যখন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কোনও সন্তানকে দেখি নিরাপত্তাহীনতার চাপের বাইরে গিয়ে এমন মানুষদের সঙ্গে কাজ করছে, যারা আমাদের এই ‘নিরাপদ শহরতলি, ভালো স্কুল, বাস্কেটবল, ব্যালে, দুর্গাপুজো, উইকেন্ড পার্টি, ভালো কলেজ, দেশ বিদেশে ভ্রমণ’-এর পৃথিবীর ধারেকাছেও আসে না, তখন হঠাৎ আলোর ঝলকানি এসে পড়ে হৃদয়ে। চোখ, মন অনভ্যস্ত আলোয় ধাঁধিয়ে যায়।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। আমার মতো যারা মধ্যবয়স্ক, যাদের ছেলেমেয়েরা এখন স্কুল জীবনের শেষে, কলেজ অথবা কর্মক্ষেত্রে প্রধানত তাদের কথা বলছি। ২০২৪ সালের শেষে দাঁড়িয়ে তাদের বিষয়ে একটা কথা মনে হয়। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসে আশাপূর্ণা দেবী বলেছিলেন পূর্বনারীদের ঋণশোধ করার কথা। এই বছরটাতে আমরা সময়ের এমন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে মধ্যবয়সের অবিশ্বাস, নিরাশা, দ্বিধার ধূসর পর্দাটা যেন হঠাৎ করে ছিঁড়ে দিয়েছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। যা ঠিক, যা হওয়া উচিত, সেই অত্যন্ত সহজ কিন্তু অত্যন্ত কঠিন পথ তারা বেছে নিচ্ছে। তাই বোধহয় সময় এসেছে, আমাদের সব সময়ে ‘ঠিক আছে, চলতা হ্যায়’ মেনে আর মানিয়ে চলা বদ্ধজল জীবন থেকে বেরিয়ে এদেরকে একটু বোঝার চেষ্টা করার। ‘উত্তর’ ঋণশোধ চেষ্টা করার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ অভিবাসী জীবন আমার। তার অভিজ্ঞতা বলে, যেহেতু আমরা বেশির ভাগ সময়েই বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কয়েকটা সুটকেস থেকে একটা জীবন শুরু করি, তারপর যে যার মতো করে, নিজের সাধ্যে যতটা পারি এগিয়ে চলি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মনে একটা অনিশ্চয়তা, একটা নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। সেই জায়গা থেকে আমরা অনেকেই চাই– আমাদের সন্তানরা এমন বিষয়ে পড়াশোনা করুক, যাতে তাদের জীবনে সাফল্য এবং অবশ্যই আর্থিক নিরাপত্তা থাকে। বৃহত্তর পরিবারের নিরাপত্তাবোধ না-থাকা, অভিবাসী হিসাবে পায়ের তলার মাটি শক্ত করার, নিজেদের প্রমাণ করার তাগিদ– ব্যক্তিগত জায়গা থেকে এবং একটি ‘মডেল মাইনরিটি কমিউনিটির’ সদস্য হিসেবে– এই সমস্ত কিছুই পরবর্তী প্রজন্মের ওপর একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করে। আর এ বিষয়টা নিয়ে ভারতীয় অভিবাসী মা বাবা আর সন্তানদের মধ্যে একটা বিরোধ লেগে থাকে। এ নিয়ে অনেক জোকস, মিম্স। শুধু পড়ো। অঙ্ক করো। সায়েন্স পড়ো। বেশি খেলাধুলো নয়। করলেও এমন কিছু বেছে নাও যেটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ এনে দেবে। এই সাবজেক্ট পড়ে কি হবে? আগে অ্যাভারেজ স্যালারি দেখো? তাই যখন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কোনও সন্তানকে দেখি এই সমস্ত টানেল ভিশন, এই নিরাপত্তাহীনতার চাপের বাইরে গিয়ে এমন মানুষদের সঙ্গে কাজ করছে, যারা আমাদের এই ‘নিরাপদ শহরতলি, ভালো স্কুল, বাস্কেটবল, ব্যালে, দুর্গাপুজো, উইকেন্ড পার্টি, ভালো কলেজ, দেশ বিদেশে ভ্রমণ’-এর পৃথিবীর ধারেকাছেও আসে না, তখন হঠাৎ আলোর ঝলকানি এসে পড়ে হৃদয়ে। চোখ, মন অনভ্যস্ত আলোয় ধাঁধিয়ে যায়। যেমন ধরুন সায়ক চক্রবর্তী নামের এই ছেলেটি।
……………………………………………….
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের পর ধরপাকড় শুরু হলে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা পথে নামে, আমাদের শহর বস্টনে এমারসন কলেজের আন্দোলনকারীদের তাঁবু ভেঙে সরিয়ে দিলে, ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ছাত্রছাত্রীরা কলেজ প্রাঙ্গণে তাঁবু খাটিয়ে ল্যাপটপ কোলে শুরু করে সিট্-ইন আন্দোলন, তাদের মুখে কোনও স্লোগান নেই, তারা নিঃশব্দে করে চলেছে নিজের কাজ। এ যেন বাচ্চাদের খেলনার মতো। গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা একটা মাথা হাতুড়ি দিয়ে নিচে পাঠালে আরও দুটো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছে।
……………………………………………….
