লাইভে বসে মন্দিরা প্রশ্ন করছেন, অথচ উলটোদিক থেকে জবাব দূরে থাক, বড়জোর একটা আলগা চাহনি উড়ে আসত। তারপরই ক্যামেরার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের মতো কথা বলে যেতেন অতিথি তারকারা। অথচ মন্দিরার সঙ্গে যদি কোনও পুরুষ সঞ্চালক থাকতেন? তাঁর প্রশ্নে গুরুত্ব দিতে কিন্তু ভুল হত না এই অতিথিদেরই। অর্থাৎ মনোভাবটা ছিল যেন, মেয়েরা প্রশ্ন করবে কেন!
যে দুনিয়ায় নিজেরটা আঁকড়ে-পাকড়ে বুঝে নেওয়াটাই দস্তুর, সে দুনিয়াতেই মাঝে মাঝে চমকে দেওয়া ঘটনা ঘটে যায়। যেমন, এই ক’দিন আগে শোনা গেল, ডেনমার্কের ফুটবলারদের বেতন বাড়ানোর কথা হয়েছিল, অথচ সেই বাড়তি বেতন প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা। এখানে বলে রাখা দরকার, এই প্রস্তাব কেবল বরাদ্দ ছিল পুরুষ ফুটবলারদের জন্যই, যাঁদের বেতন এমনিতেও মহিলা ফুটবল দলের চেয়ে বেশি। কিন্তু তাঁদের বাড়তি টাকা দেওয়ার বদলে মহিলা ফুটবলারদের সমান বেসিক পে দেওয়া হোক, এই দাবি তুলেছেন সে দেশের পুরুষ ফুটবলারেরাই। যে দুনিয়াটায় কেবল লিঙ্গপরিচয়ের সুবাদেই বাড়তি সুবিধা দাবি করা যায়, সেখানে একদল পুরুষ সম্মিলিতভাবে এই দাবি তুলছেন দেখে আশ্চর্য লাগে বইকি।
কোনও খেলায় পুরুষ আর মহিলা উভয়েই সমান টাকা পাবেন– এ দাবি অবশ্য আজকের নয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও বছর দুই আগে সে অধিকারে সিলমোহর দিয়েছে। যদিও দাবি মেনে নেওয়ার আগেই প্রশ্ন ওঠে, এহেন দাবি তোলার প্রয়োজন হয় কেন? পুরুষ বলেই তাঁর পারিশ্রমিক বেশি আর নারী বলেই কম, কাজের ক্ষেত্রে এমন বেড়াই বা থাকবে কেন! কাজ তো কাজই, আর কাজের গুণমানের নিরিখেই তো তার বিচার হওয়ার কথা। কিন্তু কি দামে, কি মানে, এ বৈষম্য একেবারে জ্বলজ্বল করছে সর্ব ক্ষেত্রে। মেয়েদের কাজ যেমন কমদামি বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, তেমনই কমদামি বলেই তার সম্মান কম, এমন এক ধারণাও তৈরি হয়ে যাচ্ছে একইসঙ্গে।
লিঙ্গসাম্য। সমানাধিকার। নারী ও পুরুষের সমান অবস্থান– কথাগুলো শুনতে আসলে যতটা ভালো, কাজে তা অভ্যাস করা ঠিক ততটা সহজ নয়। তাই, বাস্তব জগতে কখনও প্রত্যক্ষে, কখনও পরোক্ষে টানা হতে থাকে লিঙ্গবৈষম্যের এক গাঢ় রেখা। এমনকী খেলার দুনিয়া, যা বেঁধে বেঁধে থাকার কথাই বলে, সেখানেও বিভাজন টানতে থাকে এই প্রখর বৈষম্য। বেতনের বিভাজন তো খুব স্পষ্ট, চোখে পড়ার মতো একটা ভেদ। তাছাড়াও, স্রেফ কথা বলে কিংবা না বলেই বুঝিয়ে দেওয়া যায়, কে দলে রয়েছে আর কে আসলে দলের বাইরে। যেমনটা বুঝেছিলেন মন্দিরা বেদি।
