অম্বুবাচী প্রকৃত অর্থে এক কৃষিভিত্তিক লোকধর্ম। রজঃস্বলা নারীর সঙ্গে তুলনা হয় মাটির। কালো মেঘের নতুন বৃষ্টিতে মাটি হয়ে ওঠে রসবতী। এই সময়ের নাম ঋতুকাল। অম্বুবাচীর তিন-চারদিন পর মাটি ভিজলে সেই মাটি হয়ে ওঠে আমন ধান চাষের উপযোগী। গ্রামের মানুষ তখন বলে মাটির ‘বতর’ উঠেছে।
পৃথিবী এখন রজঃস্বলা। শুরু হয়েছে অম্বুবাচী। পৃথিবীর রক্ত নিয়ে বয়ে চলা নদীদের জল সেই রজঃ বহন করছে। তাই পরপর তিনদিন (মতান্তরে সাতদিন) পৃথিবীর বুকে বয়ে চলা নদীর জলকে কেউ স্পর্শ করবে না। কেবল তাকে বইতে দেবে। পৃথিবীর বুক থেকে কেউ এক খাবলা মাটি কোপাবে না। পৃথিবীকে স্পর্শ করবে না।
অম্বুবাচী শুরুর সময়কে বলে ‘প্রবৃত্তি’। আর শেষের সময়কে বলে ‘নিবৃত্তি’। নারী আর প্রকৃতি একে অন্যের সঙ্গে মিশে থাকে। আগেকার দিনের আটপৌরে মেয়েরা পড়াশোনো জানত না। কিন্তু দিনক্ষণ মনে রাখত তারা ঠিকভাবে। মাধ্যম ছিল ছড়া। ‘কিসের বার কিসের তিথি/ আষাঢ় মাসের সাত তারিখ অম্বুবাচী তিথি’।
জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, মহাজাগতিক এই ভূমণ্ডলে পৃথিবী যখন সূর্যের মিথুন রাশিতে আদ্রা নক্ষত্রে অবস্থান করে, সেই দিন থেকে বর্ষাকাল শুরু। আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রে তিন পাদ শেষ হলে পৃথিবী রজঃসিক্ত হয়। খুঁজে দেখতে ইচ্ছে হল পুরনো দিনের পাঁজি কী বলছে এই বিষয়ে। ১৯৯০ সালের পিএম বাগচির ‘ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা’ (পৃ. ৬৫) খুললে দেখা যাবে, সেখানে লেখা আছে, ‘অম্বুবাচী মধ্যে দুগ্ধপান আবশ্যক। বীজবপনাদি নিষেধ ও অনধ্যায়। যতী, ব্রতী, বিধবা ও দ্বিজদিগের পাকদ্রব্যভক্ষণ নিষেধ। অম্বুবাচী প্রবৃত্তিকাল হইতে তম্নিবৃত্তিকাল পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী বিশেষ যাত্রা সাবকাশ শুভকার্য্য নিষেধ। যতি, বিধবা, ব্রহ্মচারী ও ব্রাহ্মণের পক্ষে স্বপাক ও পরপাক অন্নভোজন চণ্ডালন্ন ভোজনের তুল্য।’
গ্রামবাংলার চাষি-পরিবারে একটা ছড়া এখনও শেখানো হয়। তা হল ‘অম্বুবাচীতে সাত হাত মাটি ভিজাবে ঠাকুর/ চাষিরা সব চাষে লাগার জন্য হয়েছে ব্যাকুল’। মানুষের বিশ্বাস ছিল, অম্বুবাচী শুরু হলেই বৃষ্টি হবে। আর সেই বৃষ্টিতে শীতল হবে পৃথিবীর দেহ। জলের ঔরসে ভিজবে পৃথিবীর পুরো শরীর। গর্ভবতী হবে পৃথিবী। বীজের অঙ্কুর পৃথিবীর দেহরস শোষণ করে অনাবিষ্কৃত রেখে দেবে তার বড় হয়ে ওঠার কাহিনি। মাটির তলার গোপন কাহিনি জানবে মাটির বন্ধু চাষি, যার সঙ্গে পৃথিবীর অপার যোগাযোগ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অম্বুবাচী নিয়ে নানা বিশ্বাস ছড়িয়ে রয়েছে বাংলা জুড়ে। বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ে গ্রামের কুমারী মেয়েরা এই সময় ‘মাটি খেলা’ করে। মাটির দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ছুড়ে-ছুড়ে ফেলা হয় অনেক দূরে। এই খেলায় কোনও পুরুষ অংশগ্রহণ করে না। বেলিয়াতোড়ের তেঁতুলিয়া গ্রামে আবার সাতদিন চাষবাস বন্ধ থাকে। ইন্দুপুরের ক্ষীরপাই গ্রামে অম্বুবাচীর দিন কেউ ভাত খায় না। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় এলাকায় সমস্ত রকম শিকার বন্ধ থাকে। হুগলির পাণ্ডুয়াতে ভেজনপুর গ্রামে অম্বুবাচীর দিন নিরামিষ রান্না হয়। আর সঙ্গে মনসার থানে দেওয়া হয় পুজো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অম্বুবাচী প্রকৃত অর্থে এক কৃষিভিত্তিক লোকধর্ম। রজঃস্বলা নারীর সঙ্গে তুলনা হয় মাটির। কালো মেঘের নতুন বৃষ্টিতে মাটি হয়ে ওঠে রসবতী। এই সময়ের নাম ঋতুকাল। অম্বুবাচীর তিন-চারদিন পর মাটি ভিজলে সেই মাটি হয়ে ওঠে আমন ধান চাষের উপযোগী। গ্রামের মানুষ তখন বলে মাটির ‘বতর’ উঠেছে।
