বিগত কয়েকদিনে খবরে প্রকাশ, নেতাজি নগরের বাসিন্দা ৩১ বছর বয়সি দেবাশিস সেনগুপ্ত আত্মহত্যা করেছেন এবং তাঁকে সোনারপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্পষ্ট দাবি করেছেন যে, সিএএ এবং এনআরসি-র ফলশ্রুতিতে তাঁর নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করা হতে পারে, এই নিয়ে দেবাশিস ঘন ঘন আতঙ্কে ভুগছিলেন। দেবাশিসের পরিচিতরা বলছেন, এনআরসি হলে বাংলাদেশে যদি তাড়িয়ে দেওয়া হয় সেই ভয়ে সদা সর্বদা তিনি চিন্তিত থাকতেন।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস যখন লিখছিলেন, ‘আমরা তো ভুলি নাই শহীদ’-এর মতো গান, ভাটিয়ালি সুরে খাম্বাজ রাগের পর্দাগুলিতে বেজে বেজে উঠেছিল সময়ের কণ্ঠস্বর– ‘তোমার বুকের খুনের দাগে দাগে আমরা পথ চলি’ অথবা ‘তোমার রক্তে রাঙা নিশান দিল পথের নিশানা’– র মতো পঙক্তিগুলি আমাদের জানান দিয়ে গিয়েছিল আমাদের সদ্য স্বাধীন, প্রাক্তন উপনিবেশটির বন্দিদশা ঘোচেনি এখনও। ঘোচেনি ক্ষুধা, মানুষের মন্বন্তর (নাকি গণহত্যা?)।
আজ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ৭৫ বছরে ধুমধাড়াক্কা ডিজে–মিউজিক আবহের অমৃতকালে যে মানুষটি ভয়ে প্রাণত্যাগ করলেন নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কায়, তাঁর মৃত্যুও একপ্রকার শাহাদতই। বিগত কয়েকদিনে খবরে প্রকাশ, নেতাজি নগরের বাসিন্দা ৩১ বছর বয়সি দেবাশিস সেনগুপ্ত আত্মহত্যা করেছেন এবং তাঁকে সোনারপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্পষ্ট দাবি করেছেন যে, সিএএ এবং এনআরসি–র ফলশ্রুতিতে তাঁর নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করা হতে পারে, এই নিয়ে দেবাশিস ঘন ঘন আতঙ্কে ভুগছিলেন। দেবাশিসের পরিচিতরা বলছেন, এনআরসি হলে বাংলাদেশে যদি তাড়িয়ে দেওয়া হয় সেই ভয়ে সদাসর্বদা তিনি চিন্তিত থাকতেন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিষয়ক বিভিন্ন ইউটিউবের খবর স্ক্রোল করতেন দিবারাত্র। বারুইপুর পুলিশ জেলার সোনারপুর থানা এলাকার এই বাসিন্দা একাধিকবার নিজের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথনে জানিয়েছিলেন, ‘আমার বার্থ সার্টিফিকেট নেই। আমার বাবা যে বাংলাদেশ থেকে এসেছিল আবার যদি সেখানে পাঠিয়ে দেয়।’ এই ভীতিপ্রদ মানসিক শঙ্কার আবহ, আজকের ভারতরাষ্ট্রের শাসকবর্গের মৌলিক অবদান। তারা নাগরিক দূরস্থান, মানবিক অবস্থানের স্থানাঙ্ককে জন্মের প্রমাণপত্র থুড়ি কাগজের টুকরোতে পর্যবসিত করেছেন।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাষ্ট্রতত্ত্বের পণ্ডিত যুক্তি দেখাতে শুরু করেন যে, জাতি-রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় পরিচয়ের সীমানা ‘কসমোপলিটানিজমের যুগ’-এর আগমনের দ্বারা অতিক্রম করা গিয়েছে। নয়ের দশকে বিশ্বায়নের পরে বিশ্বজুড়ে একত্রিত হওয়া অনেকগুলি ‘উন্নয়ন’-এর সূচক সেই ইঙ্গিত দেয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ইচ্ছাকৃতভাবে অভিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি গভীর সন্দেহের জন্ম, জাতীয় নিরাপত্তা, সুরক্ষিত সীমানার কল্প আখ্যানকে সামনে রেখে নিরলসভাবে ভাষা-ধর্ম-জাতি-গোত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের আপনজন বা শাসকের ভোটব্যাঙ্ক কাঠামোয় ‘অন্তর্ভুক্ত’দের নির্বাচন এবং ‘বহিরাগত’দের মধ্যে পার্থক্যের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে প্রায় প্রতিটি দেশেই। ‘বহিরাগত’ এমনকী, যদি বছরের পর বছর ধরে দেশে বসবাস করে এবং উঠোন, রান্নাঘর গড়ে তোলে নিজস্ব, পরিবারের স্থায়ী বসতি হিসাবে দেশকে গ্রহণ করে ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠে, তবুও তার নিস্তার নেই। এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতি ও তার ঠিক করে দেওয়া জাতিবাদী সংজ্ঞানুসারে ‘ভূমিপুত্র’-রা হবে জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক, বাকিরা বহিরাগত, উইপোকা, বাতিল খাতায় তাদের নাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এই উন্নয়নগুলির মধ্যে কয়েকটি ছিল: পুঁজির বিশ্বব্যাপী সংবহন, শ্রমশক্তির আন্তর্জাতিক স্থানান্তর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকাঠামোর মতো সংস্থাগুলিকে শক্তিশালী করা এবং অর্থ ও বাণিজ্যের সার্বিক কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বব্যাপী সংস্থাগুলি প্রতিষ্ঠা করা। অথচ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যেই, পুঁজিনির্ভর কসমোপলিটনিজমের ধারণা এবং সহনাগরিকের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার বাধ্যবাধকতার বয়ানবাজি করা সেকুলার জাতিরাষ্ট্রকাঠামো ধাক্কা খাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী জনপ্রিয় নেতাদের আবির্ভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ– সংকীর্ণ এবং জেনোফোবিক জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে অভিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি গভীর সন্দেহের জন্ম, জাতীয় নিরাপত্তা, সুরক্ষিত সীমানার কল্প আখ্যানকে সামনে রেখে নিরলসভাবে ভাষা-ধর্ম-জাতি-গোত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের আপনজন বা শাসকের ভোটব্যাঙ্ক কাঠামোয় ‘অন্তর্ভুক্ত’দের নির্বাচন এবং ‘বহিরাগত’দের মধ্যে পার্থক্যের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে প্রায় প্রতিটি দেশেই। ‘বহিরাগত’ এমনকী, যদি বছরের পর বছর ধরে দেশে বসবাস করে এবং উঠোন, রান্নাঘর গড়ে তোলে নিজস্ব, পরিবারের স্থায়ী বসতি হিসাবে দেশকে গ্রহণ করে ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠে, তবুও তার নিস্তার নেই। এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতি ও তার ঠিক করে দেওয়া জাতিবাদী সংজ্ঞানুসারে ‘ভূমিপুত্র’-রা হবে জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক, বাকিরা বহিরাগত, উইপোকা, বাতিল খাতায় তাদের নাম। এই ঘৃণার রাজনীতি আজ বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯-এ যখন বিভেদমূলক CAA (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) প্রণয়ন করা হয়, তখন এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা ঘোষণা করেছিলেন, যে তাঁদের নাগরিকত্বের অধিকার তাঁদের জন্মগত কারণে, এদেশের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে নাড়ির টানের কারণে। ‘দেশ’ ধারণাটির স্বত্বাধিকারী একমাত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নয়, বরং এদেশের প্রতর্কমূলক সংস্কৃতি, যা চার্বাকের, যা তুকারামের, যার উত্তরাধিকার রামপ্রসাদের কালীবন্দনার ফারসি শব্দরাজি থেকে আগত তার প্রতি বিশ্বস্ততার কারণে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সহ-নাগরিকদের সঙ্গে একাত্মতার কারণে সেই সময়ে অজস্র নাগরিক মিছিল হয়েছে জাতীয় পতাকা কাঁধে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক বিরোধিতার থেকেও জোরাল কৃষক আন্দোলনের ঢেউ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এটা হল সামাজিকভাবে কার্যকর একধরনের ‘পারফরম্যান্স’-নির্ভর নাগরিক আচরণ, যা একটি সমাজের জন্য কল্যাণকর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ হিসাবে