‘ছাবা’ এমন একটি ছবি, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঔরঙ্গজেবকে হিন্দু বিদ্বেষী একজন ক্রুর মানুষ বলে প্রতিষ্ঠা করা, যার কোনও বিবেক নেই। প্রথমত ঐতিহাসিকভাবে এগুলো সব অর্ধসত্য। কারণ বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডার মুসলিম শাসকদের ওপর যখন মুঘল সাম্রাজ্যের আক্রমণ নেমে এল, তখন কিন্তু শম্ভাজি মুঘলদের সাহায্য করেছিলেন। তার ফলশ্রুতি হল যখনই বিজাপুর গোলকুণ্ডার সুলতানদের পতন হল, তখনই দাক্ষিণাত্যে মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ, তারও পতন হল। স্বাভাবিকভাবেই মারাঠারা একা হয়ে গেল এবং সেই সুযোগ মুঘল সম্রাট নিলেন। অর্থাৎ শম্ভাজি নিজের মূর্খামিতেই নিজের পতন ডেকে আনলেন। যদুনাথ সরকারের মতো ইতিহাসবিদ যেভাবে ঔরঙ্গজেবকে এক জটিল চরিত্রের দোষগুণে মিশ্রিত শাসক হিসেবে দেখিয়েছেন সেসব এই ছবির কাছে আশা করা অন্যায়। ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রুস্কের লেখা ‘ঔরঙ্গজেব দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ পড়লেও ঔরঙ্গজেবকে এক জটিল চরিত্রের বহুমুখী দোষগুণের মানুষ বলে চেনা যায়।
মানস ঘোষ
বিগত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ আজকের ভারতবর্ষের আবার একটা অস্থির চিত্র আমাদের সামনে হাজির করল। প্রমাণ হল আমরা বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, সংবিধানের ওপর আক্রমণ– এসব ভুলে পাঁচশো বছর আগেকার পুরনো ইতিহাসের ক্রীতদাস হয়ে থেকে গেছি। দু’জন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শম্ভাজি ও ঔরঙ্গজেব আবার একবার এই দেশে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মধ্যে একটা মর্মান্তিক বিবাদের প্রেক্ষাপট উন্মোচন করল। তার পিছনে ভূমিকা রাখল একটি বলিউড ছবি, যার নাম ‘ছাবা’। শিবাজী সাওয়ান্ত নামের এক মারাঠি উপন্যাসিকের একটি উপন্যাসের ওপর নির্মিত ছবি। যার অনেকটাই ইতিহাস অনুমোদিত নয়। অর্থাৎ, আপন মনের মাধুরী মিশায়ে লেখক কল্পনা করেছেন কাহিনির প্রবাহ। এটা ঠিক যে শিবাজী, শম্ভাজী, সাহুজিরা হিন্দু মারাঠা অস্মিতার প্রতীক। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, শিবাজীর বিরুদ্ধে যে মুঘল সেনাবাহিনী যুদ্ধ করেছিল, তার সেনাপতির নাম ছিল জয় সিংহ। সঙ্গে এই ঐতিহাসিক সত্যটাকেও মনে রাখতে হবে, শিবাজীর তরফে যে সেনাপতির দল যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন দৌলত খান, দারিয়া সারং এবং সিদ্দি হিলাল। শিবাজীর অন্যতম প্রধান ও বিশ্বস্ত দেহরক্ষীর নাম ছিল সিদ্দি ইব্রাহিম। আর তাঁর অন্যতম পরামর্শদাতা ও নির্ভরযোগ্য মুন্সি বা সেক্রেটারির নাম ছিল কাজী হায়দার। এসব নথিবদ্ধ ইতিহাস। এই কথাগুলো অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও নেই।