এমনিতে মন্দিরা বেদি মানেই ভারতীয় ক্রিকেটের ঝলমলে অধ্যায়। একে রুপোলি পর্দার তারকা, তায় ক্রিকেটের সঙ্গে যোগাযোগের দরুন তিনি বরাবরই উজ্জ্বল লাইমলাইটের তলায়। কিন্তু সেই ঝলমলে উপস্থিতির পিছনে যে গল্পগুলো লুকিয়ে, তা কিন্তু অতটা সুন্দর নয়, সহজও নয়। দিনকয়েক আগে তেমনই একটা গল্প শুনিয়েছেন মন্দিরা বেদি। তিনি যখন সদ্য সদ্য ক্রিকেট সঞ্চালনার জগতে পা রেখেছেন, সেই সময়কার গল্প। যখন দিনের পর দিন তাঁর কথার উত্তরই দিতেন না ক্রিকেটদুনিয়ার তাবড় তাবড় পুরুষেরা। না, তিনি যোগ্য কি অযোগ্য, তাঁর প্রশ্ন ঠিক না ভুল, সেসব বিচার করে নয়। স্রেফ তিনি একজন নারী বলে। ক্রিকেটবোদ্ধারা খেলার ভালোমন্দ নিয়ে কাটাছেঁড়া করছেন, সে প্যানেলে হাজির কোনও মেয়ে, এমনটা তাঁরা না দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, না ভাবতে। লাইভে বসে মন্দিরা প্রশ্ন করছেন, অথচ উলটোদিক থেকে জবাব দূরে থাক, বড়জোর একটা আলগা চাহনি উড়ে আসত। তারপরই ক্যামেরার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের মতো কথা বলে যেতেন অতিথি তারকারা। অথচ মন্দিরার সঙ্গে যদি কোনও পুরুষ সঞ্চালক থাকতেন? তাঁর প্রশ্নে গুরুত্ব দিতে কিন্তু ভুল হত না এই অতিথিদেরই। অর্থাৎ মনোভাবটা ছিল যেন, মেয়েরা প্রশ্ন করবে কেন! আর তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ারই বা কী আছে! একজন নারী কোনও পুরুষ তারকাকে প্রশ্ন করছে, তাঁদের পৌরুষের কাছে এই আচরণটুকুই বিসদৃশ ঠেকত। অন্তত তাঁদের আচরণ সে কথাই বলত, বলছেন মন্দিরা।
…………………………………………………………………….
একালে ক্রিকেট শো সঞ্চালনার দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অর্চনা বিজয়া, মায়ান্তি ল্যাঙ্গার, শিবানী দান্ডেকর, সঞ্জনা গণেশন-রা। লাইভ শো-তে তাঁদের বুম এড়িয়ে যাবেন কেউ, তা হওয়ার জো নেই। কিন্তু মিডিয়াতেই, তাঁদের নিয়ে যা খবর হয়, তার অধিকাংশ জুড়ে জ্বলজ্বল করে তাঁদের স্বল্পবসনা ছবি। তাঁদের পারা না-পারার কথা নয়, পোশাক পরা না-পরাই হয়ে ওঠে তাঁদের প্রাথমিক, হয়তো প্রধান পরিচয়ও। নারী বলেই বৌদ্ধিকতার তুলনায় তাঁদের শরীর সহজে বিকোবে, এই ধারণা এখনও যখন রমরমিয়ে চলছে, সেখানে বৈষম্যের পাঁচিলগুলো কতটাই বা ভেঙেছে আদৌ!
…………………………………………………………………….
