে প্রকাশিত রিপোর্টে। কী সেই নিয়তির নির্বন্ধে বাঁধা কালের দু’-খণ্ড প্রতিনিধি?
প্রথম ঘটনার সময় ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ। চেঙ্গিস খানের পৌত্র আক্রমণ করেছিলেন বাগদাদ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, টাইগ্রিস নদীর জল নাকি সেদিন কালো হয়ে গিয়েছিল বইয়ের কালিতে! আর সে স্মৃতি আবার ফিরে এল ২০০৩ সালের ১৪ এপ্রিল, ইরাকের আকাশ যেদিন ঢেকে গেল কালো ছাইয়ে, প্রাচীন বইপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার ছাই! ইরাকের ওপর আমেরিকা আর ব্রিটেনের যৌথ এই আক্রমণে ন্যাশনাল মিউজিয়ামের ১,৭০,০০০টি প্রত্নসামগ্রী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি, মিনিস্ট্রি অফ রিলিজিয়াস এনডাওমেন্ট-এর লাইব্রেরি আর মোসুলের ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি– শুধু এই তিনটে লাইব্রেরি মিলিয়েই যে ঠিক কতগুলো বই নষ্ট হয়েছিল, তা আজও গণনার অতীত!
২০ বছর পর আবার একই ঘটনা ফিরে এল। ইজরায়েলি আক্রমণে গাজা শহরেই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেল একের পর এক গ্রন্থাগার। সম্প্রতি ‘Israeli Damage to Archives, Libraries, and Museums in Gaza, October 2023–January 2024’ নামে একটি প্রাথমিক রিপোর্টে, এই তিন মাসে ঠিক কতগুলো সাধারণ গ্রন্থাগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার আর মহাফেজখানা পুড়িয়ে ধ্বংস করা হল, তার একটা মোটের ওপর হিসেব পেশ করার চেষ্টা করা হয়। যদিও এই রিপোর্ট অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত এবং হিমশৈলের নিতান্তই চূড়ামাত্র। আল-রিমাল-এর ডায়ানা তাওয়ারি সাববাগ লাইব্রেরির ১০,০০০ বই এক মুহূর্তে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে! ধ্বংস করা হয়েছে গাজার আরও ৭টি সাধারণ গ্রন্থাগার, যার মধ্যে আছে এনাইম লাইব্রেরি, গাজা মিউনিসিপ্যালিটি লাইব্রেরি, লুববুদ লাইব্রেরি, আল নাহাদা লাইব্রেরি। বাদ যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারও– অন্তত চারটি এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কথা তো আছেই এই রিপোর্টে। এখানে উল্লেখ করি, ২০২৩-এর ১৯ অক্টোবর তারিখে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল আল-আজহার ইউনিভার্সিটির জওহরলাল নেহরু লাইব্রেরিও। ইজরায়েরি বিমান হানায় শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার লাগোয়া স্কুল, হসপিটাল, সাধারণ নাগরিকদের বাড়িঘর, মসজিদ, চার্চ– সবই ভস্মীভূত হয়ে যায়। এই রিপোর্টে আছে গাজা শহরের সেন্ট্রাল আর্কাইভসের কথা। যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি নিমেষে নষ্ট হয়ে গেছে সব।
……………………………………………
আল-রিমাল-এর ডায়ানা তাওয়ারি সাববাগ লাইব্রেরির ১০,০০০ বই একমুহূর্তে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে! ধ্বংস করা হয়েছে গাজার আরও ৭টি সাধারণ গ্রন্থাগার, যার মধ্যে আছে এনাইম লাইব্রেরি, গাজা মিউনিসিপ্যালিটি লাইব্রেরি, লুববুদ লাইব্রেরি, আল নাহাদা লাইব্রেরি। বাদ যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারও– অন্তত চারটি এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কথা তো আছেই এই রিপোর্টে। এখানে উল্লেখ করি, ২০২৩-এর ১৯ অক্টোবর তারিখে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল আল-আজহার ইউনিভার্সিটির জওহরলাল নেহরু লাইব্রেরিও।
……………………………………………
মোটামুটি এই একই সময়বৃত্তে ঘটে চলেছে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণ। ২০২২ সালে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইউক্রেন একটি সমীক্ষা চালায় এবং সমীক্ষার বিষয়, ‘ইউক্রেনিয়ান পাবলিক লাইব্রেরিজ ইন দ্য কনটেক্সট অফ রাশিয়ান আর্মড অ্যাগ্রেশন’। সমীক্ষায় দেখা গেল, এর মধ্যেই ২০০টি লাইব্রেরি সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং ৪০০টি লাইব্রেরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮ কোটি ৭০ লক্ষ বই নষ্ট হয়ে গেছে বেমালুম! জানি না, এই সংখ্যাটা আজ ঠিক কত!