ছত্রপতি শিবাজীর লড়াইটা আসলে ছিল বিরাট এক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। যে বিপুল ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্যের নাম ঘটনাচক্রের মুঘল সাম্রাজ্য। এর মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উপাদান তেমন ছিল না। কারণ কেবল হিন্দু মারাঠা-রাজ নয়, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানদের সঙ্গেও ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের বৈরিতা। কিন্তু ঔপনিবেশিক ইতিহাস একে মুসলমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হিন্দু রাজার প্রতিরোধ বলে ক্রমাগত প্রচার করে গেছেন। আর আশ্চর্যের কথা, তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সংঘীরা তাকে মান্যতা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার রং চড়িয়ে যাচ্ছে আজও। ব্রিটিশ চলে গেছে। কিন্তু রেখে গেছে তাদের দালালদের। কোথাও তাদের দালালরা কম্প্রেদর বুর্জোয়া থেকে আজকের ক্রনিক ক্যাপিটালের মালিক, আবার কোথাও সেই দালালরা সংঘী রূপে ওই ব্রিটিশদের লেখা ইতিহাসের প্রচারক। আসলে সংঘীদের মতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এত অনুগত অনুচর পৃথিবীর ইতিহাসেও খুব কম দেখা যায়। তারা ঔরঙ্গজেব বনাম শিবাজীর দ্বন্দ্বকে মুঘল সাম্রাজ্য বনাম স্বাধীন আঞ্চলিক রাজের দ্বন্দ্ব না বলে তাকে মুসলমান ও হিন্দুর দ্বন্দ্বে পরিণত করতে চায়। এক্ষেত্রে না বুঝে অনেকেই দায়টা চাপিয়ে দেন ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের ঘাড়ে। মনে করা হয়, ঔরঙ্গজেবের চরিত্রের নেতিবাচক দিকটি যদুনাথ সরকারের লেখায় প্রকট হয়েছিল। আসলে এই ধারণাটা বেশ কিছুটা ভুল। কারণ যদুনাথ সরকারের মতো বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচয়িতা, এতটা খেলো বক্তব্য দেবেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মজার কথা হল, পাঁচ ভলিউমে লেখা যদুনাথ সরকারের ম্যাগনাম ওপাস ‘হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব’ নয়, বিজেপি আরএসএস যে বইটা প্রচার করে, তা হল ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব’ যেখানে ইতিহাসবিদ হিসেবে যদুনাথের যে অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি তার অনেকটাই পাওয়া যায় না। পাঁচ ভলিউমে লেখা যদুনাথের ঔরঙ্গজেব পড়লে বোঝা যায় কী নিবিড়ভাবে তিনি আর্কাইভ দেখেছেন। অবশ্যই তিনি ঔরঙ্গজেবের চরিত্রের প্রশংসনীয় গুণগুলি যেমন লিখেছেন, একইসঙ্গে ঔরঙ্গজেবকে প্রধানত দায়ী করেছেন মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ পতনের জন্য। যেমন যদুনাথ বলছেন, ঔরঙ্গজেবের শাসনের শেষ দিকে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি বিশেষভাবে মাথা চাড়া দিয়েছিল। যদিও সম্রাট একের পর এক নির্দেশাবলি পাঠিয়ে বা আইন কঠোর করে তা দমন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। ফলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রজাদের মধ্যেই অসন্তোষ ছিল। তবে তৎকালীন হিন্দু সমাজকে নিয়ে লিখতে গিয়ে যদুনাথ বলছেন যে তারা আসলে পৈতে, বেদ পাঠ, জাতপাতের ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, আর কে কোন কুয়া থেকে জল খাবে– সেটা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের তেমন উৎসাহ ছিল না। অর্থাৎ যদুনাথ কিছুটা তিক্ত স্বরেই যা বলেছেন, তার মানে দাঁড়ায় হিন্দুদের শত্রু মুসলমান ছিল না, আসলে তাদের শত্রু ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ!