অথচ কেউ ভালো ক্রিকেটার মানেই তিনি ভালো কমেন্ট্রি করবেন বা ভালো কোচ হবেন, এমনটা যেমন শাশ্বত সত্য হতে পারে না; তেমনই কেউ মেয়ে বলেই ক্রিকেট বুঝবেন না, এমনটাও তো নিয়ম হতে পারে না। তার চেয়েও বড় কথা, যিনি খেলার কমেন্ট্রি করছেন বা সঞ্চালনা করছেন, কেবল খেলাটা বুঝলেই তাঁর চলে না। একইসঙ্গে দরকার হয় নিজেকে উপস্থাপন করার মুনশিয়ানা। মন্দিরা বেদির ক্ষেত্রে যেমন এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই, এই দক্ষতায় অতিথি ক্রিকেট তারকাদের অনেককেই তিনি টেক্কা দিতে পারতেন। কারণ সেই বিষয়টি তিনি শিখেছেন, চর্চা করেছেন নিরন্তর। সেখানে নারী বলে তাঁকে অবজ্ঞা করার অর্থ আসলে তাঁর পারা-টাকেই খাটো করে দেখা। এখানে এ কথাও বলার যে, এই গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ারও আসলে অনেকগুলো ধরন হয়। মন্দিরার সময়ে নারীর প্রতি যে ঔদাসীন্য ছুড়ে দেওয়া যেত, এখন ঠিক সে কাজ করা চলে না। হালে এক পা এক পা করে বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাঠে নামছে ক্রিকেট দুনিয়া। ব্যাটসম্যান শব্দ বদলাচ্ছে ব্যাটারে, কিংবা পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেটারদের সমবেতনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, পুরুষদের মতোই মহিলাদের আইপিএল-ও শুরু হয়ে গিয়েছে। একালে ক্রিকেট শো সঞ্চালনার দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অর্চনা বিজয়া, মায়ান্তি ল্যাঙ্গার, শিবানী দান্ডেকর, সঞ্জনা গণেশন-রা। লাইভ শো-তে তাঁদের বুম এড়িয়ে যাবেন কেউ, তা হওয়ার জো নেই। কিন্তু মিডিয়াতেই, তাঁদের নিয়ে যা খবর হয়, তার অধিকাংশ জুড়ে জ্বলজ্বল করে তাঁদের স্বল্পবসনা ছবি। তাঁদের পারা না-পারার কথা নয়, পোশাক পরা না-পরাই হয়ে ওঠে তাঁদের প্রাথমিক, হয়তো প্রধান পরিচয়ও। নারী বলেই বৌদ্ধিকতার তুলনায় তাঁদের শরীর সহজে বিকোবে, এই ধারণা এখনও যখন রমরমিয়ে চলছে, সেখানে বৈষম্যের পাঁচিলগুলো কতটাই বা ভেঙেছে আদৌ!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রণিতা চট্টোপাধ্যায়-এর কপি:বিষয়ের গায়ে কি ‘মেয়েলি’, ‘পুরুষালি’ ট্যাগ লাগানো থাকে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবির সেই দৃশ্য আমাদের মনে থেকে যায়, যেখানে বেডরুমের আদরমুহূর্তেও পুরুষটির মস্তিষ্ক তার খেলার তুলনায় তার সঙ্গিনীর খেলার মূল্যভেদ জানিয়ে দেয়। কিংবা ‘দঙ্গল’ ছবিতে কুস্তিগির পিতা নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে ধরে রেখেছিলেন তাঁর পুত্রসন্তানকেই, কিন্তু মেয়েরা তাঁর নাম রাখতে পারবে বুঝেই তিনি শেষমেশ এই আপসে আসেন, ‘গোল্ড তো গোল্ড হোতা হ্যায়, ছোড়া লাভে ইয়া ছোড়ি’। আসলে বেতন, সুযোগসুবিধা, বাড়তি পুরস্কার, এসব হিমশৈলের চূড়া মাত্র। নেপথ্যে এই সবকিছুকে ধারণ করে আছে এই সামগ্রিক মানসিকতা, যেখানে নারীকে দেখার চোখটাই আলাদা হয়ে যায়। মন্দিরা বেদিই হোন কি পাশের বাড়ির মেয়েটি, সে চোখের সঙ্গে তাঁদের মোকাবিলা করে যেতেই হচ্ছে। তখনও। এখনও।
……………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………….