শুধু এই ইরাক বা প্যালেস্টাইন নয়, গ্রন্থাগার ধ্বংস করার ট্র্যাডিশন চলেছে পৃথিবী জুড়েই। সেই ১৮৮০ সালেই মুদ্রক ও গ্রন্থপঞ্জি-নির্মাতা উইলিয়ম ব্লেডস প্রকাশ করেছিলেন ‘দ্য এনিমিজ অফ বুকস’ নামে একটি তামাম হিসেবপঞ্জি, সেখানে বইয়ের শত্রু হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা আছে, তার মধ্যে অবশ্যই আছে আগুন, জল, পোকা। কিন্তু সেই সঙ্গে একই তালিকাভুক্ত হয়েছে আরও দু’টি বইশত্রু– এক, বইয়ের বাঁধাইকর আর দুই, মূর্খলোকের দল! এই শত্রুরা আজও নিশ্চিতভাবেই আছে, কিন্তু এই সবের পাশে যাদের উল্লেখ নেই, সম্ভবত, তারাই সবচেয়ে বড় শত্রু– যুদ্ধবাজ মানুষ!
গত শতকের শেষ দিকে বিশ শতকের ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রন্থাগার ও মহাফেজখানা নিয়ে ইউনেসকো একটি নথি প্রকাশ করে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ড’ নামে। দু’-একটি উদাহরণ এক্ষেত্রে না দিলেই নয়। যেমন ধরুন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলজিয়ামের ওপর জার্মান আক্রমণের ফলে কয়েক ঘণ্টায় তিন লক্ষ বই ধ্বংস হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় লুভেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অনেক দেশ মিলে ফান্ড তৈরি করে এই লাইব্রেরিকে একেবারে ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে তোলা হয়েছিল বহু যত্নে, ফিনিক্সের মতো সেই উজ্জ্বল উত্থান। কিন্তু নিয়তি এমনই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই জার্মানদের হাতেই আবার ধ্বংস হয় এই লাইব্রেরি। যত অতীতেই যাওয়া যাক, মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে লুঠ করে মানুষই।
এই রিপোর্টটি দেখতে দেখতে একটি সারণিতে চোখ আটকে যাবেই। সারণিটির বিষয়, ‘নষ্ট আর ক্ষতিগ্রস্ত বইয়ের কারণ’। কারণগুলো দেখানো হয়েছে একের পর এক মহাদেশ ধরে ধরে, শতাংশের হিসেবে। দেখা যাচ্ছে, ‘আর্মড কনফ্লিক্ট’ শিরোনামে ইউরোপের ক্ষেত্রে যা ২৫ শতাংশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলির ক্ষেত্রে যা ২৯ শতাংশ, আমেরিকার ক্ষেত্রে যা ০ শতাংশ, এশিয়ার ক্ষেত্রে সেটাই ৪২ শতাংশ। অতিরিক্ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, শুধু এই হিসেবই যথেষ্ট পৃথিবী জুড়ে গ্রন্থাগার ধ্বংসের প্রবণতা বোঝার জন্য।
আসলে এই বই পোড়ানো বা লাইব্রেরি ধ্বংস করার মতো ক্ষতি কোনও আগ্রাসন বা যুদ্ধের শুধু ‘কোল্যাটারাল’ নয়, রীতিমতো পরিকল্পনা থাকে এর পিছনে। চূড়ান্ত বর্বরোচিত কাজের এ এক নমুনা, যা ক্ষমার অযোগ্য, যা কোনও দিনই ভুলে যাওয়ার নয়। আক্রমণকারীরা হাজার হাজার মানুষ মেরেই ক্ষান্ত হন না, তাঁদের লক্ষ্য পরাজিত জাতির যাবতীয় অতীত গৌরব, বহুদিনের সঞ্চিত জ্ঞান, শিল্পকর্ম– সবই ধ্বংস করা। এই বিশেষ প্রবণতার নতুন নাম ‘লিটারারি জেনোসাইড’, সভ্য মানুষের অভিধানে এই নতুন সদস্য আর-একবার কলঙ্কিত করল মানবেতিহাসকে।
বিভিন্ন রিপোর্টে, বইয়ে, ইতিহাসে, ভার্চুয়াল তথ্যভাণ্ডার থেকে বই-পুথি-শিলালিপি ধ্বংসের যে হিসেব পাওয়া যায়, তা দিয়ে তৈরি হতে পারে আর-একটা আস্ত পৃথিবী– মানুষের কদর্য বর্বরতার নিদর্শন হিসেবে। কী অসামান্য প্যারাডক্স, সামনেই আমরা মেতে উঠব বই-উৎসবে, মনেই থাকবে না এই ভয়াবহ এত স্মৃতির কথা!
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….