এইসব কথা ‘ছাবা’র মতো একটি কুৎসিত ফিল্মে উঠে আসবে এরকমটা মনে করার কোনও কারণ নেই। আসলে ‘ছাবা’ সঞ্জয় লীলা বনশালীর ঢঙে তৈরি একটা ছবি, যেখানে বিষাক্ত মাস্কুলাইন একপ্রকার স্পেক্টাকল একের পর এক পর্দায় আসতে থাকে, এবং এক ধরনের উত্তর ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক বড়লোকি ওই ইমেজগুলোর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। বনশালীর ছবিগুলোর মতোই এই ছবিটাতেও ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকার কোনও ইচ্ছে নেই, বরং যা আছে তা হল কিছু স্পেক্টাকল, যার মাধ্যমে চলে সামন্ততান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী পৌরুষের নির্মাণ। স্বাভাবিকভাবেই এই ছবি দেখে যারা ইতিহাসের বিচার করতে যাবে, তারা মিথ্যের পিছনে ছুটবে।
………………………………….
ইন্দ্রজিৎ সাওয়ান্ত এরকমই একজন মারাঠা ইতিহাসবিদ। যিনি সারা জীবন ধরে শিবাজী ও মারাঠা রাজের ওপর গবেষণা করে গেছেন। তিনি খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলেছেন ‘ছাবা’ একটি ছবি, যেখানে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। তার একটা উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন যে এখানে খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে শিবাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী সায়ারাবাই ভোঁসলেকে অথচ সাওয়ান্ত মনে করেন যে আসল ভিলেন শিবাজীর একজন ব্রাহ্মণ পরামর্শদাতা, যার নাম আন্নাজি দাত্ত। এই সত্যটা উন্মোচন করার জন্য তাঁকে মধ্যরাত্রে ফোন করে শাসানো হয়েছে।
………………………………….
কিন্তু কথাটা হল, এরা সচেতনভাবেই এমন ছবি বানায় যা মিথ্যের ওপর নির্মিত এবং যারা সে ছবি দেখে মিথ্যের পিছনে দৌড়ে ঔরঙ্গজেবের সমাধিস্থল ভাঙতে যায়, তাদের রাজনীতিও আসলে ওই মিথ্যের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। মজার কথা হল, যার সমাধিতে হামলা চালানো হল, তিনি যদুনাথ এবং অন্যান্য ইতিহাসবিদদের মতে ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে শক্তিমান সম্রাট। তার রাজকোষ উপচে পড়েছিল হিরে, জহরত প্রভৃতি সম্পদে। অথচ তিনি ব্যক্তিগত জীবনে কখনও সামান্যতম বিলাস ব্যসনকেও প্রশ্রয় দেননি। আর ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে ক্ষমতাবান সম্রাটের সমাধি তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ীই সবচেয়ে বাহুল্যহীন সবচেয়ে অনাড়ম্বর। এই দীনতা, এই বিনয় শিক্ষণীয়। যদি আজকের ভারতের প্রধান ঔরঙ্গজেবের জীবন থেকে কিছু শিখতে পারতেন, তবে তিনি নির্লজ্জের মতো দশ লাখ টাকা দামের কোট পরতেন না! হিসেব বলছে, তার প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খরচ নাকি কয়েক লক্ষ টাকা, যা আসে জনগণের টাকা থেকে!