সায়ক আমার সন্তানের মতো। সে এখন ক্যালিফোর্নিয়ার একটি নামকরা ল’ স্কুলের ছাত্র। কঠোর পরিশ্রম করে ভালো এরকম জায়গায় পড়ার সুযোগ আসে। কিন্তু সায়ক এখানে পড়ার সুযোগ পেয়েও একবছর সময় নিয়েছিল, কারণ সে বৃহত্তর বস্টনে নিম্ন আয়ের মানুষদের বাসস্থান প্রকল্পে, বহু ছোট ছোট কমিউনিটি, মাইনরিটি, ধর্মীয় অর্গানাজেশন দিয়ে গড়া একটি কোয়ালিশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় কাজ করত। সেই বাসস্থান প্রকল্প কার্যকরীভাবে শুরু হওয়া পর্যন্ত সে নিজের দায়িত্ব থেকে সরেনি। এছাড়া সে কাজ করেছে সংশোধনাগারে নিজেদের মেয়াদ কাটিয়ে আসা মানুষদের সঙ্গে, যারা জীবনের মূলস্রোতে ফেলার চেষ্টা করছে। পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই বোধ হয় এই মানুষগুলোর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সহজ নয়, কোনও দিক থেকেই। অনেক সময়ে এমন হয় যখন তারা সংশোধনাগারে যায় তাদের কোনও পরিচয়পত্র থাকে না।পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার উপায় না থাকলে, নতুন করে জীবন শুরু করতে হলে যেকোনও ক্ষেত্রে পরিচয়পত্র লাগবেই। সে ড্রাইভারস লাইসেন্স হোক, থাকার জায়গা, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা ফুড স্ট্যাম্প। তাই সায়করা চেষ্টা করছে জেল থেকে বেরোনোর আগেই যেন এই কাজটা শুরু হয়ে যায়, যাতে তাদের মূলস্রোতে ফেরার প্রথম পদক্ষেপ একটু সহজ হয়। এই কথাগুলো আমি যখন শুনছি, আমি ভাবছি এই প্রান্তেবাসী মানুষরা, যাদের আমরা সিনেমা আর সিরিজের বাইরে কখনও দেখি না, তাদের কথা কীভাবে ওরা চিন্তা করে?
কিন্তু ওরা ভাবে। যতই আমরা আমাদের পরের প্রজন্মকে নিজেদের স্ক্রিনের জগতে, নিজেদের স্পেসে বসবাসকারী মানুষ ভাবি, তারা প্রমাণ করছে তারা সচেতন, তাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ আর মানসিক দৃঢ়তা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি।
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর। প্যালেস্টাইনের হামাস আতঙ্কবাদী সংগঠন ইজরায়েলের ওপর সাংঘাতিক আক্রমণ করে, যাতে ১২০০ নিরীহ মানুষের প্রাণ যায় এবং তারা প্রায় ২৫০ ইহুদীদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। নিহত এবং অপহৃত মানুষদের মধ্যে আমেরিকার নাগরিক ছিল বেশ কিছু সংখ্যায়। এরপর ইজরায়েল সরকার বিগত এক বছরে গাজা ভূখণ্ডকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। গাজা ভূখণ্ডে প্রায় ৪৪,০০০ প্যালেস্টাইন প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু। নির্বিচারে হাসপাতাল, স্কুলের ওপর আক্রমণ হয়েছে। উদ্বাস্তু সংখ্যা তিরিশ লক্ষ ছাড়িয়েছে। এই এথনিক ক্লেনসিং শুরু হবার পরে আমেরিকার কলেজ-ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্রছাত্রীরা গর্জে ওঠে প্রতিবাদে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মাস্যাচুসেট্স, নিউইয়র্ক থেকে টেক্সাস, কলেজে কলেজে পিকেটিং, মিছিল, প্রতিবাদ সভা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় দমন, কলেজ-ক্যাম্পাস ভরে যায় সশস্ত্র পুলিশে, শুরু হয় গ্রেফতারি, সাসপেনশন। পুলিশের আগ্রাসন আটকাতে ছাত্রদের সঙ্গে গ্রেফতার হতে থাকেন অধ্যাপকরাও। তবে তাদের দমানো মোটেই সহজ হয়নি। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের পর ধরপাকড় শুরু হলে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা পথে নামে, আমাদের শহর বস্টনে এমারসন কলেজের আন্দোলনকারীদের তাঁবু ভেঙে সরিয়ে দিলে, ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ছাত্রছাত্রীরা কলেজ প্রাঙ্গণে তাঁবু খাটিয়ে ল্যাপটপ কোলে শুরু করে সিট্-ইন আন্দোলন, তাদের মুখে কোনও স্লোগান নেই, তারা নিঃশব্দে করে চলেছে নিজের কাজ। এ যেন বাচ্চাদের খেলনার মতো। গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা একটা মাথা হাতুড়ি দিয়ে নিচে পাঠালে আরও দুটো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসছে।