অম্বুবাচী নিয়ে নানা বিশ্বাস ছড়িয়ে রয়েছে বাংলা জুড়ে। বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ে গ্রামের কুমারী মেয়েরা এই সময় করে ‘মাটি খেলা’। মাটির দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ছুড়ে-ছুড়ে ফেলা হয় অনেক দূরে। এই খেলায় কোনও পুরুষ অংশগ্রহণ করে না। বেলিয়াতোড়ের তেঁতুলিয়া গ্রামে আবার সাতদিন কৃষিকাজ বন্ধ থাকে। ইন্দুপুরের ক্ষীরপাই গ্রামে অম্বুবাচীর দিন কেউ ভাত খায় না। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় এলাকায় সমস্ত রকম শিকার বন্ধ থাকে। হুগলির পাণ্ডুয়াতে ভেজনপুর গ্রামে অম্বুবাচীর দিন নিরামিষ রান্না হয়। আর সঙ্গে মনসার থানে দেওয়া হয় পুজো।
ওড়িশাতে অম্বুবাচীকে বলা হয় ‘রজঃসংক্রান্তি’। কুমারী মেয়েরা এই ব্রত পালন করে সেই রাজ্যে। তবে দিনক্ষণটা এলাকা ভিত্তিতে একটু পাল্টে পাল্টে যায়। অনেক জায়গায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দু’দিন আর পয়লা আষাঢ় পালিত হয় অম্বুবাচী। এই সময় কুমারী মেয়েরা রান্না করে না। রান্না খাবারও খায় না। খাবার মধ্যে তারা খায় পান্তাভাত, দই-মিষ্টি। আর সূর্য ডুবলে জল ছাড়া কিছুই খাওয়া বারণ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সুপ্রতিম কর্মকার-এর লেখা: নির্বাচনে ব্যস্ত বনকর্মীরা, জঙ্গল পুড়ছে অবলীলায়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। রয়েছে এই বঙ্গেই। পৃথিবীর সব নদী রজঃস্বলা হলেও আত্রেয়ী রজঃস্বলা হয় না। এই নদীর জল ব্যবহারে কোনও দোষ হয় না। ‘সদানীরা’ বা তিস্তা নদীর কন্যা আত্রেয়ী। আত্রেয়ী ছিল লাবণ্যময়ী। হাজার হীরের মতো ঔজ্জ্বল্য ছিল তার শরীরে। এমন রূপ দেখে আত্রেয়ীকে এক দৈত্য পথ ভুল করে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল পাতালে। তা দেখে মা গঙ্গা তিনজন দেবদূতকে মর্তে পাঠান, দৈত্যের হাত থেকে আত্রেয়ীকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু মর্তে এসে তিন দেবদূত আত্রেয়ীর রূপ দেখে আত্রেয়ীর প্রেমে পড়ে যায়। তড়িঘড়ি দৈত্য-বধ করে তিন দেবদূত প্রেম নিবেদন করে আত্রেয়ীকে। আত্রেয়ী রাজি না হওয়ায় তিনজনেই আত্রেয়ীর হাত ধরে নিজের দিকে টানতে যায়। আর তখনই তিন দেবদূত তিন রকম ফুল হয়ে যায়। একজন হয় লোধ্র ফুল, দ্বিতীয়জন হয় করবী ফুল আর শেষজন হয় কুসুমটুলি ফুল। এরপর আকাশ থেকে দৈববাণী হয়। সেই ফুল দিয়ে সারা জীবন আত্রেয়ীকে পুজো করতে হবে। খারাপ মনে দেবদূতরা আত্রেয়ীকে ছুঁয়েছিল বলে, আত্রেয়ী নদীর রূপ ধরে বয়ে চলে। বিয়ে না করে আত্রেয়ী চিরকাল কুমারী থেকে গেল। আত্রেয়ী কুমারী নদী হওয়াতে অম্বুবাচীর দিনে এই নদী ঋতুমতী হয় না।
নদীরও তো গর্ভধারণ করতে ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছের কথা কেউ মনে রাখল না। কাজেই একা বয়ে চলে কুমারী নদী, সব দুঃখকে জলের সঙ্গে ভাসিয়ে দিয়ে।
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………