অন্য ইতিহাসবিদদের কথা না হয় পরে বলছি। এই সংঘী দক্ষিণপন্থীদের যারা মতাদর্শগত গুরু, তাদের মধ্যে সাভারকার এবং গোলবালকার শিবাজীপুত্র শম্ভাজীকে বদরাগি, মদ্যপ, নারীলোলুপ এবং রাজ্য শাসনে অনুপযুক্ত বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন তাঁদের লেখায়। ‘ছাবা’ এহেন শম্ভাজিকেই বানিয়েছে ইতিহাসের এক বিরাট চরিত্র, এবং মহান শহিদ। আসলে একটি প্রোপাগান্ডা ফিল্ম যা করতে চায়, ‘ছাবা’ও স্বাভাবিকভাবে তাই করেছে, ইতিহাসের বিকৃত রূপ পরিবেশন করেছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যে প্রচার করেছে। আর সেই মিথ্যের যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের প্রতি তাঁরা খড়্গহস্ত হয়েছে। ইন্দ্রজিৎ সাওয়ান্ত এরকমই একজন মারাঠা ইতিহাসবিদ। যিনি সারা জীবন ধরে শিবাজী ও মারাঠা রাজের ওপর গবেষণা করে গেছেন। তিনি খুব যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলেছেন ‘ছাবা’ একটি ছবি, যেখানে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। তার একটা উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন যে এখানে খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে শিবাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী সায়ারাবাই ভোঁসলেকে অথচ সাওয়ান্ত মনে করেন যে আসল ভিলেন শিবাজীর একজন ব্রাহ্মণ পরামর্শদাতা, যার নাম আন্নাজি দাত্ত। এই সত্যটা উন্মোচন করার জন্য তাঁকে মধ্যরাত্রে ফোন করে শাসানো হয়েছে।
‘ছাবা’ এমন একটি ছবি, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঔরঙ্গজেবকে হিন্দু বিদ্বেষী একজন ক্রুর মানুষ বলে প্রতিষ্ঠা করা, যার কোনও বিবেক নেই। প্রথমত ঐতিহাসিকভাবে এগুলো সব অর্ধসত্য। কারণ বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডার মুসলিম শাসকদের ওপর যখন মুঘল সাম্রাজ্যের আক্রমণ নেমে এল, তখন কিন্তু শম্ভাজি মুঘলদের সাহায্য করেছিলেন। তার ফলশ্রুতি হল যখনই বিজাপুর গোলকুণ্ডার সুলতানদের পতন হল, তখনই দাক্ষিণাত্যে মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ, তারও পতন হল। স্বাভাবিকভাবেই মারাঠারা একা হয়ে গেল এবং সেই সুযোগ মুঘল সম্রাট নিলেন। অর্থাৎ শম্ভাজি নিজের মূর্খামিতেই নিজের পতন ডেকে আনলেন। এসব কথা ‘ছাবা’র মতো একটি তৃতীয় শ্রেণির ছবিতে থাকবে না এটাই আশা করা যায়। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা ছবিগুলোর সবচেয়ে বড় চালাকি হল তারা একজন মানুষ বা একটি সম্প্রদায়কে খলনায়ক বানানোর জন্য ইতিহাসের একটা নির্বাচিত ও একমুখী বর্ণনা হাজির করে। এ ছবিতেও ঔরঙ্গজেবকে এক বিশুদ্ধ খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। যদুনাথ সরকারের মতো ইতিহাসবিদ যেভাবে ঔরঙ্গজেবকে এক জটিল চরিত্রের দোষগুণে মিশ্রিত শাসক হিসেবে দেখিয়েছেন সেসব এই ছবির কাছে আশা করা অন্যায়। ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রুস্কের লেখা ‘ঔরঙ্গজেব দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ পড়লেও ঔরঙ্গজেবকে এক জটিল চরিত্রের বহুমুখী দোষগুণের মানুষ বলে চেনা যায়।
………………………………..
পড়তে পারেন অন্য লেখাও: কৌতুকশিল্পীরা সত্যিটা তুলে ধরছেন বলেই শাসকের এত রাগ!
…………………………………
‘ছাবা’ এতটাই খেলো একটা ফিল্ম যে তা আরএসএস-এর একটা অংশকেও রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। আরএসএস নেতা দত্তাত্রাও হসবলে এক জায়গায় বলেছেন যে, ঔরঙ্গজেবের বদলে নাকি শাহাজাদা দারা সিকোকে হিরোর মর্যাদা দেওয়া উচিত। আসলে শম্ভাজি তো তাঁদের দুই পূর্বসূরী সাভারকার এবং গোলবালকরের দ্বারা সমালোচিত একটি চরিত্র। তাকে ‘ছাবা’ এতটা হাইলাইট করেছে, এমন নায়ক বানিয়েছে যে, খোদ আরএসএস অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। এবং তারা অনন্যোপায় হয়ে দারা সিকোর স্বরণাপন্ন হয়েছে! শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই মুখ লুকিয়ে হাসতেন!