এই দেশে বহু পরিশ্রমে স্কলারশিপ নিয়ে, অথবা অনেক ব্যাঙ্ক-লোন নিয়ে পড়াশোনা করে ছেলেমেয়েরা। কিন্তু এই সময়ে নিজেদের কেরিয়ার, ভবিষ্যৎ, সাসপেনশন কিচ্ছুর কথা ভাবেনি তারা। তাদের একটি মূল বক্তব্য ছিল, কলেজগুলোকে ইজরায়েল সমর্থনকারী যেকোনও ব্যবসায়িক সংস্থা থেকে আর্থিক অনুদান নেওয়া বন্ধ করতে হবে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য আমেরিকান সরকার এবং এদেশের বহু ব্যবসায়িক সংস্থা ইজরায়েলের সমর্থনকারী। এই আন্দোলন এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত এতটাই জোরালো ছিল যে, বলা যায় ভিয়েতনাম আন্দোলনের পর এরকম গণঅভ্যুত্থান দেখা যায়নি এদেশের মাটিতে। স্বতঃস্ফূর্ত, অহিংস, একাগ্র, স্বার্থহীন। ২০২৪ সালের স্প্রিং সেমেস্টার শেষ হওয়ার পর, ছাত্রছাত্রীরা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে চলে যাওয়ার পর এই আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে পেছনে চলে গেছে। কিন্তু একটা প্রজন্মকে চিনিয়ে দিয়েছে। যারা একার পৃথিবীতে বাঁচে না, শুধু স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে না, যারা শান্তভাবে সশস্ত্র পুলিশের মুখোমুখিও দাঁড়াতে পারে।
তেমনই পৃথিবীর অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কলকাতার চিকিৎসক ছাত্রছাত্রীরা। দেওয়ালে পিঠ থেকে গিয়েছিল তাদের। কর্মক্ষেত্রে তাদের একজনের অবর্ণনীয় নৃশংসতম ধর্ষণ আর হত্যা যেন রাতারাতি তাদের কমিউনিটিকে একটাই অস্তিত্বে পরিণত করল– কোন প্রস্তুতি ছাড়াই। তারা প্রত্যেকে হয়ে উঠল তিলোত্তমা। অভয়ার প্রত্যেকটা কণা যেন আলোককণা হয়ে প্রবেশ করেছিল ওই হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে। তারা প্রজ্জ্বলিত হল অসীম ধৈর্যে, অসীম স্থৈর্যে। শুরু হল তাদের প্রতিবাদ। না, তাদের প্রতিবাদে কোনও ধূসর ভূমি ছিল না। যারা কোনওদিন কোনও মিছিলে হাঁটেনি, তারা দিনরাতের দখল নিল, রাস্তার দখল নিল। রাস্তায় থাকা, রাস্তায় খাওয়া, শোওয়া– দিনের পর দিন। তাদের প্রতিবাদকে এত সুসংহত, বিবেচনার সঙ্গে পরিচালনা করল, যা আমাদের প্রজন্মের চিন্তাভাবনায় কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। একটা গোটা শহর, শহরতলির প্রাথমিক বিস্ময় কাটানোর পর শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা আর বাঁধনহীন ভালোবাসা আদায় করে নিল তারা। তাদের আন্দোলন হয়ে উঠল এই শহরবাসীর সম্মিলিত বোধ।
কীভাবে জেগে উঠলাম আমরা? কি হেলায় ঘরের চার দেওয়াল, খাওয়া, শোয়া, বসা, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া এক হাতে সরিয়ে দিয়ে, সকলের মাঝখানে নিজেকে দেখতে পেলাম। দিনের পর দিন এই ছাত্রছাত্রীদের কাছে বহুদূর থেকে বয়ে আনা খাবার, গভীর বৃষ্টির রাতে চোখ থেকে জল পড়তে থাকা মায়েদের নিয়ে আসা শুকনো জামাকাপড়, বয়স্ক মানুষদের মাথার কাছে বসে হওয়া করা– এসব ছবি আমাদের সম্মিলিত হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। একই আকুলতা। একই প্রার্থনা– ‘এগিয়ে যাও, দাবি করো, প্রশ্ন করো, বাঁচো’। আমাদের সব অন্ধকার, দৈন্যকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে এক মিছিল– কাঁধে আমাদের ব্যর্থতা। যেন অনেক অন্ধকারে একটা মশাল। তা আজ আর নেই বটে, কিন্তু তার উত্তাপটুকু মানুষের মধ্যে বিরাজমান। যেন সত্যিকারের জেগে ওঠা। অনুভব করা– এভাবেও প্রতিবাদ করা যায়।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………