নাগরিকত্ব, জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের প্রকাশ হিসাবে নাগরিকত্ব, সহ নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা হিসাবে নাগরিকত্ব, মানবিক মর্যাদা হিসাবে নাগরিকত্বের সমাহার, যার কাছে ম্লান হয়ে যায় আরোপিত আইন হিসাবে নাগরিকত্বের বিভেদমূলক ধারণা। এহেন অজেয়, রাস্তা দাপানো, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে মুখর নাগরিকত্বের আগে কাগুজে নাগরিকত্বের তাৎপর্য কী-ই বা হতে পারে? এ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দেবাশিস সেনগুপ্তের মতো অজস্র মানুষ আজ সংশয়ে থরথরিকম্প, হয়তো অযাচিত মৃত্যুকে আলিঙ্গনে উৎসাহী। কিন্তু একটিবারের জন্য প্রকৃত ‘নাগরিক’ হয়ে উঠতে পারলে, এই শিকড়শুদ্ধু সব হারানোর আশঙ্কা বিপুল জনস্রোতের মুখোমুখি পিছপাও হতে পারে।
তাঁরা জানেন যে, CAA-NPR-NRC প্রকল্পের বয়ান নাগরিকত্বের অক্ষ বরাবর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের ভোট একীভূত করার জন্য কেন্দ্রীয় একটি বিষয়। তবুও, সর্বাধিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, CAA-NRC প্রকল্পতে অনিশ্চয়তার একটি উপাদান রয়েছে। কারণ, এটি ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলিকে, এবং এদেশের সংশ্লেষী ঐতিহ্যকে মূল থেকে ভেঙে ফেলার চেয়ে কম কিছু করছে না। আদপে, এই প্রকল্পনা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের ঘাড়ে চেপে হিন্দুত্ববাদী জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের একটি মতাদর্শিক ‘টুলকিট’ মাত্র।
দেবাশিস কি সেই মহিলাকে চিনতেন, যিনি সোনতোলি থেকে আসছিলেন গোলাগঘাট, পার্বত্য আসামে? যাঁর সঙ্গে ছিল সদ্য এনআরসির নোটিস-পাওয়া বাসভর্তি লোক, ঠিক গৌহাটির মুখে খানপাড়ায় তাঁদের বাসটি উল্টে যায়। গৌহাটি মেডিক্যাল কলেজের বিছানায় বসে, আহত মহিলার কথাটুকু ছিল এই– ‘আমার তো হিয়ারিং চলছে, আমি অনুপস্থিত, আমার কী হবে?’ অথবা সেই ‘গাঁওবুড়ো’ শাহনুর আলি, মোহতোলি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান, যাঁর গ্রামের সকলেই অ-নাগরিক ঘোষিত, যাঁর গ্রামের মেয়েরা নিজেদের গয়না, সহায়-সম্বল, গার্হস্থ্য সমস্তটা বন্ধক রেখেছে নাগরিকত্বের আশায়। যদি খাতায় নামটুকু উঠে যায়, এই আশায়। হয়তো দেবাশিস এদের সঙ্গে কখনও দেখা করেননি। হয়তো অচেনা কোনও ব্লগারের টুকরো ডিডিওতে তিনি দেখেছিলেন, বিধ্বস্ত বরাক, দুঃস্বপ্নের মতো ডিটেনশন ক্যাম্প। হয়তো পড়েছিলেন, কোনও অন্ধকুঠুরিতে হাতড়াতে হাতড়াতে পরিস্মিতা সিং, সালিম হুসেনের ‘এনআরসি স্কেচবুকস’ এক্কেবারে গ্রাউন্ড জিরো থেকে। অথচ, দেবাশিস নেতাজি নগরের মানুষ, যাঁর বাসস্থানের আশপাশে গড়ফা, টালিগঞ্জ, সেলিমপুর– এগুলি তো একেকটা এলাকামাত্র নয়। সুলেখা মোড় থেকে বেঙ্গল ল্যাম্পের গেট অবধি হাঁটলেই মিলবে অজস্র কুমিল্লা, বাখরগঞ্জ, যশোর, খুলনা থেকে আগত শরীর ও তৎসংলগ্ন আখ্যান। যেসব আখ্যান আমাদের ক্যালাইডোস্কোপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একদা দেখিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ‘কোমল গান্ধার’-এর ভৃগু ও অনুসূয়া, দুই কপোত-কপোতীর মাঝে তিনি ফেলে দিয়েছিলেন অনসূয়ার মায়ের ডায়েরি। সেখানে ছিল নদী পেরনোর কথা, গ্রাম ছেড়ে আসার কথা, আর ছিল নোয়াখালি। আর ছিলেন গান্ধীজি। শীর্ণকায় সেই ‘বোকাবুড়ো’ হাঁটছেন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা রুখতে। সাঁকো পেরচ্ছেন। টলমলে সরু কাঠের সাঁকো। সঙ্গে অনসূয়ার মায়ের মতো অজস্র মেয়েরা। আমাদের সময়টাও এমনই। টলমলে সাঁকো। আমাদের হাঁটতে হবে।