সমস্যা হল আরএসএস বা এই ধরনের ফ্যাসিবাদীরা অন্য ইতিহাস তেমন পড়েন না, বা পড়লেও ট্রুশকের মতো ইতিহাসবিদদের পছন্দ হয় না তাদের। ‘ঔরঙ্গজেব দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ পড়লে তাঁরা একটু অন্য ধরনের ঔরঙ্গজেবকে খুঁজে পেতেন। বইয়ের একেবারে প্রথম চ্যাপ্টারে ট্রুশকে ঔরঙ্গজেবের জীবনের শেষ ক’বছর দিয়ে শুরু করেছেন। জীবন সায়াহ্নে ঔরঙ্গজেব তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র এবং তৃতীয় পুত্রকে কয়েকটা চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিগুলোতে তিনি নিজের প্রতি কিছু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অনেকে বলেন ঔরঙ্গজেব ছিলেন সন্দেহ বাতিগ্রস্ত। কিন্তু তিনি এই জায়গায় একজন দার্শনিক, কারণ তিনি নিজেকেও তার বিশ্বের-বিক্ষার বাইরে রাখেননি। দ্বিতীয় পুত্র আজম শাহকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলছেন, ‘আমি শাসক হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমি আমার প্রজাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারিনি। অমূল্য জীবন শেষ হতে চলল। ঈশ্বর আমার সামনেই ছিলেন, কিন্তু আমার দৃষ্টির স্বল্পতা তার মহিমাকে দেখতে পায়নি।’ ৫০ বছর তিনি ভারত-সম্রাট ছিলেন, ১৫ কোটি মানুষ ছিল তাঁর প্রজা। সবচেয়ে বড় মুঘল সাম্রাজ্য তাঁর হাতেই তৈরি। তাঁর তোষাখানায় মজুদ ছিল হিরে, জহরত, মনি-মাণিক্য আর কোহিনুর সিংহাসন। এত ক্ষমতা এত সম্পদ তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আড়াল করতে পারেনি। এত অর্জনের পরেও যিনি নিজের ব্যর্থতায় বিষাদ্গ্রস্ত হতে পারেন তিনি যে দার্শনিক, এতে তো কোনও সন্দেহ নেই! তিনি মনে করতেন কিছুই তাঁর ব্যক্তিগত ভোগের জন্য নয়, রাজকোষের বিপুল অর্থ আর কুবেরের ঐশ্বর্যের তিনি কাস্টডিয়ান-মাত্র। এই ধার্মিক সুন্নি সম্রাট জীবনে কোনও দিন বিলাসবহুল রাজসজ্জায় শয়ন করেননি। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের জীবন কেটেছে ভূমিসজ্জায় শয়ন করে। সমস্ত জীবন সুফি ও ফকিরদের সঙ্গ করেছেন। আর্যাবর্ত নয়, ফুল্ল-কুসুমিত বঙ্গভূমি নয়, তিনি ছিলেন দিল্লির এক সম্রাট, যাঁর প্রিয় ভূমি ছিল দাক্ষিণাত্য। গোঁড়া সুন্নি হয়েও সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর আত্মিক টান, নিজেও ছিলেন অসাধারণ সঙ্গীতজ্ঞ। চাটুকারদের প্রশ্রয় দিতেন না, সারা জীবন ছিলেন আশ্চর্যরকম একাকী।
চেয়েছিলেন তাঁর সমাধি হোক ক্ষমতার অলিন্দ থেকে বহু দূরে মহারাষ্ট্রের অখ্যাত খুলদাবাদে শেখ জৈনুদ্দিন দরগায়। চেয়েছিলেন ফকিরের মতো অনাড়ম্বর সমাধি। নিজের পছন্দ করা এক নাম-ফলকবিহীন সমাধিতে শুয়ে আছেন হিন্দুস্তানের সবচেয়ে শক্তিমান সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীর। এটাই তো ভারতবর্ষ!
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।